বিশ্বকাপের ব্যবচ্ছেদ: গ্রুপ 'এফ'
জার্মানি
ব্রাজিল বিশ্বকাপে এক কথায় অদম্য ছিল তারা। নকআউট পর্বে ফ্রান্স, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মতো প্রতিপক্ষকে হারিয়ে মারাকায় চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপ জিতেছিল জার্মানি। এবারও শক্তিশালী এক স্কোয়াড নিয়েই শিরোপা ধরে রাখার মিশনে রাশিয়া এসেছে জোয়াকিম লো'র দল। সাথে আছে গত বছর এখানেই কনফেডারেশনস কাপ জয়ের সুখস্মৃতি। ১৫ জুলাই লুঝনিকি স্টেডিয়ামে ষাটের দশকে ব্রাজিলের পর জার্মানি এবার শিরোপা ধরে রাখার রেকর্ড করলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
'ডি ম্যানশ্যাফট'দের হয়ে নিজের ৩য় বিশ্বকাপে এসেছেন লো। সেমিফাইনালের আগে বাদ পড়েননি কোনো বারই। গত দু'বারের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা (ইতালি, স্পেন) গ্রুপপর্ব থেকে বাদ পড়লেও জার্মানির ক্ষেত্রে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। লো বোধ হয় আগে থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। দল বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আবেগকে মোটেই জায়গা দেননি। আগের বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করা মারিও গোটশের তাই জায়গা হয়নি। পছন্দমতো দল বাছাই করতে গিয়ে লিরয় সানেকেও বাদ দিয়েছেন।
প্রীতি ম্যাচে মন ভরাতে না পারলেও আক্ষরিক অর্থেই নিখুঁত এক বাছাইপর্ব কাটিয়ে রাশিয়ার টিকেট পাকা করেছে লো'র দল। প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে অদম্য জার্মানি, সেই ইতিহাসও অনুপ্ররেণা যোগাচ্ছে। নিজের পছন্দের ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে আক্রমণভাগকে যতটা দুর্ধর্ষ বানিয়েছেন, রক্ষণকে করেছেন ঠিক ততটাই দৃঢ়। ১০ ম্যাচে করা ৪৩ গোলের বিপরীতে জার্মানি বাছাইপর্বে গোল হজম করেছে মাত্র ৪টি। ক্রুস-ওজিলদের সাথে ভার্নার, ব্র্যান্ডটদের বোঝাপড়াটাও জমে উঠেছে দারুণ। দলীয় এই ঐক্যই জার্মানদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে শিরোপা ধরে রাখার।
শক্তিঃ
- জেতার মানসিকতা। 'প্রেশারকুকার সিচুয়েশন'-এ ঠাণ্ডা মাথায় ম্যাচ বের করে আনতে জুড়ি নেই জার্মানদের। সেই সাথে ৪ বছর আগে মারাকানায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া দলটির অনেকেই আছেন মূল একাদশে। তরুণদের মাঝেও সেই মানসিকতার বীজটা বপন হয়ে গেছে গত বছরের কনফেডারেশনস কাপের সময়ই, যখন নিতান্তই দ্বিতীয় সারির দল নিয়েও শিরোপা জিতেছিল তারা।
- একক নির্ভরশীলতা বলে কিছু নেই লো'র দলে। মিশর, পর্তুগালদের মত একজন নয়, বরং দল হিসেবেই এগিয়ে যাওয়াটা জার্মানদের অন্যতম মূল শক্তি। এমনকি কোনো ভার্নার-ওজিলরা ফর্মে না থাকলেও ম্যাচ বের করে আনতে সক্ষম হামেলস-বোয়াটেংরাও। ব্রাজিল বিশ্বকাপে ফ্রান্সের বিপক্ষে কোয়ার্টারের ম্যাচটিই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
