• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    'গ্রাসিয়েলায় চেপে, হারকিউলিসে চড়ে' : যে ডি মারিয়াকে আপনি চেনেন না

    'গ্রাসিয়েলায় চেপে, হারকিউলিসে চড়ে' : যে ডি মারিয়াকে আপনি চেনেন না    

    অ্যানহেল ডি মারিয়া তার ক্যারিয়ারে যতটা না প্রশংসা পেয়েছেন, সমালোচনাও কম কিছু পাননি। তবে দ্য প্লেয়ারস ট্রিবিউনে প্রকাশিত লেখার পর তার প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে নিশ্চিতভাবেই


    রিয়াল মাদ্রিদের চিঠিটা এলো ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের সকালে, এগারটার সময়।  

    কোয়ার্টার ফাইনালে চোট পাওয়া পায়ে ইনজেকশন নিতে বসে আছি। দৌড়াতে গেলে পেইনকিলার লাগে, আবার কিছুই টের পাই না। ট্রেনারকে শুধু বলেছিলাম, “সব চুরমার হয়ে যাক। আমার কিছু যায় আসবে না। আমি শুধু খেলতে চাই।” 

    পায়ে বরফ দিচ্ছি, টিম চিকিৎসক ড্যানিয়েল মার্টিনেজ ঘরে ঢুকল খামটা হাতে। আমি খেলার কন্ডিশনে নেই, এটা বলে তারা আমাকে খেলতে বাধা দিতে চাচ্ছে আজ। 

    ব্যাপারটা কী, বুঝতে সময় লাগেনি। তার আগে থেকেই গুজবটা কানে এসেছিল। রিয়াল বিশ্বকাপের পর হামেস রদ্রিগেজকে কিনতে চায়, তাকে জায়গা করে দিতে আমাকে বিক্রি করে দিবে। আমি তখন তাদের কাছে মূল্যবান পণ্য, সেটার ক্ষতি হোক, তারা চায় না। হিসাবটা সহজ। তবে ফুটবলের এই ব্যবসার দিকটা লোকে সবসময় দেখতে পায় না। 

    ড্যানিয়েলের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে আমি ছিঁড়ে ফেললাম। খুলেও দেখিনি।

    আগের রাতে তেমন ঘুম হয়নি। হোটেলের বাইরে ব্রাজিলিয়ান সমর্থকদের অনেক রাত পর্যন্ত চলা আতশবাজি না থাকলেও যে আমি ঘুমাতে পারতাম, তা নয়। বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের রাতের মানসিক অবস্থাটা ঠিক ব্যাখ্যা করে বুঝানো কঠিন। এতোদিনের স্বপ্ন চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন! 

    সেদিন আমার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারতো, তবুও আমি খেলতে চেয়েছিলাম। আবার দলের হিসাবনিকাশ জটিল হয়ে উঠুক, সেটাও চাইনি। সকালে উঠেই ম্যানেজার সাবেলার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তার সঙ্গে সম্পর্কটা বেশ ভাল ছিল। তাকে যদি একবার বলতাম, আমি খেলতে চাই, নিশ্চিতভাবেই আমাকে দলে নেওয়ার একটা চাপ থাকতো তার ওপর। তবে বুকে হাত দিয়ে আমি বলেছিলাম, সবচেয়ে যোগ্য খেলোয়াড়টিকেই যাতে তিনি নামান। সেটা আমি হলে আমি, নাহলে অন্য কেউ। আমি শুধু বিশ্বকাপটা জিততে চাই। আর সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার আগমুহুর্তেও যদি আমাকে ডাকা হয়, আমি নেমে যাব। 

    নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি এরপর। কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম। 

    ম্যাচের আগে মিটিংয়ে সাবেলা জানালেন, এনজো পেরেজ খেলবে শুরু থেকে। আমার তাতে কোনোই আপত্তি ছিল না। ম্যাচের আগে একটা ইনজেকশন নিয়েছিলাম, হাফটাইমেও নিয়েছিলাম আরেকটা। যদি ডাক পড়ে! 

    সেই ডাকটা আসেনি। আমরা বিশ্বকাপ হেরে গেছি। আমি কিছুই করতে পারিনি। জীবনের সবচেয়ে কঠিন দিন ছিল সেটা। ম্যাচের পর আমার না খেলা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কথা উঠেছিল। তবে সত্যটা আমি জানি, এখন যেটা বলছি।

    অবশ্য সাবেলার সঙ্গে কথা বলার সেই মুহুর্তটা আমাকে তাড়া করে ফেরে। তার সামনে কান্নার সেই দৃশ্যটা তাড়া করে। আমার সবসময়ই একটা অস্বস্তি আছে, সাবেলা আবার এমন ভেবে বসেছেন কিনা- আমি নার্ভাস বলেই কেঁদেছি!

    সত্যি বলতে, স্নায়ুচাপের কোনো ব্যাপারই ছিল না। সেই মুহুর্তটার ভারেই আবেগে ভেঙে পড়েছিলাম। সেই অসম্ভব স্বপ্নটা পূরণ করার কতো কাছাকাছি ছিলাম আমরা। 

    ****

    বাড়ির দেয়ালের রঙটা শুরুতে হয়তো ধবধবে সাদাই ছিল আমাদের। তবে আমি সেটা মনে করতে পারি না। যেটা মনে পড়ে, শুরুতে ধূসর ছিল। এরপর নিকষ কালো হয়ে গেল- কয়লার ধূলে। আমার বাবা কয়লা শ্রমিক ছিলেন, ঠিক খনিশ্রমিক নয় অবশ্য। আমাদের বাড়ির পেছনের দিকটায় তিনি কয়লা থেকে চারকোল বানাতেন। কখনও চারকোল বানানো দেখেছেন? বার-বি-কিউয়ের জন্য যে ছোট ব্যাগগুলো কেনেন, সেই চারকোলগুলো? সেগুলো যেখান থেকে আসে, সেই প্রক্রিয়াটা কিন্তু বেশ অপরিচ্ছন্ন। 

    টিনের চালের নিচে তিনি কাজ করতেন। চারকোলের প্যাকেট তৈরির কাজ। ক্ষুদে সহায়তাকারী ছিল অবশ্য। স্কুলের আগে আমি আর আমার বোন বাবাকে সাহায্য করতাম। আমাদের তখন কতো বয়স, নয়-দশ। যে বয়সে চারকোলের প্যাকেট বানানোর কাজকেও খেলা বানিয়ে ফেলা যায়! কয়লার ট্রাক এলে আমরা ব্যাগগুলো লিভিংরুমের ভেতর দিয়ে বাসার সামনে নিয়ে যেতাম। বাড়ির রঙটা কালো হতে লাগলো এভাবেই। 

    তবে সেই কালো রঙের বিনিময়ে আমাদের টেবিলে খাবার থাকতো। সেই কালো রঙ দিয়েই বাবা আমাদের বাড়িটা বাঁচিয়েছিলেন। একদম যখন বাচ্চা-শিশু আমি, বাবা-মার অবস্থা ভালই ছিল। বাবা একজনের একটু ভাল করতে গিয়েই ফেঁসে গেলেন। 

    বাবার এক বন্ধু তার বাড়ির “নিশ্চয়তাকারী” হতে বলেছিলেন। বাবা বিশ্বাস করেছিলেন তাকে। লোকটা টাকা শোধ না করেই একদিন হাওয়া হয়ে গেল। ব্যাংক এল বাবার কাছে। একটার জায়গায় তার মাথায় চাপল দুইটা বাড়ির বোঝা, পরিবারের ভরণ-পোষণ তো আছেই। 

    চারকোল অবশ্য তার প্রথম ব্যবসা ছিল না। বাড়ির সামনের ঘরটাকে তিনি একটা ছোট দোকান বানানোর চেষ্টা করেছিলেন। ব্লিচ, ক্লোরিন, সাবানের মতো দ্রব্যগুলোর বড় বড় ড্রাম কিনতেন তিনি, এরপর ছোট বোতলে পুরে বিক্রি করতেন আমাদের ডাইনিং রুমের বাইরে বসে। আমাদের শহরে থাকলে আপনিও এসব কিনতে বড় দোকানে যেতেন না, সেগুলোতে অনেক টাকা খসে যেত আপনার। ডি মারিয়াদের কাছে আসলেই আপনি সাশ্রয়ী মূল্যে একটা বোতল পেয়ে যেতেন আমার মায়ের কাছে। 

    ঠিকঠাকই ছিল সব। সব এলোমেলো হয়ে গেলে তাদের পিচ্চি ছেলেটার কারণে। একদিন মরতে ধরলো সে।

    আসলেই, আমি আস্ত একটা হারামি ছিলাম। 

    খুব খারাপ ছিলাম না, তবে আমার প্রাণশক্তি একটু বেশিই ছিল। অনেক বেশি অস্থিরচিত্তের ছিলাম। মা একদিন দোকানে বিক্রি-বাট্টায় ব্যস্ত, আমি খেলছি। সদর দরজা খোলা, সেটা দিয়ে ক্রেতারা আসতো। আমি হাঁটতে হাঁটতে দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছি। 

    কখন যেন রাস্তার মাঝে এসে পড়লাম। মা ছুটে এসে সরিয়ে না দিলে একটা গাড়ি প্রায় ধাক্কাই দিয়ে যেতো সেদিন। এই কাহিনীটাই অবশ্য মা বললে অনেক বেশি নাটকীয় শোনাবে। ডি মারিয়াদের ক্লিনিং শপের সেটাই ছিল শেষদিন। মা তার বাচ্চার জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চাননি। 

    বাবা তখন কয়লার ট্রাকের সন্ধান পেলেন। সান্তিয়াগো দেল এসতেরো থেকে আসতো সে ট্রাক, কয়লা বোঝাই হয়ে। মজার বিষয়, কয়লা কিনে সেটা প্রক্রিয়াজাত করার মতো আর্থিক মূলধনও ছিল না আমাদের। প্রথম কয়েকটি চালান বাবা কিস্তিতে নিলেন। এরপর থেকে আমি বা আমার বোন ক্যান্ডি বা কিছু চাইলেই বাবা মনে করিয়ে দিতেন, “আমাকে দুইটা বাড়ির সঙ্গে এক ট্রাক কয়লার খরচ দিতে হচ্ছে!”

    সেদিন খুব বৃষ্টি, সঙ্গে হিমশীত। বাবার সঙ্গে আমরা চারকোলের প্যাকেট বানাচ্ছি। মাথার ওপর শুধু ফিনফিনে একটা টিনের চাল। কয়েক ঘন্টা পর স্কুলে গিয়ে বাঁচলাম যেন আমি। তবে সেই শীতে বাবাকে কাজ করতে হয়েছিল দিনভর। তার সেদিনের বিক্রির ওপর আমাদের খাওয়ার বন্দোবস্ত নির্ভর করছিল। আমি তখনও বিশ্বাস করতাম, কোনও একদিন সবকিছু বদলে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। 

    ফুটবলের কাছে আমার ঋণটা সে কারণেই। 

    মাঝে মাঝে হারামি হওয়াটা কাজে দেয়, বুঝলেন! ফুটবল শুরু করেছিলাম বেশ আগে। 

    দৌড়াদৌড়ি করে মাকে পাগল বানিয়ে ছাড়তাম। সহ্য করতে না পেরে মা একদিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন আমাকে। 

    “এ তো দৌড়ানো থামায়ই না, কী করি বলেন তো?”

    ডাক্তারটা ভাল ছিল, আর্জেন্টাইন ডাক্তার হলে যা হয়। “কী করবেন? ফুটবল খেলতে লাগিয়ে দিন।” 

    ****

    আমার ফুটবল শুরু হলো। 

    আমি ফুটবলে মেতে উঠলাম। এতো বেশি খেলতাম, দুই মাস অন্তর আমার বুট রীতিমতো টুকরো টুকরো হয়ে যেতো। মা সেগুলো আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিতেন, নতুন কেনার সামর্থ্য তো ছিল না। সাত বছর বয়সে আমি আমার পাড়ার ক্লাবের হয়ে ৬৪টি গোল করেছিলাম, বেশ ভালই ছিলাম বলতে হবে। মা একদিন এসে জানালেন, স্থানীয় রেডিও স্টেশন আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। 

    সাক্ষাতকার দিতে আমরা স্টেশনে গেলাম। এতো বেশি লাজুক ছিলাম, কথাই বলতে পারিনি প্রায়। 

     

     

    সে বছরই রোজারিও সেন্ট্রালের যুব কোচের ফোন পেলেন বাবা। তারা আমাকে নিতে চায়। ব্যাপারটা বেশ জমে উঠলো। বাবা ছিলে নিউয়েলস ওল্ড বয়েজের সমর্থক, মা সেন্ট্রালের। রোজারিওর কেউ না হলে তাকে আসলে এই মজাটা বুঝানো কঠিন। দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা আসলেই অন্য পর্যায়ের ছিল, জীবন-মরণের ব্যাপার রীতিমতো। দুই দলের ‘ক্ল্যাসিক’ এর সময় বাবা-মা পাগল হয়ে যেতেন প্রায়। গোলের পর গলা ফেটে চিৎকার করতেন। যে জিতবে, মাসভর আরেকজনকে বিদ্রুপ করে যাবে সে।

     

    সেই সেন্ট্রাল থেকে আমার ডাক আসায় মা কতোটা রোমাঞ্চিত ছিলেন, সেটা ভেবেই নিন না! 

    বাবা গাঁইগুঁই শুরু করলেন। বেশ দূরে, নয় কিলোমিটার দূরে, আমাদের গাড়ি নেই, কিভাবে আমাকে নিয়ে যাবেন- অনেক কিছু। 

    মা-ও নাছোড়বান্দা। আমাকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটা তিনি নিলেন। 

    ****

     

     

    গ্রাসিয়েলা এল। 

    গ্রাসিয়েলা- একটা পুরোনো বিবর্ণ জংধরা বাইসাইকেল। মা আমাকে এটাতে করেই নিয়ে যেতেন অনুশীলনে। সামনে একটা ঝুড়ি, পেছনে আরেকজনের বসার জায়গা। তবে একটা ঝামেলা হয়ে গেল। ছোট বোনকে তো ফেলে যাওয়া যায়না। সমাধান দিলেন বাবা। সাইকেলের একপাশে ছোট্ট কাঠের একটা মাচা বানিয়ে দিলেন। আমার বোন সেখানেই বসতো। 

    সাইকেলের পেছনে ছোট একটা ছেলে, পাশে একটা মেয়ে। সামনের ঝুড়িতে কিটব্যাগ, বুট, আর হালকা কিছু খাবার। চালক একজন মহিলা। তিনি চলেছেন পাহাড় ভেঙে, ঢাল বেয়ে। প্রতিকূল পরিবেশে। বৃষ্টিতে। অন্ধকারে। কোনও কিছুই আটকাতে পারতো না তাকে। আমার মা শুধু পেডেল চালাতেন। 

    গ্রাসিয়েলা আমাদের সবখানে নিয়ে যেত। 

    তবে সেন্ট্রালে আমার দিনগুলি সহজ ছিল না মোটেই। মানিয়ে নিতে না পারলে হয়তো ফুটবল ছেড়েই দিতাম। একাধিকবার হয়েছিল এমন। বয়স ১৫ হয়ে গেছে, অথচ আমি বেড়ে উঠছি না উচ্চতায়। একজন কোচ ছিলেন আমাদের, একটু পাগলাটে ধরনের। শারীরিক দিক দিয়ে শক্ত-সমর্থ, আক্রমণাত্মক ফুটবলার ছাড়া আর কাউকে দেখতে পারতেন না। সেটা একেবারেই আমার ঘরানার বাইরে। বক্সের ভেতর একটা হেড দিতে একদিন আমি লাফিয়ে উঠিনি, কোচ আমাকে পেয়ে বসলেন। 

    অনুশীলনের পর গালিগালাজ শুরু হয়ে গেল। আমি মুষড়ে গেলাম। কথা শেষ হওয়ার আগেই কান্নায় ভেঙে পড়লাম, সবার সামনেই। মাঠ থেকে ছুটে বেড়িয়ে এসেছিলাম। 

    বাড়ি এসে সোজা আমার ঘরে, একা একা কাঁদছি। মা বুঝলেন, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। নাহয় অন্যদিনের মতো ফিরে এসেও রাস্তায় খেলতে গেলাম না কেন আমি! ভয়ে কিছু বলতে পারলাম না তাকে। আমাকে কিছু বলবেন, সেটা না। আশঙ্কা ছিল, সত্যিটা জানলে তিনি তখনোই বাইকে করে সেখানে ছুটে গিয়ে কোচকে মেরেই বসবেন। এমনিতে শান্তশিষ্ট মানুষ, তবে তার বাচ্চাকে কিছু বললে নিশ্চিতভাবেই খবর আছে! 

    মাকে বললাম, মারামারি করেছি। মা মিথ্যাটা ধরতে পারলেন। সত্যিটা জানতে ডেকে পাঠালেন আমার সঙ্গে খেলে এমন একটা ছেলেকে। 

    আমি কেঁদে-কেটে শুধু ফুটবল ছেড়ে দেওয়া কথা বলছিলাম। পরদিন ঘর থেকে বেরুতে ইচ্ছা করছিল না, স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছাও উবে গেল। শিয়রের পাশে মা এসে বসলেন। আমাকে যে প্রমাণ করতে হবে অনেককিছু! 

    সেদিন অনুশীলনে ফিরলাম। আশ্চর্য কান্ড। কেউ আমার সঙ্গে ফাজলামো করে না, সবাই সাহায্য করে। উঁচুতে বল, ডিফেন্ডাররা আমাকে হেড করতে দিল। আমার ভাল লাগার জন্য কতকিছু করলো তারা! ফুটবলে এতো প্রতিদ্বন্দ্বীতা, দক্ষিণ আমেরিকায় তো আরও বেশি। সবার কাছে জীবনটা আরেকটু ভাল করার মাধ্যম ফুটবল। সেদিন তার ব্যতিক্রম হয়েছিল।  সেদিনের কথা আমার সবসময় মনে থাকবে। আমার সংগ্রামে সেদিন আমার বন্ধুরা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। 

    তবে আমি বেঁটে আর পাতলা ফিনফিনে রয়ে গেলাম। ১৬ বছর হয়ে গেলেও সেন্ট্রালের সিনিয়র দলে জায়গা হয়নি। বাবার দুশ্চিন্তা বাড়ছিল। একদিন খেতে বসে বাবা বললেন, “তোমার হাতে তিনটি রাস্তা। আমার সঙ্গে কাজে ফিরে যেতে পারো। পড়াশুনার পাট চুকাতে পারো। অথবা আরেক বছর ফুটবলে চেষ্টা করে দেখতে পারো। কিন্তু এই এক বছরে কিছু না হলে আমার সঙ্গে কাজে যোগ দেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই তোমার।” 

    মা শেষ অপশনটা বেছে নিয়েছিলেন। 

    তখন জানুয়ারি। 

    ডিসেম্বরে প্রিমেরা ডিভিশনে সেন্ট্রালের হয়ে আমার অভিষেক হয়ে গেল। 

    আমার খেলাধুলার ক্যারিয়ারটারও শুরু সেদিন থেকেই। লড়াইটা অবশ্য পুরোনো, অনেক আগেই শুরু হয়েছিল সেটা। সেই আঠা দিয়ে জুতা সারানো, বৃষ্টিতে ভিজে গ্রাসিয়েলিয়ায় চেপে দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার সময় থেকেই। আর্জেন্টিনায় অবশ্য পেশাদার ক্যারিয়ার শুরুর পরও লড়াই শেষ হয় না। দক্ষিণ আমেরিকার বাইরের কাউকে এটা বুঝানোও শক্ত। চাক্ষুস না দেখলে কি সব বিশ্বাস হয়! 

    ****

    কলম্বিয়ায় ন্যাসিওনালের বিপক্ষে লিবার্তাদোরেসের সেই ম্যাচটা যেমন। 

    প্রিমিয়ার লিগ বা লা লিগার মতো ভ্রমণের ব্যবস্থা ছিল না আমাদের। এমনকি বুয়েন্স এইরেসের মতোও নয়। রোসারিওতে তখন কোনও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নেই। ছোট্ট বিমানবন্দরে যে বিমানটাই সামনে পড়ুক, কোনও কথা না বলে তাতে চেপে বসতে হত। 

    কলম্বিয়াতে যাওয়ার সময়ও সেটাই হয়েছিল। রানওয়েতে বিশাল এক কার্গো বিমান। পেছনে ঢালু বড় তক্তা থাকে, গাড়িটাড়ি বয়ে নিয়ে যায়- এমন বিমান। মনে আছে, বিমানটার নাম ছিল হারকিউলিস। 

    তক্তা বেয়ে জিনিসপত্র তোলা হলো। 

    অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিলাম আমরা। ভাবখানা এমন, “আসলেই?” 

    বিমানে উঠলাম। শ্রমিকরা আমাদের পেছন দিকে পাঠিয়ে দিলেন। আর ধরিয়ে দিলেন হেডফোন। মিলিটারি হেডফোন। 

    কড়া শব্দ থেকে সেগুলো আমাদের বাঁচাবে। প্লাটফর্মের মতো একটা জায়গায় উঠলাম। কিছু সিট, আর কিছু মাদুর পাতা বসার জন্য। আট ঘন্টা থাকতে হয়েছিল এভাবেই, একটা লিবার্তাদোরেস ম্যাচের জন্য। পেছনের ঢালু তক্তা তুলে ফেলা হলো, আর ভেতরে নেমে এল ঘুটঘুটে অন্ধকার। হেডফোন কানে মাদুরের ওপর শুয়ে আমরা। একজনের কথা আরেকজন শুনতে পাই না। বিমান টেক-অফ করা শুরু করলো, আমরা একটু একটু করে গড়াতে লাগলাম, গড়িয়ে গড়িয়ে একেবারে বিমানের পেছন পর্যন্ত। এক সতীর্থ চিৎকার করে উঠলো, “লাল বোতামটা কেউ চাপবে না। ওই দরজা খুলে গেলেই আমাদের কেল্লাফতে কিন্তু!” 

    অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা। সে অভিজ্ঞতা না হলে আপনার বিশ্বাসই হতে চাইবে না! তবে আমাদের সেই দলের যে কাউকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন। আমাদের দলের ‘ব্যক্তিগত বিমান’- হারকিউলিস! 

    তবুও, ফিরে তাকালে আমার ভাল লাগে। আর্জেন্টিনায় ফুটবল নিয়ে থাকতে হলে আপনাকে যে কতো কিছু করতে হবে! যে বিমানই সামনে আসুক, কিছু না ভেবেই চড়ে বসতে হবে। 

    আর যদি আদতেই সুযোগ মেলে, তাহলে একতরফা বিমানের টিকেট ধরতে হবে। যেখানে যাওয়া যায়, যেখান থেকে ফেরা যায় না। পর্তুগাল, বেনফিকা আমার আমার জন্য এমন ছিল। অনেকেই আমার ক্যারিয়ারের দিকে চেয়ে বলবেন, “বাহ, প্রথমে বেনফিকা গেল, এরপর রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, পিএসজি।” কতো সহজ! হয়তো ব্যাপারটা এমনই মনে হয়। তবে এর মাঝে কতকিছু হয়ে গেছে, কতকিছু হয়ে যায়! বেনফিকায় গিয়েছিলাম ১৯ বছর বয়সে। টেনেটুনে খেলেছিলাম দুই মৌসুমের মতো। পর্তুগালে আমার সঙ্গে থাকবেন বলে বাবা চাকরি ছেড়ে এসেছিলেন, মায়ের কাছ থেকে এক সমুদ্র দূরে। মাঝে মাঝে রাতে তাকে ফোনে কাঁদতে শুনতাম, মাকে কতোটা মিস করতেন তিনি! 

    আর তখনোই মনে হতো, কী ভুলটাই না করেছি! প্রথম একাদশে জায়গা পাই না। সব ছেড়েছুড়ে বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছা করতো। 

    সবকিছু বদলে দিল ২০০৮ সালের অলিম্পিক। বেনফিকার একাদশে তখনও ঠাঁই মেলে না আমার, অথচ আর্জেন্টিনায় ডাক পেয়ে গেলাম। কী অদ্ভুত! এই টুর্নামেন্টই আমাকে লিওনেল মেসির সঙ্গে খেলার সুযোগ দিয়েছিল। অতিপ্রাকৃত, জিনিয়াস মেসির সঙ্গে। ফুটবলটা সবচেয়ে উপভোগ করেছিলাম তখন। আমার শুধু ফাঁকা জায়গা দেখে দৌড় দিতে হতো, বল আমার পায়ে চলে আসতো। ঠিক জাদুর মতো!

     

     

    আপনার-আমার মতো করে লিওর চোখজোড়া কাজ করে না। মানুষের মতো এপাশ-ওপাশ করেই তাকায় অবশ্য। তবে সে ওপর থেকেও যেন দেখতে পায়, পাখির মতো। কিভাবে, আমি জানি না। 

    ফাইনালে গেলাম। আমাদের জীবনে সবচেয়ে সুন্দর দিন ছিল এটা। আর্জেন্টিনার হয়ে গোল করে স্বর্ণপদক জেতা- আমার এই অনুভূতিটা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। 

    একবার চিন্তা করুন। আমার বয়স বিশের মতো, বেনফিকার হয়েও খেলতে পারছি না। আমার পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে আমার জন্য। আর্জেন্টিনা থেকে ডাক পড়ার আগে আমি অসহায় হয়ে পড়েছি। দুই বছরের মাথায় আমি অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জিতলাম, বেনফিকার হয়ে খেলা শুরু করলাম, এরপর রিয়াল মাদ্রিদে চলে এলাম! 

    শুধু আমার জন্য নয়, আমার পুরো পরিবার, এতদিন যেসব বন্ধু ও সতীর্থ আমাকে সহায়তা করে গেছে- সবার জন্যই গর্বের ব্যাপার ছিল সেটা। আমার বাবা নাকি আমার চেয়ে ভাল ফুটবলার ছিলেন। পা ভেঙে ফেলেছিলেন উঠতি বয়সে, স্বপ্নটাও মুখ থুবড়ে পড়েছিল। বাবার চেয়ে নাকি আরও ভাল ছিলেন আমার দাদা। ট্রেন দূর্ঘটনায় তার পায়ের সঙ্গে স্বপ্নটাও কাটা পড়েছিল। 

    আর আমার স্বপ্ন মরে যাওয়ার কাছাকাছি গিয়েছিল বেশ কয়েকবার। সেটা যায়নি। 

    কারণ, সেই ফিনফিনে চালের নিচে বাবা কাজ করে গেছেন। মা পেডেল চালিয়ে গেছেন। আর আমি ফাঁকা জায়গা দেখে দৌড়িয়েছি শুধু। 

    আমি জানি না, আপনারা নিয়তি বিশ্বাস করেন কিনা। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে প্রথম গোলটা যে ক্লাবের বিপক্ষে করেছিলাম, তার নাম জানেন? 

    হারকিউলিস এফসি। 

    কতো পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা! 

    ****

    এখন হয়তো বুঝবেন, কেন বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন আমি সাবেলার সামনে কেঁদে দিয়েছিলাম। ক্যারিয়ার নিয়ে আমার চিন্তা ছিল না। সেই ম্যাচে শুরু থেকেই খেলব কিনা, সেটা নিয়েও চিন্তা ছিল না আমার। 

    আমি শুধু আমাদের সেই স্বপ্নটা ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলাম। দেশের মানুষ আমাদের মনে রাখুক, আমরা এটা চেয়েছিলাম। সেই স্বপ্নের কতোটা কাছ থেকে ফিরে এসেছি আমরা! 

    আর্জেন্টিনাকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কড়া সব কথা দেখলে তাই আমার খারাপ লাগে। এতো বেশি নেতিবাচক মনোভাব, এতো বেশি সমালোচনা। সীমার বাইরে চলে যায় সব। এটা ঠিক নয়। আমরা সবাই তো মানুষ। আমাদের জীবনে কতো কিছু ঘটে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে! 

    বাছাইপর্বের কয়েকদিন আগেই তো আমি মনোরোগ বিশেষজ্ঞর কাছে গিয়েছিলাম। কঠিন সময়ে আমার পরিবারই সব কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতো। তবে সেবার চাপ এতো বেশি ছিল জাতীয় দলকে ঘিরে। আমার আর উপায় ছিল না। শেষ দুইটা ম্যাচে আমি হারিয়েছিলামই বেশি। তবে সব মেনে নিতে পেরেছিলাম শান্তভাবেই। 

    নিজেকে মনে করিয়ে দিয়েছি, বিশ্বের সেরা একটা দলের অংশ আমি। আমার দেশের জন্য খেলছি। ছোট থাকতে যে স্বপ্নটা দেখতাম, সেই স্বপ্নের জগতে আমি। পেশাদার হয়ে আমরা অনেক সময়ই এই সহজ অথচ বিশাল ব্যাপারগুলো ভুলে যাই। 

    খেলাটা এরপর নিছকই খেলা উঠেছিল আমার কাছে আবার। 

    এখনকার দিনে, লোকে ইনস্টাগ্রাম বা ইউটিউবে শুধু  প্রতিক্রিয়া দেখে। এর পেছনের ত্যাগটা দেখে না, মূল্যটা বোঝে না। এই দীর্ঘ পথের ভ্রমণটা তারা জানে না। মেয়েকে আঁকড়ে ধরে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি হাতে আমার হাস্যোজ্জ্বল ছবিটা দেখে আর ভাবে- সব ঠিকঠাক। কিন্তু তারা জানে না, এই ছবিটার বছরখানেক আগেই মেয়েটা আমার অপরিণত অবস্থায় জন্মেছিল, দুই মাস তার আর নলের জঞ্জালের ভেতর হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল তাকে।  

     

     

    তারা বোধহয় ট্রফি হাতে আমার কান্নার ছবিটা দেখে ভাবে, আমি ফুটবলের জন্য কাঁদছি। আসলে তো সেটা নয়। আমি আমার মেয়েকে এই দারুণ মুহুর্তটা উপহার দিতে পেরে কাঁদছি! 

     

     

    বিশ্বকাপ ফাইনালে শুধু ০-১ এর ফলটাই দেখতে পায় তারা। 

    কিন্তু এর আগের কঠিন সময়ের লড়াইটা তারা দেখে না। 

    তারা জানে না, আমাদের লিভিং রুমের দেয়াল কিভাবে সাদা থেকে কালো হয়ে গেল। 

    একটা ফিনফিনে চালের নিচে বৃষ্টি আর শীতে কাজ করা আমার বাবাকে তারা জানে না।  

    তারা গ্রাসিয়েলা চালানো আমার মাকে দেখেনি। সেই শীতে তার বাচ্চাদের নিয়ে যেতে দেখেনি।

    তারা হারকিউলিসের কথা জানে না।