• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    বিশ্বকাপের ব্যবচ্ছেদ : গ্রুপ জি

    বিশ্বকাপের ব্যবচ্ছেদ : গ্রুপ জি    

     

    বেলজিয়াম
    তারকাঠাসা বেলজিয়ামের সবচেয়ে বড় রোমাঞ্চের নাম তাদের গোল-স্কোরিং। বাছাইপর্বে ৯ ম্যাচে ৪৩ গোলও একটা রেকর্ড। অবশ্য বাছাইপর্ব সে অর্থে কোনও পরীক্ষাই নিতে পারেনি বেলজিয়ামের। গ্রীসের সঙ্গে ড্র ছাড়া কোনও পয়েন্টও হারায়নি তারা। শুধু বাছাইপর্ব নয়, কোচ রবার্তো মার্টিনেজের অধীনে তেমন কোনও ঝামেলায় হয়নি বেলজিয়ামের। সবচেয়ে বড় খচখচানিও সেখানেই। 

    নভেম্বরে মেক্সিকোর সঙ্গে ৩-৩ গোলের রোমাঞ্চকর ড্রয়ের পর কেভিন ডি ব্রুইন তো কোচ রবার্তো মার্টিনেজের ট্যাকটিকস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন সরাসরিই, “মেক্সিকো আমাদের উইংকে ঠেলে ধরছিল বারবার। আমরা মিডফিল্ডে সাঁতার কাটছিলাম যেন। এটা ছিল সাতজনের বিপক্ষে পাঁচজনের লড়াই।” বিশ্বকাপেও এই ঝামেলায় পড়তে পারে বেলজিয়াম, প্রতিপক্ষের মাঝমাঠে  তিনজন মিডফিল্ডার থাকলে। সব মিলিয়ে রক্ষণেও বেশ ঝামেলা আছে বেলজিয়ামের। এই স্কোয়াডের খেলার ধরনের সঙ্গে যান না বলে জায়গা হয়নি মিডফিল্ডার রাদজা নাইঙ্গোলানেরও। 

    বিশ্বকাপের আগে প্রীতি ম্যাচে সৌদি আরব ও কোস্টারিকাকে উড়িয়ে দিলেও পর্তুগালের সঙ্গে ঠিকই আটকে গেছে বেলজিয়াম। ৩-৪-৩ ফর্মেশন থেকে ৩-৪-২-১ এ যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ, যুতসই একজন লেফট-ব্যাকের অভাব। ইয়ানিক কারাসকো তার রক্ষণের দায়িত্বটা যেন ভুলে বসেন প্রায়ই।

    বেলজিয়াম তাই যতটা রোমাঞ্চকর, ততটাই ভঙ্গুর! দ্বিতীয় রাউন্ড পেরিয়ে আরও দূরে যেতে তাই বেলজিয়ামকে কৌশলে পরিবর্তন আনতে হবে, রক্ষণে মার্টিনেজের “শর্টকার্ট” কৌশলের বদলে আনতে হবে আরও দৃঢ় কিছু। 

    শক্তি

    • বিশ্বমানের গোলকিপার, মানসম্পন্ন সেন্টার ব্যাক, মিডফিল্ডে দারুণ বৈচিত্র, আক্রমণে ইউরোপের কাঙ্খিত সব নাম- বেলজিয়াম স্কোয়াডে গুণের অভাব নেই! ২৩ জনের এই স্কোয়াডের নামগুলোই বেলজিয়ামের সবচেয়ে বড় শক্তি। 
    • কেভিন ডি ব্রুইন বিশ্বেরই অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার, ম্যানচেস্টার সিটির সর্বজয়ী দলের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা। এডেন হ্যাজার্ড ও ড্রিস মার্টেনস অসাধারণ উইঙ্গার। প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম শক্তিশালি স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু। বেলজিয়ামের আক্রমণভাগ ধসিয়ে দিতে পারে যে কোনও রক্ষণকেই। 