দুর্বলতাঃ
- প্রতি আক্রমণে খেলা দলগুলোর বিপক্ষে ঠিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না জার্মানি। কিমিচ-হেক্টর দুই ফুলব্যাকই আক্রমণাত্মক হওয়ায় রক্ষণে ফাঁকফোকর দেখা যায় প্রায়ই। প্রতি আক্রমণে ঠিকমত ঐ ফাঁকা জায়গাগুলো কাজে লাগাতে পারলে জার্মানদের রুখে দেওয়া সম্ভব। দিন কয়েক আগের প্রীতি ম্যাচে তাদের হারিয়ে এমনটাই প্রমাণ করেছে অস্ট্রিয়া।
ভবিষ্যতবাণীঃ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় পর্বে, সেখান থেকে সেমিফাইনালে
মেক্সিকো
ফেসবুকে বহুল প্রচলিত 'টোয়ালাইটের চেয়েও ভাল প্রেমকাহিনী' মূলক ট্রলই যেন মেক্সিকো আর তাদের বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায় নেওয়ার গল্প। ১৯৯৪ থেকে পরের ৫ বিশ্বকাপের প্রতিটিতেই বিদায় নিয়েছে ২য় রাউন্ড থেকেই। আকর্ষণীয় ফুটবল খেললেও ১৯৭০ বা ১৯৮৬-এর কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার স্বপ্ন আর বাস্তবে পরিণত করতে পারেনি 'এল ত্রি'রা। এবারও কনকাকাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েই রাশিয়া এসেছে তারা। মেক্সিকো কি পারবে গত ৫ বারের গেরো কাটাতে?
ক্যারিয়ারে এবারই প্রথম কোচ হিসেবে বিশ্বকাপে এসেছে হুয়ান কার্লোস অসোরিও। বাছাইপর্বে ২১ পয়েন্ট নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েই বিশ্বকাপে জায়গা পাকা করেছে তার দল। ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে দলের খেলায় এনেছেন শৈল্পিক পাসিং ফুটবলের পসরা। দ্বিতীয় রাউন্ডের গেরো কাটাতে অসোরিওর কৌশলের দিকেই তাকিয়ে থাকবে মেক্সিকোবাসী।
শক্তিঃ
- অবশ্যই রক্ষণভাগ। কনকাকাফ বাছাইপর্বে সবচেয়ে কম গোল হজম করেই রাশিয়াযাত্রা নিশ্চিত করেছে মেক্সিকো। সুইডেন, দক্ষিণ কোরিয়াকে টপকে দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে হলে রেয়েস-মরেনোদের জমাট রক্ষণের ওপরই নির্ভর করবে অনেক কিছু।
- অভিজ্ঞতা। ইতিহাসের মাত্র ৩য় ফুটবলার হিসেবে নিজের ৫ম বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন রাফায়েল মার্কেজ। সেই সাথে আছেন ওচোয়া, গুয়ার্দাদো, চিচারিতো, সালসিদোদের মত অভিজ্ঞ ফুটবলাররা, যারা ছিলেন গত বিশ্বকাপেও।
দুর্বলতাঃ
- গোলের অভাবটা বেশ ভালমতই ভোগাবে মেক্সিকোকে। বাছাইপর্বে ১০ ম্যাচে মাত্র ১৬বার জাল খুঁজে পেয়েছিল অসোরিওর দল। মূলপর্বে জমাট রক্ষণের মতই গোলের সামনেও সমান দক্ষ হতে হবে ফরওয়ার্ডদের।
- ফর্মহীন চিচারিতো, অসোরিওর দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ। গত মৌসুমে ওয়েস্ট হামের হয়ে গোল করেছেন মাত্র ৮টি, বাছাইপর্বে ১০ ম্যাচে মাত্র ২বার খুঁজে পেয়েছেন জাল। সব মিলিয়ে চিচারিত জ্বলে উঠতে না পারলে এবার হয়ত গ্রুপপর্বই পেরুনো হবে না 'এল ত্রি'দের।
- বিশ্বকাপের কয়েকদিন আগে দলের ৮/৯ জন খেলোয়াড় নারী কেলেংকারীতে জড়িয়ে নাম খারাপ করেছেন দেশের। যদিও মেক্সিকোর ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ব্যাপারটা হালকাভাবেই দেখেছে। তবুও দলের দলের ঐক্য নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
ভবিষ্যতবাণীঃ ১ জয় নিয়ে গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায়
সুইডেন
ইব্রাহিমোভিচ-পরবর্তী যুগের প্রথম বিশ্বকাপে যাচ্ছে সুইডেন। অবশ্য নিজেদের ইতিহাসের সেরা স্ট্রাইকারের অভাবটা একেবারেই টের পায়নি তারা। বাছাইপর্বে নেদারল্যান্ডসকে পেছনে ফেলে রানার-আপ হয়ে প্লে-অফে, সেখান থেকে ইতালিকে হারিয়ে প্রায় এক যুগ পর বিশ্বকাপের মূলপর্বে এল 'ব্লু-ইয়েলো'রা। রাশিয়া যাত্রা নিশ্চিত করার পর ইব্রার দলে ফেরার জোর গুঞ্জন শোনা গেলেও শেষমেশ তাকে ছাড়াই নিজেদের দ্বাদশ বিশ্বকাপ মিশনে যাচ্ছে সুইডেন। তবে ইব্রাহীন সুইডেনকে ভরসা দেখাচ্ছে ইতিহাস। নিজেদের আগের ১১ বিশ্বকাপের মূলপর্বে মাত্র ৩বার গ্রুপপর্ব পেরুতে পারেনি তারা। প্রতিপক্ষ যখন মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া; তখন গ্রুপপর্বে বাদ পড়ার সংখ্যাটা অপরিবর্তিত রাখার স্বপ্ন দেখতেই পারে সুইডিশরা।
কিছুটা নীরবে নিভৃতেই নিজের কাজটা দারুণভাবে করে যাচ্ছেন কোচ ইয়ান অ্যান্ডারসন। এতদিন পর এবার এসে পেয়েছেন নিজের প্রাপ্য সম্মানটুক। ৪-৪-২ ফর্মেশনে ইব্রাকে ছাড়াও খুব একটা ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না তাদের। ৪বার সেমিফাইনাল খেলা সুইডেনকে কত দূর নিয়ে যেতে পারেন অ্যান্ডারসন; দেখার বিষয় এখন সেটিই।
শক্তিঃ
- জমাট রক্ষণ। বাছাইপর্বে ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডসের মত প্রতিপক্ষ থাকলেও ১০ ম্যাচ মাত্র ৯ গোল হজম করেছিল সুইডিশ রক্ষণভাগ। আর প্লে-অফে তো এই রক্ষণ দিয়েই বুফন এবং ইতালিকে কাঁদিয়ে নিশ্চিত করেছে রাশিয়া যাত্রা। দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে হলে লিন্ডেলফ-ইয়ানসেন জুটির রক্ষণ পারদর্শীতার দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে সুইডেনকে।
- অভিজ্ঞতা এবং তারুণ্যের দারুণ মিশেলে এক দল সাজিয়েছেন অ্যান্ডারসন। মূল একাদশের প্রত্যেকেই প্রতিদান দিয়েছেন কোচের আস্থার। দলগত বোঝাপড়াটাও দারুণ সুইডিশদের মধ্যে।
দুর্বলতাঃ
- চিরাচরিত ৪-৪-২ ফর্মেশনে খেলা সুইডেনের আক্রমণভাগ প্রতিপক্ষকে চমকে দেওয়ার সম্ভাবনা জাগাচ্ছে না খুব একটা। সেই সাথে আক্রমণভাগে গতিশীল উইঙ্গার নেই তেমন কেউই। প্রতি আক্রমণেও তাই খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারবে না অ্যান্ডারসনের দল।
- অভিজ্ঞতা থাকলেও দলের অধিকাংশই এবারই নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন। বাছাইপর্ব, প্লে-অফে ভাল করলেও মূলপর্বের হিসেব একেবারেই আলাদা। ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরে এই অনভিজ্ঞতা বেশ ভোগাতে পারে সুইডিশদের।
ভবিষ্যতবাণীঃ রানার-আপ হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে, সেখান থেকে বিদায়
দক্ষিণ কোরিয়া
বিশ্বকাপে দক্ষিণ কোরিয়া মানেই ২০০২ সালের সেই রূপকথা। ইতালি, স্পেনকে হারিয়ে যারা পৌঁছে গিয়েছিল সেমিফাইনালে। এরপরের তিন বিশ্বকাপে তেমন কোনো চমক উপহার দিতে না পারলেও এশিয়ার প্রতিনিধিত্বটা বেশ ভালমতই করেছে তারা। ১৯৮৬ থেকে বিশ্বকাপে নিয়মিত থাকা দলটির অবশ্য অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ নেই একেবারেই।
বাছাইপর্বের একেবারে শেষদিকে দায়িত্ব নিয়েছিলেন দলের। মাত্র দুই ম্যাচ বাকি থাকতে কোচের হটসিটে বসে দুই গোলশূন্য ড্র দিয়ে নিশ্চিত করেছিলেন রাশিয়া বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ। এখনও প্রতিযোগীতামূলক ম্যাচে জয়ের মুখ না দেখা শিন তাই-ইয়ং অবশ্য ফিরিয়ে এনেছেন সেই চিরপরিচিত গতিশীল এবং প্রেসিং ফুটবল, যার জোরেই ২০০২ সালের রূপকথা জন্ম দিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া। ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে এখনও জয়হীন থাকলেও সমর্থক এবং সাবেকদের প্রশংসা ঠিকই কুড়িয়েছেন তাই-ইয়ং।
শক্তিঃ
- ফরোয়ার্ডদের প্রত্যেকেই গতিশীল এবং প্রতি আক্রমণে বেশ দক্ষ। বাছাইপর্বে কোরিয়ার ১০ গোলের ৫টিই এসেছিল প্রতি আক্রমণে ফরওয়ার্ডদের গতির কল্যাণে। প্রতি আক্রমণেই খেলা দক্ষিণ কোরিয়ার তাই মূল ভরসা হিউ-মিন সন এবং লি কুন-হোদের ওপরই।
- অভিজ্ঞতা। এবারের ২৩-জনের স্কোয়াডের ১৬জনই ছিলেন ব্রাজিল বিশ্বকাপে। তাই মূলপর্বের চাপে ভেঙ্গে পড়ার সুযোগ দক্ষিণ কোরিয়ার নেই বললেই চলে।
দুর্বলতাঃ
- নড়বড়ে রক্ষণভাগ। বাছাইপর্বে ১০ ম্যাচে ১০ গোল হজম করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার রক্ষণভাগ। দ.কোরিয়ানরাও অবশ্য রক্ষণের নড়বড়ে অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন বেশ! শারীরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে বরাবরই ধুঁকেছে তাদের রক্ষণ। বিশেষ করে ক্রসনির্ভর ফুটবলে অভ্যস্ত দলগুলোর বিপক্ষে বেশ বেগ পেতে হবে তাদের।
- রক্ষণভাগের মতই আক্রমণভাগের অবস্থা সুবিধার নয় খুব একটা। বাছাইপর্বে মাত্র ১৬ গোল করেছিল তারা। গ্রুপপর্ব পেরিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে হলে সন, কিদের গোলের দিকেই তাকিয়ে থাকবে কোরিয়াবাসী।
ভবিষ্যতবাণীঃ কোনো ম্যাচ না জিতে প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায়