বিশ্বকাপের ব্যবচ্ছেদ: গ্রুপ 'এইচ'
পোল্যান্ড
সত্তরের দশকে বনিয়েকের সময়টায় ইউরোপের অন্যতম পরাশক্তি ছিল তারা। '৭৪ এবং '৮২- দু'বার গিয়েছিল সেমিফাইনালে। পরের দুই দশক শুধুই অপেক্ষা এবং হতাশার দীর্ঘশ্বাস। ২০০২ সালে আবারও 'গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ'-এর মূলপর্বে জায়গা পেলেও বিদায় নিতে হয়েছিল গ্রুপপর্ব থেকেই, '০৬-এও তা-ই। কিন্তু এবার দারুণ এক বাছাইপর্ব কাটিয়ে রাশিয়া যাওয়ার আগে তাই বনিয়েক যুগের অনুপ্রেরণাকে বাস্তবে পরিণত করার প্রত্যাশা করতেই পারে পোল্যান্ড। জাপান, কলম্বিয়া, সেনেগালকে নিয়ে গড়া গ্রুপ থেকে পোলিশরা পরের রাউন্ডে না গেলে সেটিই হয়ত হবে এবারের আসরের অন্যতম বিস্ময়।
দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় অর্ধ যুগ পেরিয়ে গেলেও এবারই প্রথম লেভানডফস্কিদের নিয়ে বিশ্বকাপ যাচ্ছেন কোচ অ্যাডাম নাওয়ালকা। দলটাকে চেনেন হাতের তালুর মতই। ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে তার পোল্যান্ড এবারের বাছাইপর্বে অন্যতম দৃষ্টিনন্দন খেলাই উপহার দিয়েছে। ম্যাচপ্রতি প্রায় ৩ গোলের রেকর্ড, সাথে লেভানডফস্কি, মিলিকদের মত দুর্ধর্ষ স্ট্রাইকার; প্রথম বিশ্বকাপেই দারুণ কিছু উপহার দেওয়ার স্বপ্ন তাই দেখতে পারেন ষাটোর্ধ্ব এই কোচ।
শক্তিঃ
-
অবশ্যই লেভানডফস্কি। ইউরোপের যেকোনো এক বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড গড়েছেন এবার (১৬)। প্রীতি ম্যাচগুলোতেও ছিলেন স্বরূপে। মাঝমাঠ থেকে যথোপযুক্ত সহায়তা পেলে ঠিকই জ্বলে উঠবেন তিনি। আর লেভানডফস্কিতে সওয়ার হয়ে পোল্যান্ড চমকে দিতে পারে বড় দলগুলোকেও।
-
নেতৃত্বের অভাব নেই কোনো পজিশনে। রক্ষণে কামিল গ্লিক, মাঝমাঠে ক্রিকোশিয়াক আর আক্রমণভাগে ব্লাশিকভস্কিদের উপস্থিতিতে হার না মানার এক মানসিকতা নিয়েই মাঠে নামে নাওয়ালকার দল। পিছিয়ে পড়েও ম্যাচ বের করে আনলে তাই অবাক হওয়ার অবকাশ থাকবে না খুব একটা।
দুর্বলতাঃ
-
অতিরিক্ত লেভানডফস্কি নির্ভরশীলতা।
-
ক্লাবে মৌসুম তেমন ভাল কাটেনি কারোই। ফর্মের বিবেচনায় তাই কিছুটা পিছিয়েই আছে তারা। এমনকি ক্লাব ফর্মের জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন লেভানডফস্কিও। প্রীতি ম্যাচগুলোতেও কিছুটা বোঝাপড়ার অভাব চোখে পড়েছে , দেখা মেলেনি বাছাইপর্বের উজ্জ্বল 'ঈগল'দের। রাশিয়ায় তাই কিছুটা ফর্মহীনতা সাথে নিয়ে মাঠে নামবেন তারা।
ভবিষ্যতবাণীঃ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে, ইংল্যান্ড বা বেলজিয়ামের কাছে হেরে বিদায়
কলম্বিয়া
ব্রাজিল বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় চমক খুব সম্ভবত ছিলেন তারাই। হামেস রদ্রিগেজে সওয়ার হয়ে স্বাগতিক ব্রাজিলের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছিল কোয়ার্টার থেকে। কিন্তু '১৪-এর কলম্বিয়ার খেলা এখনও স্মৃতিপটে তাজা অনেকেরই। ৪ বছর আগের সেই স্মৃতিকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েই রাশিয়া টিকেট পাকা করেছে 'লস ক্যাফেটেরোস'রা। কিন্তু সেজন্য বেশ ঘামই ঝরাতে হয়েছে তাদের। বাছাইপর্বে ৪র্থ হয়ে শেষমেশ জায়গা নিশ্চিত করেছেন হামেসরা। আরেকটু হলেই হয়ত দর্শক হয়েই কাটাতে হত এবারের আসরটি।
তার নাম শুনলেই ২০০৬ বিশ্বকাপের কথা মনে পড়ে যায়। আর্জেন্টিনাকে নিয়ে জার্মানির কাছে পেনাল্টিতে হেরে কোয়ার্টার থেকে বিদায়। সেদিন মেসিকে না নামানোর জন্য বেশ সমালোচনা সইতে হয়েছিল হোসে পেকারম্যানকে। কিন্তু গত ৬ বছরে কলম্বিয়ার হয়ে তার কোচিং ভূয়সী প্রশংসা করতেই হয়। তার অধীনেই '৯০-এর দশকের পর এবারই প্রথম টানা দুই বিশ্বকাপের মূলপর্বে এল কলম্বিয়া। লাতিন আমেরিকার শীর্ষসারির এক দলেই পরিণত করেছেন তাদের। এই বিশ্বকাপের অধিকাংশ কোচের মত তারও প্রিয় ফর্মেশন ৪-২-৩-১ এ দলকে খেলিয়ে আদায় করে নিচ্ছেন সর্বোচ্চটা। হামেস-ফালকাওদের পাশাপাশি পেকারম্যানের ট্যাকটিক্সের ওপরও অনেকটাই নির্ভর করছে কলম্বিয়ার বিশ্বকাপ ভাগ্য।
শক্তিঃ
-
অভিজ্ঞ তারকাদের অভাব নেই দলের কোনো পজিশনেই। বলতে গেলে মূল একাদশের অধিকাংশই খেলেন ইউরোপের শীর্ষ লিগগুলোতেই। দল হিসেবেও একসাথে খেলছে দীর্ঘদিন ধরেই। তাই বোঝাপড়া নিয়ে তেমন বেগ পেতে হবে না পেকারম্যানের দলকে।
-
এই বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা আক্রমণভাগ। মাঝমাঠে হামেস, কুয়াদ্রাদোদের সাথে ফরোয়ার্ড হিসেবে আছেন ফালকাও-মুরিয়েল-বাক্কারা। তাই আর যা হোক, গোলের জন্য খুব একটা হাপিত্যেশ করতে হবে না কলম্বিয়ানদের।
দুর্বলতাঃ
-
অনভিজ্ঞ রক্ষণভাগ। ডাভিনসন সানচেজ, ইয়েরি মিনাদের সামর্থ্য নিয়ে তেমন প্রশ্ন না থাকলেও বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা আক্ষরিক অর্থেই শূন্য। লাতিন আমেরিকা বাছাইপর্বে এবারের অন্যতম দূর্বল রক্ষণভাগ তাদের (১৮ ম্যাচে ১৯ গোল হজম)।
-
বড় দলগুলোর বিপক্ষে পারফরম্যান্স একেবারেই গড়পড়তা। ৪র্থ হয়ে সরাসরি বিশ্বকাপের টিকেট পেলেও ব্রাজিল,আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ের কাউকেই হারাতে পারেনি তারা।
ভবিষ্যতবাণীঃ রানার-আপ হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে, সেখান থেকে ইংল্যান্ড/বেলজিয়ামের কাছে হেরে বিদায়
সেনেগাল
বিশ্বকাপে সেনেগাল এর আগে খেলেছিল মাত্র একবার, ২০০২ সালে। কিন্তু সেবারই জন্ম দিয়েছিল রূপকথার। উরুগুয়ে, ফ্রান্সকে টপকে মাত্র দ্বিতীয় আফ্রিকান দল হিসেবে পৌঁছে গিয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালে। নিজেদের ইতিহাসে যেকোনো বিশ্বকাপে (অনুর্ধ্ব ২০, বিচ ফুটবল) অন্তত নকআউট পর্ব পর্যন্ত গিয়েছিল তেরেঙ্গার সিংহরা। এই রেকর্ডটি অক্ষুণ্ণ রাখার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েই রাশিয়া যাচ্ছে সেনেগাল।
২০০২ বিশ্বকাপের 'ডার্ক হর্স' সেনেগাল দলটির অধিনায়ক ছিলেন তিনিই। ২০১৫ সালে দায়িত্ব পান প্রিয় মাতৃভূমির। এর আগে কোথাও পূর্ণকালীন কোচের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা না থাকায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন তার। খেলোয়াড়দের অনুপ্রাণিত করেছেন স্মৃতি রোমন্থন করে, তার দল খেলেছে আফ্রিকা বাছাইপর্বের অন্যতম আকর্ষণীয় ফুটবল। আলিউ সিসের হাত ধরে অপরাজিত থেকেই রাশিয়ার টিকেট পাকা করেছে সেনেগাল। ৪-৩-৩ ফর্মেশনে সাজানো তার দলের আক্রমণাত্মক মনোভাব এবং ফুটবলে মজেছেন অনেকেই। সিসের অনুপ্রেরণা, সেনেগালের ইতিহাস এবং খেলার ধরণ- সব মিলিয়ে ২০০২-এর পুনরাবৃত্তি তো প্রত্যাশা করতেই পারেন সেনেগালবাসী।
শক্তিঃ
-
মাঝমাঠ এবং আক্রমণভাগের ফুটবলাররা আছেন দারুণ ফর্মে। সাদিও মানে, চেইকো কোয়াতে, ইদ্রিসা গায়েদের সবাই-ই ক্লাব মৌসুমেও ছিলেন স্বরূপে। আর দলের মধ্যে বোঝাপড়াও দারুণ। বাছাইপর্বে ৬ ম্যাচে ১৪ গোল তা-ই প্রমাণ করে। নকআউট পর্বে যাওয়ার রেকর্ড অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে মানেদের স্বভাবসুলভ খেলাটাই প্রত্যাশা করবে সেনেগাল।
-
জমাট রক্ষণ। বাছাইপর্বের ৬ ম্যাচে মাত্র ৩ গোল হজম করেছে তেরেঙ্গার সিংহরা। হামেস-লেভানডফস্কিদের রুখে দিতে কুলিবালি-সানেদের ওপরই মূল ভরসাটা রাখবেন কোচ সিসে।
দুর্বলতাঃ
-
অভিজ্ঞতার অভাব। স্কোয়াডের কেউই বিশ্বকাপ খেলেননি আগে, কোচ সিসেও ম্যানেজমেন্টে নতুনই বলা চলে। ওদিকে গ্রুপের বাকি তিন দলের প্রত্যেকেরই পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে বিশ্বকাপের। গ্রুপপর্ব থেকেই বাড়ি ফেরার প্লেন ধরলে অনভিজ্ঞতাই হবে সেনেগালের বিদায়ের অন্যতম কারণ।
-
ট্যাকটিক্যাল প্ল্যান 'বি'-এর অভাব। ৪-৩-৩ ছাড়া অন্য কোনো ফর্মেশনে দলকে খেলাননি সিসে। তাই সেনেগালকে কিছুটা অনুমেয়ই বলা চলে। সেক্ষেত্রে নতুন কোনো চাল দিয়ে প্রতিপক্ষকে চমকে দেওয়ার সম্ভাবনাটাও বাতিলের খাতায়ই ফেল যায় সেনেগালের।
ভবিষ্যতবাণীঃ এক ম্যাচ জিতে গ্রুপপর্ব থেকে বিদায়
জাপান
১৯৯৮ সাল থেকে বিশ্বকাপের মূলপর্বে এশিয়ার গর্বিত প্রতিনিধি সূর্যোদয়ের দেশটি। দক্ষিণ কোরিয়ার পর বিশ্বকাপে এশিয়ার সেরা পারফর্মার তারাই। শেষ ষোলতেও পৌঁছেছে দু'বার। কিন্তু ফুটবল নিয়ে এখন আর তেমন উৎসাহের ছড়াছড়ি দেখা যায়না জাপানিজদের মাঝে। মূলপর্বে পৌঁছালেও একাধিক গড়পড়তা পারফরম্যান্সের কারণে সমর্থকদের মন ভরাতে পারেনি জাপানিজরা। সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েই এবার রাশিয়া যাচ্ছে তারা।
বিশ্বকাপের মাত্র মাস দুয়েক আগেই হুট করে ভাহিদ হালিহদজিচকে হটিয়ে তাকে হটসিটে বসিয়ে দেয় জাপানের ফুটবল ফেডারেশন। দলটাকেও গড়ার সময় পাননি তেমন। তবে আকিরা নিশিনোতে ভরসা রাখছে জাপান। স্বদেশী ক্লাবগুলোতে কোচিংয়ের পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় তাই তার হাত ধরেই নিজেদের ফুটবলের পুনরোত্থান দেখার স্বপ্নে বিভোর সমগ্র জাপান।
শক্তিঃ
-
স্বর্ণযুগের প্রায় সবাই-ই সেরা সময়টা পিছনে ফেলে আসলেও এই অভিজ্ঞতাই হতে পারে জাপানের দ্বিতীয় রাউন্ডের যাওয়ার টোটকা। হোণ্ডা-এনডো-কাগাওয়াদের সবারই আছে বিশ্বকাপে খেলার পূর্ব অভিজ্ঞতা।
-
পজেশন ফুটবল জাপানের অন্যতম বড় অস্ত্র। বাছাইপর্বের দুই রাউন্ডেই পজেশন ভিত্তিক ফুটবল দিয়েই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করেছিল তারা। কোচের পরিবর্তন হলেও রাশিয়ায় জাপানের পজেশনভিত্তিক ফুটবল দেখার সম্ভাবনাই বেশি।
দুর্বলতাঃ
-
নতুন কোচের দর্শনে এখনও মানিয়ে নিতে পারেনি জাপান। মূলপর্বের প্রস্তুতিটা ঠিক হয়ে উঠেনি জাপানের।
-
গোলের অভাব। বাছাইপর্বে আরব আমিরাত-সৌদি আরবের মত দলগুলোর বিপক্ষেও ম্যাচপ্রতি মাত্র প্রায় ২ গোল করতে পেরেছিল জাপান। পোল্যান্ড, কলম্বিয়ার বিপক্ষে তাই এমন নিতান্তই সাধারণ গোছের আক্রমণ নিয়ে বেশ বিপাকেই পড়তে হতে পারে জাপানকে।
ভবিষ্যতবাণীঃ কোনো ম্যাচ না জিতেই গ্রুপপর্ব থেকে বিদায়