• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    টাইব্রেকার নাটকে ক্রোয়েশিয়াকে কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে গেলেন সুবাসিচ

    টাইব্রেকার নাটকে ক্রোয়েশিয়াকে কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে গেলেন সুবাসিচ    

    ক্যাসপার স্মাইকেলের কাছে এর বেশি আর কি চাইতে পারত ডেনমার্ক? ১১৪ মিনিটে লুকা মদ্রিচের পেনাল্টি ঠেকিয়ে দলকে ম্যাচে টিকিয়ে রেখেছিলেন। এরপর টাইব্রেকারে গড়াল সেই ম্যাচ। তবুও আলাদা করা দায় দুই দলকে। সেখানেও নায়ক হতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত হার মেনেছেন আরেক প্রান্তের গোলরক্ষকের কাছে। স্মাইকেল একটি করে পেনাল্টি ঠেকিয়েছেন, আর নিঝনি নভগরদেরর ভিআইপি বক্সে বাবা পিটার স্মাইকেল উল্লাসে মেতেছেন। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে পিটার স্মাইকেল দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে। কিন্তু ছেলে আর পারলেন না। সবকিছু ছাপিয়ে গেছেন ড্যানিয়েল সুবাসিচ। স্মাইকেল ঠেকিয়েছেন দুইটি স্পট কিক, আর সুবাসিচ একে একে ঠেকিয়ে দিয়েছেন এরিকসেন, শোন, ইয়র্গেনসনের পেনাল্টি। বিশ্বকাপে টাইব্রেকারে তিন পেনাল্টি ঠেকানো শেষ গোলরক্ষক রিকার্ডো। ২০০৬ সালে আজকের দিনেই কীর্তিটা গড়েছিলেন তিনি। স্মাইকেলও সেখানে থাকতে পারতেন, রাকিটিচের শেষ পেনাল্টিটা ঠেকানো হয়নি তার। রিকার্ডোর পাশে নাম লিখিয়েছেন সুবাসিচ। উৎসবে মেতেছে ক্রোয়েশিয়া, আর বাদ পড়ার হতাশায় ডুবেছে ডেনিশরা। নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলে খেলা শেষ হওয়ার পর টাইব্রেকারে ক্রোয়েশিয়া জিতেছে ৩-২ ব্যবধানে।   



    খেলার শুরুটা ম্যাথিয়াস ইয়ের্গেনসনকে দিয়ে। ৫৮ সেকেন্ডে ডেনিশ ডিফেন্ডারের গোলটা এই বিশ্বকাপে সবচেয়ে দ্রুত সময়ের। লং থ্রো থেকে বল এসেছিল ডিবক্সের ভেতর, থমাস ডেলায়নি প্রথমে বলটা রিসিভ করে বাড়িয়েছিলেন ইয়র্গেনসনের কাছে। ক্রোয়াট ডিফেন্ডার আর গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে বাঁ পায়ের দুর্বল শটেই গোলটা করেছিলেন ইয়র্গেনসন। এরপর অবশ্য ডেনিশদের শুরুর হাসিটা মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি। ডান দিক থেকে সিমে ভ্রাসালকো ক্রস করেছিলেন, কিন্তু ডেনিশ ডিফেন্ডারের গায়ে লেগেও সেটা খুঁজে পেল মারিও মাঞ্জুকিচকে। ডিবক্সের ভেতর থেকেই গোল করে ৪ মিনিটেই ক্রোয়াটদের ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন জুভেন্টাস স্ট্রাইকার। এর আগে ক্রোয়েশিয়ার ৪ ম্যাচে মদ্রিচ, রাকিটিচ, পেরিসিচদের সবাই গোল করেছিলেন। বাদ ছিলেন কেবল মাঞ্জুকিচ।

    ঝড়ের গতিতে শুরু করার পর অবশ্য দুই দলের আক্রমণই কিছুটা স্থিতি ফিরে আসে। তাতে খেলার গতি কমলেও, উপভোগ করার মতো ঘটনার কমতি ছিল না। ২৭ মিনিটে ব্রাথওয়েট ওয়ান অন ওয়ানে পেয়ে গিয়েছিলেন গোলরক্ষক ড্যানিয়েল সুবাসিচকে। লক্ষ্যভেদ করাটা অবশ্য কঠিনই হত কোণাকুণি জায়গা থেকে। সুবাসিচকেও তাই তেমন বেগ পেতে হয়নি ব্রাথওয়েটকে ফিরিয়ে দিতে। দুই মিনিট পরই অন্যপ্রান্তে ক্যাসপার স্মাইকেলও ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ইভান রাকিটিচ ডিবক্সের বাইরে থেকে শট করেছিলেন, স্মাইকেল পাঞ্চ করে ফিরিয়ে দিয়েছেন সেটা, ফিরতি বলে ইভান পেরিসিচও চেষ্টা করেছিলেন, আবারও পাঞ্চ করে ফিরিয়ে দিয়েছেন স্মাইকেল। ৩৯ মিনিটে স্মাইকেল অবশ্য হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন, তাকে বড় কোনো পরীক্ষা দিতে হয়নি বলে। সেটপিস থেকে মদ্রিচের শট ঠিকমতো হেড করতে পারলেই ক্রোয়েশিয়াকে এগিয়ে দিতে পারতেন ড্যান লভ্রেন।



    ওই গোলকিক থেকেই আক্রমণে উঠেছিল ডেনমার্ক। অন্যপ্রান্তে লভ্রেনের পার্টনার ভিদা অবশ্য ক্রোয়েশিয়াকে আরেকটু হলেই বিপদে ফেলে দিয়েছিলেন। বড়সড় একটা ভুল করেও বেঁচে গিয়েছেন সে দফায়। এর কিছুক্ষণ পর ক্রিশ্চিয়ান এরিকসনের চিপ বারপোস্টের কোণায় লেগে বাইরে চলে গেলে বেঁচে যায় ক্রোয়েশিয়াও। 

    দ্বিতীয়ার্ধে খেলার চিত্র গেল পুরো বদলে। দুই দলের শুরুটাই ছিল প্রথমার্ধের ঠিক বিপরীত, ঘর সামলে আক্রমণে ওঠার দিকে মন দিল না কেউই। কয়েকটি দুর্বল অন টার্গেটের শট ছাড়া দুই প্রান্তের গোলরক্ষকও অবসর সময় কাটালেন। ঝিমিয়ে যাওয়া খেলা অবশ্য ৮০ মিনিট পর ক্রোয়াটদের আক্রমণে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। ভ্রাসালকো বা রেবিচ কারও ক্রসই কাজে লাগাতে পারেননি পেরিসিচ। ইয়র্গেনসন, কেয়ারের রক্ষণই আসলে ওই দুই দফায় বাঁচিয়েছে ডেনিশদের। যোগ করা সময়ের শেষ মিনিটেও রাকিটিচের দূর থেকে নেওয়া শট বাইরে দিয়ে গেলে ১-১ গোলেই শেষ হয় নির্ধারিত সময়ের খেলা।

    অতিরিক্ত সময়ে অবশ্য দুই দলই কিছুটা ঝুঁকি নিল। কানুডসেন পুরো ম্যাচেই লং থ্রো করে গেছেন, ডেনিশরা সেখান থেকেই আরেকবার সুবিধা করে নিতে পারত। ৯৫ মিনিটে আরও একবার বিপদ হওয়ার আগেই অবশ্য বল ক্লিয়ার হয়েছে ক্রোয়াট ডিবক্সের ভেতর থেকে। প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার এক মিনিট আগে মাঞ্জুকিচকে ভালো একটা পাস বাড়িয়েছিলেন মদ্রিচ। মাঞ্জুকিচ অবশ্য ডিবক্সের ভেতর থেকেও তেমন কিছু করতে পারেননি, অবশ্য মুহুর্তটা ভীতি জাগিয়েছিল ডেনিশ রক্ষণে। স্মাইকেলকে তাই সেভটা করতেই হয়েছিল।

    স্মাইকেল আরও বড় সেভ করেছিলেন দ্বিতীয়ার্ধে। মদ্রিচের ওই পেনাল্টিটাকে গোল হতে না দিয়ে। তার আগে ডেনমার্কও তাদের সুযোগ পেয়েছিল। ১০৮ মিনিটে পিয়নে সিস্তোর দূর থেকে করা শট, লং থ্রো থেকে ক্রন্দেল্লির শট- সবই গেছে বাইরে দিয়ে।

    শুরুর চার মিনিটে দুই গোল যে রোমাঞ্চের ইঙ্গিত দিয়েছিল, সেটা মিলিয়ে গেছে দ্বিতীয়ার্ধের খেলায়। কিন্তু সকালের সূর্য ইঙ্গিতটা আজ ঠিকই দিয়েছিল। ১১৪ মিনিটে রোমাঞ্চ ফিরল ম্যাচে। মদ্রিচের পাস থেকে নিশ্চিত গোলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন আনতে রেবিচ। স্মাইকেলকে পেছনে ফেলে এসেছেন, সামনে শুধু ফাঁকা বার। ইয়র্গেনসন শুরুতে ছিলেন, শেষেও যোগ দিলেন পান্ডুলিপিতে। পেছন থেকে ফাউল করে, গোলই করতে দিলেন না রেবিচকে। সে দফায় ইয়ের্গেনসনের ভাগ্যটা ভালোই ছিল। লাল কার্ড দেখতে হয়নি, নিশ্চিত গোল থেকে পাওয়া পেনাল্টিতেও গোল করতে পারেননি মদ্রিচ। তার শট ঠেকিয়ে দিয়ে স্মাইকেলই খেলাটা নিয়ে গিয়েছিলেন টাইব্রেকারে।

    ইয়ের্গেনসন আর ২০১০ সালের লুইস সুয়ারেজ হয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু ১৯৯৮ সালের ক্রোয়েশিয়া হওয়ার পথে এগিয়ে গেছেন মদ্রিচরা। টাইব্রেকারের পুরোটা সময় চোখ সরিয়ে রেখেছিলেন কোচ ডালিচ। ম্যাচ শেষে তাকে মুক্তি দিয়েছেন তার খেলোয়াড়েরা। গ্যালারিতে গিয়ে ডেভর সুকারের সঙ্গে মুহুর্তটা ভাগ করে দিয়েছেন ডালিচ। এই সুকারই তাকে বিশ্বকাপের ৭ মাস আগে দায়িত্বটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। সেই দলটার স্বপ্নযাত্রা এখন শুধু ছুটছেই। আপাতত গন্তব্য কোয়ার্টার ফাইনাল, সেখানে প্রতিপক্ষ স্বাগতিক রাশিয়া।