    দূর্বলতা

    • মার্টিনেজের কৌশল নিয়ে আছে প্রশ্ন। রক্ষণের ছিদ্র বন্ধ করতে তাই বেশ সংগ্রাম করতে হবে তাকে। এর আগে তার পোর্টফোলিওতে ছিল শুধুই প্রিমিয়ার লিগের কিছু সাফল্য। জাতীয় দল নিয়ে বিশ্বকাপে অন্যতম ফেভারিট হয়ে যাওয়ার দায়িত্বটা পালন করতে মার্টিনেজ মানসিকভাবে কতোখানি শক্ত থাকেন, প্রশ্ন সেটাই। দলে “অধিক সন্ন্যাসিতে গাঁজন নষ্ট” হয়ে যাওয়ার হুমকিটাও সামাল দিতে হবে তাকে। 

    ভবিষ্যতবাণী

    গ্রুপ রানার্স-আপ হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে, সেখান থেকে কোয়ার্টার ফাইনাল 


    পানামা

    ১৮ জুন বেলজিয়ামের সঙ্গে প্রথম ম্যাচ, সোচির আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যেতে পারে পানামার! একে তো প্রথম বিশ্বকাপ, তার ওপর বাছাইপর্বও পানামা পেরিয়েছে ভাগ্যের সঙ্গে দারুণ এক যুগলবন্দীতে। সেটাই যেন তাদের মতো ক্ষুদ্র এক জাতির ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন। বাছাইপর্বে দশটি ম্যাচের মধ্যে মাত্র তিনটি জিতেছে পানামা, গোল ব্যবধানও ঋণাত্মক। মূলপর্বে এমন ফলই পানামার জন্য স্বপ্নের সমান। 

    পানামার স্কোয়াড বুড়িয়ে যাওয়া, গতিতেও ভাটার টান তাই। কোচ হার্নান দারিও গোমেজ অভিজ্ঞ অবশ্য। ৪-৪-২ ফর্মেশন তার পছন্দ, তবে বেলজিয়াম ও ইংল্যান্ডের সঙ্গে ৪-৫-১ বা ৫-৪-১ ফর্মেশনে খেলাতে চাইবেন তিনি। এই দুই দলের আক্রমণভাগকে যতো আগে আটকে দেওয়া যায়, ততোই তো তাদের মঙ্গল। তিউনিসিয়ার সঙ্গে ম্যাচটাকেই তাই পাখির চোখ করার কথা পানামার, সেখানেও ফর্মেশনটা বদলে ৪-৪-২ হয়ে যেতে পারে। আক্রমণভাবে ব্লাস পেরেজ ও লুইস তেহেদা দীর্ঘ সময় ধরে গোল করে আসছেন। যথাক্রমে ৩৭ ও ৩৬ বছর বয়সী ফরোয়ার্ডের ক্যারিয়ারে এখন বেলাশেষের সুর উঠেছে, তবে পানামার অন্যতম বড় অস্ত্রও তারাই। 

    এই দুইজনের ঠিক উল্টোপাশে থাকবেন জেইমি পেনেডো, পানামার গোলকিপারই তাদের সবচেয়ে বড় তারকা। 

    শক্তি

    • হারানোর কিছু নেই আক্ষরিক অর্থেই- এই মন্ত্রই হতে পারে পানামার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। প্রথম বিশ্বকাপে উপভোগের মন্ত্র নিয়ে খেললে পানামার স্কোয়াড করে ফেলতে পারে অঘটন। ইংল্যান্ড-বেলজিয়াম-তিউনিসিয়া, নামের দিক দিয়ে সব দলই পানামার থেকে বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে, তবে প্রথম বিশ্বকাপে পানামার মূল লড়াইটা তো নিজেদের সঙ্গেই! 

    দূর্বলতা

    • প্রদীপের আলোর নিচের আঁধারের মতো করেই আছে বিশ্বকাপ না খেলার অভিজ্ঞতা। স্কোয়াডের অভিজ্ঞদের সঙ্গে তরুণরাও আছেন, তবে দুই প্রজন্মের গতি, মানসিকতা কতোখানি মিলবে, দেখার বিষয় সেটাই। 

    ভবিষ্যতবাণী

    জয়হীন থেকে গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় 

     

    তিউনিসিয়া

    পুরো টুর্নামেন্ট তো নয়ই, গ্রুপপর্বেও তিউনিসিয়া সবচেয়ে দূর্বল দল নয়। তবে ঠিক যেন রোমাঞ্চকর নয় আফ্রিকার দলটি। স্বভাবে রক্ষণশীল দল, তবে প্রতি-আক্রমণেও কেমন অনীহা আছে তাদের। ইংল্যান্ড ও বেলজিয়ামের সঙ্গে গোলশূন্য ড্রয়ের মতো ফলের দিকেই তাই নজর দেবে তিউনিসিয়া। শেষ ম্যাচটাও পানামার সঙ্গে, তিউনিসিয়ার জয়ের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা সেখানেই। 

    বাছাইপর্বেও তিউনিসিয়ার যাত্রাটা ছিল এমনই। কঙ্গো হুমকি কাটিয়েছে তারা দুই লেগে জিতেই, রাশিয়ার টিকেটও নিশ্চিত হয়ে গেছে যেন সেখানেই। 

    তবে বিশ্বকাপে ইউসেফ মসাকনির মতো আক্রমণভাগের তারকাকে নিশ্চিতভাবেই মিস করবে তিউনিসিয়া। চোটে পড়ে বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেছে তার। নাইম স্লিতি ও ওয়াহবি খাজরির ওপর তাই সব ভার বলতে গেলে এখন। ৪-৫-১ ফর্মেশনে খেলতে পারে তিউনিসিয়া। 

    প্রীতি ম্যাচে তুরস্কের সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করেছে ইগল অব কার্থেজরা, স্পেনের সঙ্গে হেরেছে মাত্র ১-০ ব্যবধানে। গোল আটকানোই ভরসা তাদের, সঙ্গে খাজরির সেট-পিস। 


    শক্তি

    • ফিট মিডফিল্ডই সবচেয়ে বড় শক্তি তিউনিসিয়ার। ফ্রেজনাই সাসি, মোহামেদ বিন আমর, ঘায়লেনে চালালি সেখানে মূল চালিকাশক্তি। স্লিতির মতো ফরোয়ার্ডের জন্য এই মিডফিল্ড যেমন উৎসাহের যোগানদাতা, রক্ষণের জন্যও তেমন সাহসের নাম! 

    দূর্বলতা

    • বাছাইপর্বে ১১টি গোল করেছে তিউনিসিয়া, তবে লিবিয়ার মতো দলের বিপক্ষেও দুই ম্যাচ মিলিয়ে পেনাল্টি থেকে মাত্র একটি গোল ছিল তাদের। তুরস্কের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচে একবার পিছিয়ে পড়ে ফিরে এসেছে, লিড নিয়েও ধরে রাখতে পারেনি সেটা। সবচেয়ে বড় চিন্তা তাই গোল-শিটে শূন্যতাই। 

    ভবিষ্যতবাণী

    গ্রুপ-পর্ব থেকেই বিদায়, পানামার সঙ্গে জয় 


    ইংল্যান্ড

    বেলজিয়ামের মতোই অবস্থান ইংল্যান্ডেরও। পেছনে শক্ত তিনজন, মিডফিল্ড নিয়ে প্রশ্ন, আক্রমণে মেধাবি সব খেলোয়াড়। হ্যাজার্ড বা ডি ব্রুইন নেই, তবে রাহিম স্টার্লিং ও হ্যারি কেনের জুটিটাও দেখার মতো। বক্সের ভেতরে কেন দারুণ, তবে ব্যর্থতার হারটাও কম নয়। স্টার্লিং তার গতির দারুণ উন্নতি করেছেন, সঙ্গে ক্লাব পর্যায়ে গোল-স্কোরিং-ও। রক্ষণে ভারসাম্য আছে, তবে গ্যারি কাহিল তার গতি নিয়ে ভুগছেন কিছুটা। 

