• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    আইসক্রিম গোল আর স্বপ্ন-কারাগার থেকে মুক্তি : এডিনসন কাভানি

    আইসক্রিম গোল আর স্বপ্ন-কারাগার থেকে মুক্তি : এডিনসন কাভানি    

    এডিনসন কাভানি, এই বিশ্বকাপেও উরুগুয়ের অন্যতম নায়ক। নয় বছরের ছোট্ট কাভানিকে তিনি চিঠি লিখেছেন, দ্য প্লেয়ারস ট্রিবিউনে


    এডিনসন, 

    প্রতিবেশীরা যাকে পেলাডো- “বেলমাথা” বলতো, তুমিই তো সেই নয় বছরের বাচ্চাটা? 

    সেই নেড়া মাথার বাচ্চাটা। 

    ছোট থাকতে তোমার মাথায় চুল প্রায় ছিলই না বলতে গেলে। কতো সময় নিয়ে গজাচ্ছিল চুল! কী লজ্জার কথা! আবার দেখো, তোমার কিছু করারও ছিল না। তোমার পরিবার তোমাকে সবসময়ই ওই নেড়া মাথার পেলাডোই বানিয়ে রাখতো তাই। তাদেরকে একটা ধন্যবাদ দেওয়াই যায় এই সৃষ্টিশীলতার জন্য! 

    বলতে ভাল লাগছে, আগামী ২০ বছরে ফুটবল তোমার জীবনটা বদলে দেবে। কিছু ভাল হবে, কিছু ততোটা ভাল হবে না। তবে ফুটবলই তোমার ওই পেলাডো নামটা ঘুচিয়ে দেবে জানো! একটা লোক ছিল, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা নাম। তুমি এখনও তাকে চেনো না। টিভিতে বলতে গেলে তো শুধু টম এন্ড জেরিই দেখো তুমি। তোমার যে বড় ভাই, নান্দো, সেই প্রথম বাতিস্তুতাকে দেখে মজে থাকবে। নরসুন্দরের কাছে যেতে চাইবে না। মায়ের কন্ডিশনার চুলে দেবে। আর তারপর, দেখতে ঠিক বাতিস্তুতার মতো অসাধারণ হবে। আর যখন ফুটবল মাঠে দৌড়াবে, মাথার চুল জুতার ফিতে দিয়ে বাঁধা- আহা, তোমার ভাইয়ের চেয়ে “কুল” আর কে আছে বলো! 

    এরপর তুমি একদিন সাহস করে মাকে বলবে, আর চুল কাটাবে না! তোমার জীবনটা কাটে তো ঘরের বাইরেই, পায়ে শুধু একটা বল থাকে। দক্ষিণ আমেরিকায় তো এমনই হয়। তুমিই বা আলাদা কেন হতে যাবে! কিন্তু ঘরের ভেতরে? কী আছে সেখানে? মজার কিছুই নেই। কোনও প্লেস্টেশন নেই, বড় টেলিভিশন নেই। এমনকি হট-শাওয়ার বলতেও কিছু নেই! শীত থেকে রেহাই পেতে তোমার আছে শুধু চারটা ওমধরানো কম্বল। সেই ঠান্ডায় গোসল করতে তুমি কেরোসিন চুলায় পানি বসিয়ে দাও। কম্বল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকো সেই চুলার সামনে, যেন একজন আলকেমিস্ট! 

    তোমার কাছে তো এটাই বিলাসিতা। আচ্ছা, প্রথম বাড়িটার কথা মনে পড়ে? সেই যে, যেটায় কোনও বাথরুম ছিল না? কাজ সারতে হলে হেঁটে বাইরের সেই খুপড়িতে যেতে হতো? 

    চুপিচুপি একটা কথা বলি এই সুযোগে। সেইসব স্মৃতি যখন আমার সামনে ভেসে ওঠে, আমার মোটেই খারাপ লাগে না বুঝলে। আমার বরং কেমন একটা উষ্ণ ভাব হয়। আমি সাহস পাই। দারুণ একটা স্মৃতি! 

    ঘরের ভেতরে কী আছে, সেটায় কিইবা এসে গেল! 

    ওই খোলা রোদ্দুরেই তো তোমার জীবন, পেলাডো! 

    তোমার ঘরের দেয়ালে ওই ফুটবলারদের পোস্টারগুলো আসলে কেন ঝোলানো ছিল বলো তো? ফি দুই তিন বছর তোমরা হয় চাকরি বদল বা ভাড়ায় কুলে উঠতে না পেরে নতুন জায়গায় যেতে। কিন্তু এখানেও একটা দারুণ ব্যাপার আছে, জানো সেটা? প্রতিটা নতুন জায়গায়- সে যেখানেই হোক- একটা জিনিস কিন্তু থাকতো। বাইরে এক চিলতে ধুলোময় জায়গা। সবসময় একটা বল থাকতো। কোন বাড়িওয়ালা তোমার কাছে থেকে সেটা কেড়ে নিতে পারতো, বলো তো? কেউ না। 

     


    হয়তো আরেকটি আইসক্রিম গোল

     

    ঠিকঠাক মনে করতে পারলে, তোমার জীবনে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে আইসক্রিম গোল। 

    এই আইসক্রিম গোলে কী একটা জাদু আছে। পিএসজিতে কারও সঙ্গে আমার আলাপ করতে হবে এই ব্যাপারটা নিয়ে। এটা রীতিমতো জাদুকরি একটা ব্যাপার। এর চেয়ে বড় উৎসাহ আর কিছুতে হয় না। সাল্টোতে সেই যুব লিগের কর্তারা এটা বের করেছিলেন। বছর ছয়ের বাচ্চাদের স্কোর নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে কিভাবে মাতিয়ে রাখা যায়? 

    তখন তারা একটা নিয়ম বের করলেন- যে সবার শেষে গোল করবে, সে আইসক্রিম পাবে একটা। 

    স্কোর ৮-১ হতে পারে, তাতে কিছু যায় আসে না। সবাই তো ওই শেষ গোলটাই করতে চাইত। আহা, ঠিক তুমি আইসক্রিম গোল করার পরই যদি কোচ শেষ বাঁশিটা বাজায়, তখনকার অনুভূতিটা! দারুণ! কতো আনন্দ মেশানো ছিল তাতে! কেমন আইসক্রিম নেবে? চকলেট নাকি মিকি মাউসওয়ালাটা? পুরো দিনভর তখন তুমিই রাজা, তোমাকে কে ঠেকায়! 

    তুমি তো আর রাজধানী শহরের বাচ্চা নও। মন্টেভিডিওর ওই বাচ্চারা আলাদা একটা জগতে থাকে বুঝলে। এমন একটা জগত যে আছে, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। সেখানে অ্যাডিডাসের বুট আছে, ইয়া বড় গাড়ি আছে, সবুজ মাঠ আছে। অথচ সাল্টোতে এগুলো কতো ভিন্ন। কী একটা অত কারণে, সবাই খালিপায়ে খেলতে চাইতো সেখানে। অবশ্য ম্যাচের শুরুতে সবার পায়েই বুট থাকতো, তবে হাফটাইম হলেই হয়েছে। বুট একপাশে পড়ে থাকবে সব, সবাই তখন দৌড়াচ্ছে খালি পায়ে। এখনও চোখ বন্ধ করলে পায়ের নিচে সেই ধুলো টের পাই আমি। এখনও টের পাই বুকের ধুকপুকানিটা। আমি বলের পেছনে ছুটছি, আইসক্রিম গোলের পেছনে ছুটছি। 

    তুমি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এসেছো, জীবনভর এই স্মৃতিগুলো তোমার  সম্বল হয়ে থাকবে। সেইসব অনুভূতি। তুমি উরুগুয়ের, তোমার শেকড় সাল্টোতে। তোমার কাছে ফুটবলটা আলাদা ছিল। উরুগুইয়ানদের এই ব্যাপারটা আছে- তাকে তুমি আশীর্বাদ বলো বা অভিশাপ- তোমার জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের ফুটবল ইতিহাসটাই এমন। আমাদের দেশের ইতিহাসটাই এমন। ফুটবলের জার্সি যখন উরুগুইয়ানরা গায়ে দেয়, তারা সেই ইতিহাসের গর্বটা ধারণ করে তখনোই। 

    আমাদেরকে সবসময় ছুটতে হয়, আমরা ছুটতে থাকি। তুমিও ছুটতে থাকো। 

     

    মুক্তি!

     

    আচ্ছা, তোমার স্বপ্নটা কী, পেলাডো?  

    আমি ঠিক মনে করতে পারি না। সময়ের সঙ্গে সবকিছু কেমন ধোঁয়াটে হয়ে গেছে। 

    নান্দোর মতো মন্টেভিডিওতে খেলতে চাও? তুমি খেলবে, আর তখন তোমার মনে হবে, তুমি চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলছো। 

    ইউরোপে খেলার স্বপ্ন আছে নাকি? সেটা পূরণ হবে, তুমি তোমার পরিবারের সবার জীবন বদলে দেওয়ার মতো টাকা কামাই করবে। 

    তোমার স্বপ্ন কি জাতীয় দলে খেলা? সেটাও হবে। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনায় কাঁদার অভিজ্ঞতা হবে তোমার। 

    আচ্ছা, বিশ্বকাপে খেলতে চাও? এটা বরং না বলি এখন, মজাটা নষ্ট হয়ে যাবে। শুধু জেনে রাখো, ২০১০ সালটা হবে ‘এল লোকো’- পাগলাটে, ক্ষ্যাপাটে। 

    তোমার কি অনেক টাকা কামানোর ইচ্ছা? মস্ত সব বিলাসবহুল হোটেলে ঘুমাবে তুমি? পেলাডো, তুমি সবই পাবে। 

    তবে কথাটা কী জানো, এসব না, তোমাকে ঠিক সুখী করতে পারবে না। 

    এই যে এখন, এই নয় বছর বয়সে তোমার যা আছে, এই আমি ৩১ বছর বয়সে এসে যে সেসব কতোটা মিস করি! 

    তোমার হট-শাওয়ার নেই। পকেটে কানাকড়িও নেই। কী বলি এসব, তোমার তো চুলই নেই হে! 

    কিন্তু তোমার অন্য কিছু আছে। অমূল্য কিছু। 

    তোমার মুক্তি আছে, পেলাডো। 

    তুমি কী প্রবল একটা তাড়না-বাসনা নিয়ে জীবনটা পার করছো এখন। বয়স হলে একদম অসম্ভব যেগুলো। সেই অনুভূতিগুলো আমরা বুড়ো হয়ে আঁকড়ে ধরতে চাই বারবার। কেন জানি মুঠো গলে বের হয়ে যায় সেসব। এখন কতো দায়িত্ব নিতে হয়। কতো চাপ। ঘরের ভেতরের শৃঙ্খলে জীবনটা কাটাতেই সময় পেরিয়ে যায়। 

    এই ৩১ বছর বয়সে তুমি বেশিরভাগ সময় কী করো জানো? 

    হোটেল থেকে বাসে করে অনুশীলনে যাও। এরপর বাসে করে বিমানে। সেই বিমান থেকে আরেকটা বাস। সেই বাসে করে স্টেডিয়াম। 

    হ্যাঁ, অনেকভাবেই তুমি তোমার স্বপ্নের জগতে বাস করছো। তবে আরেকভাবে বলতে গেলে, তুমি আসলে সেই স্বপ্নের কারাগারে বন্দি। বাইরের খোলা রোদ্দুরে চাইলেই তুমি বেরিয়ে পড়তে পারো না। জুতা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে চাইলেই তুমি ধুলোয় নেমে খেলতে পারো না। জীবনটা তোমার শুধু জটিল হয়ে পড়েছে। কিছুই করার নেই। 

    ছোটবেলায় তুমি ভাবতে- যার অনেক কিছু আছে, সেই হয়তো সবচেয়ে সফল। তবে বড় হয়ে বুঝবে, যার আসলে বেঁচে থাকার পাথেয় আছে, জ্ঞান আছে, সেই সফল। 

    পেশাদার ফুটবলার হলে সব স্বপ্নই তুমি পূরণ করতে পারবে। এজন্য অবশ্য তোমার চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। তবে তোমাকে সত্যিটা বলি পেলাডো। একটা জায়গা আছে, যেখানে সেই আগের মতো মুক্ত তুমি। কপাল ভাল হলে, এই মুক্তিটা মেলে প্রায় ৯০ মিনিটের জন্য। 

    যখন বুটজোড়া পায়ে দেবে, তখন আসলে তোমার কিছু যায় আসবে না, তুমি কোথায় খেলছো না খেলছো। সাল্টোর ধুলোমাখা প্রান্তরে, নাপলেসের সবুজ মাঠে নাকি লক্ষ লোকের সামনে বিশ্বকাপে। তোমাকে বাবার একটা কথা মনে করিয়ে দিই। 

    ম্যাচ খেলতে যাওয়ার আগে তিনি কী বলতেন, বলো তো? 

    আমি জানি, আমি জানি পেলাডো, তোমার মনে আছে। 

    তিনি বলতেন, “ওই সাদা লাইন পেরিয়ে যখন মাঠে ঢুকবে, তোমার সামনে তখন ফুটবল ছাড়া কিচ্ছু নেই। সেই লাইনের বাইরে কী হচ্ছে, তার সঙ্গে ভেতরের কোনও সম্পর্ক নেই। বাইরের কিছুর আসলে অস্তিত্বই নেই তখন!” 

    যদি সেই কথাগুলো শুনে থাকো, ভেতরে ধারণ করে থাকো, তাহলে শোনো- খেলার চাপ যদি কখনও পাহাড়সম হয়ে ওঠে, লাখ লাখ মানুষের সামনে যখন তোমাকে মাঠে খেলতে হয়, তখনও তোমার মাঠে ঢুকে মনে হবে, তোমার পায়ে বুটই নেই! তুমি এমনই মুক্ত!

    তোমার খালি পায়ের নিচে তখন সেই ধুলো ফিরে আসবে। 

    সেই বুক ধুকপুকানি টের পাবে তুমি। বিশ্বের সবচেয়ে দামি ট্রফির মতো করে বলটাকে ধাওয়া করবে তুমি। 

    যেন সেই আইসক্রিমটার জন্য খেলছো তখন। 

    ভাল থেকো। 

    এডি