    এরেক ডায়ার ও জর্ডান হেন্ডেরসন মিডফিল্ডে নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেন ভালভাবেই, তবে প্রথম পর্বের পর তাদেরকে কাজ করতে হবে একসঙ্গে। ডেলে অ্যালি ও জেসি লিনগার্ডের জুটিও ইংল্যান্ডের কাজে আসতে পারে বেশ ভালভাবেই। তবে গোলকিপার নিয়ে চিন্তা আছে ইংল্যান্ডের, শেষ কয়েকটি বিশ্বকাপে গোলপোস্টের নিচের প্রশ্নগুলোর জবাব এখনও খুব ভালভাবে দিতে পারেননি জর্ডান পিকফোর্ড। 

    বাছাইপর্ব পেরুতে অবশ্য ইংল্যান্ডকে বেগ পেতে হয়নি, ১০ ম্যাচ ধরেই অপরাজিত ছিল গ্যারেথ সাউথগেটের দল। প্রীতি ম্যাচে ইতালির সঙ্গে ড্র, নাইজেরিয়া ও কোস্টারিকার সঙ্গে জয়- ইংল্যান্ডের প্রাক-রাশিয়া প্রস্তুতি অবশ্য মিশ্র অনুভূতিরই। 

    তবে বল দখলে ঠিক পোক্ত নয় ইংল্যান্ড। সাউথগেটের কাজকারবার নিয়ে বেশ একটা ইতিবাচক ব্যাপার আছে, তবে টেকনিক্যাল ফুটবলার ব্যবহার করতেই অভ্যস্ত তিনি। মার্টিনেজের মতোই বড় মঞ্চে সাউথগেটের পরীক্ষা হয়নি, স্কোয়াডের দূর্বলতাগুলো বড় ম্যাচে বেড়িয়ে পড়লেই যেটা সামনে হাজির হবে তার। 

    সে পরীক্ষায় কিভাবে পাশ করে যান তিনি, তার ওপরই নির্ভর করছে ইংল্যান্ডের ইতিহাস বদলের অনেকখানি। ৪-২-৩-১ ফর্মেশন কাজে লাগিয়ে সাউথগেট নজর দিয়েছেন ৩-৪-৩ বা ৩-৫-২ এর মতো ফর্মেশনের দিকেও। 

     

    শক্তি

    • সবসময়ই প্রত্যাশার চাপটা বেশ ভারী হয়ে যায় ইংলিশ ফুটবলারদের কাঁধে। তাদের অবস্থা যেন সেই ভাল ছাত্রের মতো, প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষায় বেশ ভাল করলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে গুবলেট পাকিয়ে যায় সবকিছু। এবারের দলটা বেশ তরুণ, প্রত্যাশার চাপটা এবার তাই কম। ইংল্যান্ডের জন্য শাপেবর হতে পারে এটিই।
    • আক্রমণভাগ ইংল্যান্ডের অন্যতম বড় অস্ত্র। প্রতিপক্ষকে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে পারেন তারাই।

    দূর্বলতা

    • ইতিহাস। ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় বাধা বোধহয় এটিই। আরও আছে, এই দলটা ঠিক কোন ব্র্যান্ডের ফুটবল খেলতে চায়, নিশ্চিত নয় যেন সেটাও। ইংলিশ ব্র্যান্ডটা ঠিক করার জন্য অবশ্য বিশ্বকাপের মঞ্চটাই ব্যবহার করতে হবে। 

    ভবিষ্যতবাণী

    গ্রুপ-চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিফাইনাল