নিঃস্ব থেকে বিশ্বময় : লুকাকু যে গল্পটা বলতে চান
রোমেলু লুকাকু - বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্মের অন্যতম স্বর্ণালী ফুটবলার। তবে এই স্বর্ণালী সময়ের আগের সময়ের একটা গল্প আছে তার। আছে পরের সময়েরও। কিভাবে তিনি লুকাকু হলেন, সেটাই বলেছেন দ্য প্লেয়ারস ট্রিবিউন থেকে অনূদিত এই লেখায়...
একদম ঠিক কোন সময়টায় আমরা নিঃস্ব হয়ে গেলাম, আমার মনে আছে। ফ্রিজের সামনে দাঁড়ানো মায়ের মুখটা এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে, ছবির মতো।
আমার বয়স তখন ছয়। স্কুল থেকে লাঞ্চ করতে ফিরেছি বাসায়। মায়ের ওই একটা মেন্যুই থাকতো প্রতিদিন- রুটি আর দুধ। বাচ্চা বয়সে তো এতোকিছু ভাবতাম না। তবে আমার যেটা মনে হয়, এর বেশি আসলে সামর্থ্য ছিল না আমাদের।
সেদিনও বাসায় ফিরে কিচেনে ঢুকে ফ্রিজের সামনে মাকে দেখে ঠিকঠাকই মনে হয়েছিল। তবে দুধের সঙ্গে তিনি কিছু মেশাচ্ছিলেন, এরপর ঝাঁকাচ্ছিলেন। বুঝছিলাম না ঠিক কী হচ্ছে। মা লাঞ্চ আনলেন, যেন সব ঠিকই আছে। ঠিক তখনই বুঝলাম, আসলে হচ্ছেটা কী।
দুধের সঙ্গে তিনি পানি মেশাচ্ছিলেন। সপ্তাহটা শেষ করার মতো সামর্থ্য ছিল না আমাদের। আমরা নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম। শুধু গরীব না, আমরা তখন নিঃস্ব।
বাবা পেশাদার ফুটবলার ছিলেন, তবে ক্যারিয়ারের শেষপ্রান্তে। জমানো টাকা-পয়সাও সব শেষ। প্রথমে ক্যাবল-টিভি বিদায় নিল বাসা থেকে। ম্যাচ ডে বলতে কিছু রইল না। দেখবো কোথায়, লাইনই তো নেই।
রাতে ঘরে ফিরে দেখতাম আলো নেই। মাঝে মাঝে দুই-তিন সপ্তাহ ধরে ইলেক্ট্রিসিটি থাকতো না।
গোসলে গেলে গরম পানিও মিলতো না। স্টোভে মা পানি গরম করতেন। আমি একটা কাপে করে মাথায় গরম পানি ছিটাতাম।
এমনও দিন গেছে, রাস্তার মাথার ঐ বেকারি দোকান থেকে মা বাকিতে রুটি এনেছেন। দোকানি আমাকে, আমার ছোট ভাইকে চিনতেন। সোমবার মাকে তাই রুটি বাকিতে দিতেন, শুক্রবার সেটা শোধ করতে হতো।
আমি জানতাম, আমাদের জীবন-সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। মাকে দুধের সঙ্গে পানি মেশাতে হচ্ছে। আমি জানতাম, সব শেষ। আমাদের জীবনটা শেষ।
আমি একটা কথাও বলিনি। তার চাপ বাড়াতে চাইনি আর। সেদিন শুধু লাঞ্চ খেয়ে গেলাম তাই। তবে ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম একটা। কেউ যেন আচমকা থাবা বসিয়ে দিয়ে আমাকে জাগিয়ে দিয়েছিল। কী করতে হবে, সেটা বুঝলাম। আমি জানতাম, ঠিক কী করব আমি।
আমি তো মাকে এভাবে বাঁচতে দিতে পারি না। না, কোনোমতেই না।
ফুটবলের মানুষজন তো মানসিক শক্তি নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে। তাহলে আপনার দেখা সবচেয়ে শক্তিশালী ফুটবলার আমি। কারণ আমি সে-ই ছেলেটা, যে ভাই আর মায়ের সঙ্গে অন্ধকারে প্রার্থনায় বসে ভাবতাম। বিশ্বাস করতাম। জানতাম, কী হতে চলেছে।
প্রথম প্রথম আমার শপথ আমি নিজের ভেতরই রেখেছিলাম। একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি, মা কাঁদছে। আমাকে বলতেই হলো, “মা, সব বদলাবে। দেখ, বদলাবে। আমি আনডারলেখটের হয়ে খেলব। শীঘ্রই খেলব। আমাদের সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার চিন্তা করতে হবে না আর।”
আমার বয়স তখন ছয়।
বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “তুমি কবে চুক্তি করেছিলে?”
বাবা জবাব দিয়েছিলেন, “ষোল।”
“ঠিক আছে। ষোলই সই।”
এটা হতেই হতো। এর বাইরে আর কিছু হওয়ার কথা ছিল না।
তবে একটা কথা বলি, আমার খেলা প্রতিটি ম্যাচই আমার কাছে ফাইনাল ছিল। পার্কে খেললেও সেটা ফাইনাল, কিন্ডারগার্টেনের বিরতিতে খেললেও সেটা ফাইনাল। আমি এমনই সিরিয়াস ছিলাম। প্রতি শটেই আমি বলের চামড়া তুলে ফেলতে চাইতাম। পুরো শক্তি দিয়ে মারতাম। আমি আর-ওয়ান বাটন চেপে ফিনেস শট খেলতাম না। আমার নতুন ফিফা ছিল না। প্লেস্টেশন ছিল না। আমি শুধু খেলে বেড়ানোর জন্য খেলতাম না। আমি মেরে ফেলতে চাইতাম সবাইকে।
লম্বা হতে শুরু করলাম। শিক্ষক, গার্জিয়ানরা গাঁইগুঁই শুরু করলেন। ভুলবনা, প্রথম যেদিন বয়সে বড় একজনকে বলতে শুনেছিলাম, “ওই, তোমার বয়স কতো? কোন সালে জন্ম?”
আমার ভাবখানা এমন ছিল, বলে কী! সত্যিই বলছে এসব?
১১ বছর বয়সে লিয়েরস যুব দলে খেলতাম আমি। একদিন অন্য দলের এক অভিভাবক রীতিমতো আমাকে পিচে যেতে বাধা দিল। আমার বয়স কতো, আমার আইডি কার্ড কই, আমি কোথা থেকে এসেছি- নানান প্রশ্ন।
আমি কোথা থেকে এসেছি? বলে কী! আমার জন্ম আন্টোয়ের্পে। বেলজিয়াম আমার দেশ।
এক বেলজিয়াম/ফিফা
সেদিন বাবা ছিলেন না সঙ্গে। বাবার গাড়ি ছিল না বলে তিনি আমাকে বাইরের ম্যাচে নিয়ে যেতে পারতেন না। আমি ছিলাম একা, একাই সামলেছিলাম সব। ব্যাগ থেকে আইডি এনে তাদেরকে দেখালাম। একজন একজন করে তারা আমার পরিচয়পত্র দেখল। আমার শরীরে তখন রক্তনাচন শুরু হয়েছে। আমি ভাবছি, “এবার তোমাদের ছেলেদের কেউ বাঁচাতে পারবে না। আমি তাদের মেরেই ফেলতাম, তবে এবার ধ্বংস করে দিব। ছেলেকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরবে তোমরা।”
বেলজিয়ামের ইতিহাসের সেরা ফুটবলার হতে চাইতাম আমি। লক্ষ্য ছিল সেটাই। ভাল না। দারুণ না। সেরা। আমি প্রচন্ড আক্রোশে খেলতাম। অনেক কিছুর কারণেই এই ক্রোধ আসতো। ঘরের মধ্যে দৌড়ে বেড়ানো ইঁদুরের কারণে আমি ক্রুদ্ধ ছিলাম। আমি চ্যাম্পিয়নস লিগ দেখতে পেতাম না। আমার দিকে অন্য গার্জিয়ানরা কেমন কেমন করে তাকাতো।
আমি মিশনে নেমেছিলাম।
১২ বছর বয়সে ৩৪ ম্যাচে আমার গোলসংখ্যা ছিল ৭৬।
সবকটি গোলই আমার বাবার বুটে করা। তার পায়ের সঙ্গে আমার পায়ের মাপ মিলে যাওয়া শুরু করার পর থেকেই আমরা বুট শেয়ার করতাম।
একদিন নানার ফোন এলো। আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন তিনি। যে কঙ্গো থেকে আমার বাবা-মা এসেছিলেন, সেই কঙ্গোর সঙ্গে আমার একমাত্র যোগসূত্র তিনিই ছিলেন। সেদিন ফোনে স্বাভাবিক কথাবার্তাই বলছিলাম- ভাল আছি, ৭৬ গোল করেছি, লিগ জিতেছি। বড় দল আমার দিকে নজর রাখছে।
আমার ফুটবলের কথাই শুনতে চাইতেন সবসময়। তবে সেদিন অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটলো। তিনি বললেন, “রম, সবই তো ঠিক আছে। আমার একটা উপকার করতে পারবে?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, কী করতে হবে?”
“আমার মেয়ের দিকে খেয়াল রাখতে পারবে, প্লিজ?”
আমি ধন্দে পড়ে গেলাম। নানা বলছেটা কি!
বললাম, “মা? আমরা ঠিক আছি তো। ভাল আছি।”
আবার একই সুর, “না, কথা দাও। পারবে কথা দিতে? শুধু আমার মেয়ের খেয়াল রাখবে। আমার জন্য শুধু আমার মেয়ের খেয়াল রাখবে, ঠিক আছে?”
“হ্যাঁ নানা। বুঝেছি। আমি কথা দিলাম।”
কদিন পর নানা মারা গেলেন। ঠিক কী বুঝিয়েছিলেন, সেটা বুঝলাম তখন।
নানা যদি আর চার বছর বেঁচে থাকতেন! আমাকে আন্ডারলেখটের হয়ে খেলতে দেখতেন! দেখে যেতেন, আমি কথা রেখেছি! সব ঠিক হয়ে গেছে, এটা যদি দেখে যেতে পারতেন! যখনই চিন্তা করি, কেমন দুঃখ এসে ভর করে আমার ওপর।
মাকে বলেছিলাম, আন্ডারলেখটের হয়ে ষোলতেই খেলব।
এগার দিন দেরি হয়েছিল আমার।
২০০৩। ২৪ মে। আন্ডারলেখট-স্ট্যান্ডার্ড লিয়েজ। প্লে-অফ ফাইনাল।
আমার জীবনের সবচেয়ে ক্ষ্যাপাটে দিন। তবে সেদিনের কথা বলার আগে, একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে।
সেই মৌসুমের শুরুতে আন্ডারলেখট অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়েই আমি নিয়মিত সুযোগ পেতাম না। বেঞ্চে বসিয়ে রাখতেন কোচ। এমন হলে ১৬তম জন্মদিনের আগে পেশাদার চুক্তি হবে কিভাবে আমার! ভাবতাম শুধু।
কোচের সঙ্গে একটা বাজি ধরলাম তাই।
তাকে বললাম, যদি আমাকে খেলানো হয়, তাহলে ডিসেম্বরের আগেই ২৫টি গোল করব আমি।
কোচ হেসেই ফেললেন। সত্যি, হেসে ফেললেন।
“বাজিটা তাহলে হয়েই যাক, নাকি?”, বললাম আমি।
“ঠিক আছে। তবে ডিসেম্বরের ভেতর যদি ২৫ গোল করতে না পারো, তাহলে বেঞ্চে ফিরে যাবে”, কোচ বললেন।
“কিন্তু আমি যদি বাজিতে জিতি, তাহলে যেসব ভ্যানে আমরা ঘরে ফিরি, সব পরিষ্কার করে দিবেন আপনি।”
“আচ্ছা। চুক্তি।”
“আরেকটা জিনিস। আমাদের জন্য প্রতিদিন প্যানকেক বানাতে হবে আপনাকে।”
“ঠিক আছে।”
সবচেয়ে বোকামিটা করেছিলেন তিনি সেদিন সেই বাজিটা ধরে।
নভেম্বরের আগেই আমার ২৫টা গোল হয়ে গেল। ক্রিসমাসের আগেই আমরা প্যানকেক খাচ্ছিলাম, ব্রো! আছো কোথায়!
এখানে একটা শেখার বিষয় আছে অবশ্য। ক্ষুধার্তদের সঙ্গে না, কখনও খেলতে নেই।
থিয়েরি : বোকার মতো কথা বলো না।/ফিফা
১৩ মে আমার জন্মদিনে আনডারলেখটের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল আমার। সোজা গিয়ে নতুন ফিফার ভার্শন, আর স্যাটেলাইট ক্যাবলের প্যাকেজ কিনেছিলাম। তখন মৌসুমের শেষদিক, ঘরে বসে দিন পার করছি শুধু। তবে বেলজিয়ান লিগ সেবার নাটক হচ্ছিল। আনডারলেখট ও স্ট্যান্ডার্ড লিয়েজ সমান পয়েন্টে লিগ শেষ করেছে। দুই লেগের প্লে-অফে তাই শিরোপা ঠিক করা হবে।
প্রথম লেগে নিতান্ত দর্শকের মতো টিভিতে খেলা দেখেলাম।
দ্বিতীয় লেগের আগের দিন রিজার্ভ কোচের ফোন এলো।
“হ্যালো?”
“হ্যালো, রম। কী করছো?”
“পার্কে খেলতে যাব।”
“না না না। ব্যাগ গোছাও। এখনই।”
“কেন? কী করেছি আমি?”
“না না, কিছু করোনি। তোমাকে স্টেডিয়ামে আসতে হবে এখনই। মূল দল তোমাকে চাচ্ছে, এখনই”।
“ইয়ো, কী বলো এসব? আমি?”
“হ্যাঁ, তুমি। চলে আসো। এখনই।”
বাবার বেডরুমে ছুটে গেলাম। বাবাকে ঠেল তুলে বলছিলাম শুধু, “ইয়ো, ওঠো ওঠো। আমাদের যেতে হবে যে!”
তার ভঙ্গি ছিল এমন, “কী বলো! কই যাব!”
“আন্ডারলেখটে, ম্যান!”
সে কথা কী ভোলা যায়! স্টেডিয়ামে ঢুকেই ড্রেসিংরুমে দৌড়। কিটম্যান জিজ্ঞাসা করলেন, “বাচ্চা, কোন নাম্বার নেবে?”
আমি বলেছিলাম, “১০ নাম্বার দাও”।
হাহহাহা! কী হাস্যকর। ভয় পাওয়ার মতো বয়স তখন ছিল না বোধহয় আমার।
তিনি বললেন, “একাডেমি প্লেয়ারদের ৩০ থেকে ওপরের দিকের নাম্বার দেওয়া হয়।”
তিন যোগ ছয় নয় হয়। আমি ৩৬ নম্বরটা নিয়েছিলাম।
সেই রাতে হোটেলে সিনিয়রদের জন্য আমাকে গান গাইতে হয়েছিল। মনে নেই, কী গেয়েছিলাম। মাথা ঘুরছিল শুধু।
পরদিন সকালে বন্ধু এসেছে বাসায়। খেলতে ডাকতে। মা বলেছিলেন, “ও বাইরে খেলতে যাবে।”
“বাইরে কোথায়?”
“ফাইনালে।”
স্টেডিয়ামে বাস থেকে নামলাম। সবাই দারুণ স্যুট পরে। শুধু আমার গায়ে বিভৎস এক ট্রাকস্যুট। সব টেলিভিশন ক্যামেরা আমার দিকে তাক করা। লকার রুম ৩০০ মিটার দূরে হবে বোধহয়, মিনিট তিনেকের পথ। সেখানে পা দিতেই যেন ফোন যেন ফেটে পড়লো। সবাই টিভিতে দেখেছে আমাকে। তিন মিনিটে পঁচিশটা মেসেজ পেয়েছি। বন্ধুরা পাগল হয়ে গেছে।
“ব্রো, তুমি ম্যাচে কেন?”
“রম, হচ্ছেটা কী! তোমাকে টিভিতে দেখায় কেন?”
সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে শুধু রিপ্লাই দিয়েছিলাম। “ব্রো, খেলব কিনা জানি না। কী হচ্ছে, সেটাও জানি না। তবে টিভি দেখতে থাকো।”
৬৩ মিনিটে ম্যানেজার আমাকে নামিয়ে দিলেন।
অ্যান্ডারলেখটের হয়ে আমি যেদিন মাঠে নামলাম, সেদিন আমার বয়স ১৬ বছর ১১ দিন।
মাকে যে কথা দিয়েছিলাম, তার এগারো দিন পর।
সেদিন হেরেছিলাম। তবে আমি তখনোই উড়ছি। মাকে দেওয়া, নানাকে দেওয়া কথা আমি রেখেছি।
ঠিক সেই মুহুর্তে আমি জেনেছিলাম- সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে।
বলছেন লুকাকু, শুনছেন সবাই/ ফিফা
পরের মৌসুমে আমি হাইস্কুলের শেষ বর্ষে। একই সঙ্গে ইউরোপা লিগেও খেলছি। বিকেলে ফ্লাইট ধরতে হবে বলে ইয়া বড় এক ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যেতাম। সেবার সেইরকম ব্যবধানে লিগ জিতেছিলাম। আফ্রিকার বর্ষসেরা ফুটবলারের তালিকায় দ্বিতীয় হয়েছিলাম! ভাবা যায়! অদ্ভুত!
এর সবকিছুই চেয়েছিলাম আমি। তবে এতো দ্রুত নয় বোধহয়।
আমাকে ঘিরে মিডিয়ার চাপ বাড়তে থাকলো। প্রত্যাশার চাপ। জাতীয় দলে বিশেষ করে। কিন্তু যে কারণেই হোক, আমি বেলজিয়ামের হয়ে ভাল খেলছিলাম না। এটা কাজ করছিল না ঠিকঠাক।
কিন্তু, আমার বয়স তখন কতো হবে, সতের? আঠারো? উনিশ?
সময় ভাল গেলে পত্রিকায় লেখা দেখতাম, রোমেলু লুকাকু, বেলজিয়ান স্ট্রাইকার।
আর সময় খারাপ গেলে, রোমেলু লুকাকু, কঙ্গো থেকে উঠে আসা বেলজিয়ান স্ট্রাইকার।
আমার খেলার ধরন পছন্দ নয়, ঠিক আছে। কিন্তু আমার জন্ম এখানে, বেড়ে ওঠা এখানে। এই অ্যান্টোয়ের্পে। লিয়েজে। ব্রাসেলসে। আনডারলেখটের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখেছি আমি। ভিনসেন্ট কোম্পানি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। হয়তো একটা কথা ফ্রেঞ্চ ভাষায় শুরু করবো, ডাচ দিয়ে শেষ করবো। মাঝে স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, লিঙ্গালা যা ইচ্ছা তাই বলবো, যেখানে যেটা প্রয়োজন।
তাতে কিছু যায় আসে? আমি তো বেলজিয়ান।
আমরা সবাই বেলজিয়ান। এই কারণেই তো আমাদের দেশটা এমন অদ্ভুত সুন্দর, তাই না?
আমি জানি না, আমারই দেশের কেউ কেউ কেন আমার ব্যর্থতা দেখতে যায়! চেলসিতে গিয়ে খেলার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। তারা হাসছিল আমার দিকে চেয়ে। ওয়েস্ট ব্রমে ধারে গেলাম, তখনও তারা হাসছিল।
তবে এতে কিছু যায় আসে না আসলে আমার। তারা তো আর আমাদের বাসায় দুধের মধ্যে পানি মেশাতে দেখেনি। যখন আমি নিঃস্ব ছিলাম, তখন যদি আমাকে না দেখে থাকে, তাহলে আসলে আমাকে বুঝবে না কেউ।
মজার বিষয়টা কী জানেন?
দশ বছর আমি চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল দেখতে পারিনি ছোটবেলায়। আমাদের সে সামর্থ্যই ছিল না! স্কুলে গিয়ে শুনতাম, সবাই ফাইনাল নিয়ে আলোচনা করছে। আমার কোনও ধারণাই ছিল না, কী ঘটেছে! ২০০২ সালে, মাদ্রিদ যখন লেভারকুসেনের সঙ্গে খেলল, সবাই বলাবলি করছিল, “সেই ভলি! আহা, কী একটা ভলি!”
কী নিয়ে কথা হচ্ছে আমি জানি, এমন ভান করতে হতো আমাকে।
সপ্তাহ দুয়েক পরে, কম্পিউটার ক্লাসে বসে এক বন্ধু ভিডিওটা ডাউনলোড করেছিল। অবশেষে আমি দেখলাম। জিদানের সেই ভলি। টপ কর্নার দিয়ে যেটা ঢুকলো গোলে।
সেই গ্রীষ্মে রোনালদো- ফেনোমেনোনকে ফাইনালে দেখতে আমি সেই বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম। এছাড়া সেই বিশ্বকাপের প্রতিটি ঘটনা আমি শুধু স্কুলে গল্পই শুনেছি।
২০০২ বিশ্বকাপের সময় আমার জুতায় বড় একটা ফুটো ছিল। ইয়া বড় একটা ফুটো।
আর বার বছর পর, আমি বিশ্বকাপে খেলেছি।
এখন আরেকটা খেলব। আর এবার শুধু উপভোগ করব। এই চাপ, নাটক- এতকিছুর জন্য আসলে জীবনে সময় নেই। আমাকে নিয়ে, আমাদের দলকে নিয়ে লোকে যা ইচ্ছা তাই বলতে পারে।
তবে জানেন তো। ছোট থাকতে না, আমরা ম্যাচ অব দ্য ডে-তে থিয়েরি হেনরিকে দেখতে পেতাম না। আর আজ, জাতীয় দলে আমি তার কাছ থেকেই প্রতিদিন শিখছি। এই কিংবদন্তি আমার সামনে রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে দাঁড়িয়ে এখন। জায়গা বানিয়ে কিভাবে দৌড়াতে হয়- সেটা তিনি আমাকে বলছেন এখন। মনে হয় থিয়েরিই একমাত্র মানুষ এই বিশ্বে, যে আমার চেয়ে বেশি ফুটবল দেখেছে। আমরা সবকিছু নিয়ে তর্ক করি। বসে বসে আমরা জার্মান সেকেন্ড ডিভিশন নিয়ে তর্ক করি।
আমি বলি, “থিয়েরি, ফরচুনা ডাশেলডর্ফের সেট-আপটা দেখেছো নাকি?”
থিয়ের জবাব দেয়, “বোকার মতো কথা বলো না। অবশ্যই দেখেছি।”
আমার কাছে এই দুনিয়ার সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার এটাই।
আমার খুব ইচ্ছা, নানা যদি দেখে যেতে পারতেন এটা।
না, প্রিমিয়ার লিগের কথা বলছি না। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বা চ্যাম্পিয়নস লিগ, এমনকি বিশ্বকাপের কথাও বলছি না।
আমাদের যে জীবন এখন, সেটা যদি দেখে যেতে পারতেন। আর একবার যদি ফোনে তাকে পেতাম। তাকে জানাতে পারতাম….
“দেখেছ? বলেছিলাম না, তোমার মেয়ে ভাল থাকবে। ঘরে আর ইঁদুর নেই জানো? আমরা মেঝেতে ঘুমাই না এখন। চাপ নেই। টেনশন নেই। আমরা ভাল আছি। ভাল আছি….
….আমাদের আর কাউকে আইডি দেখাতে হয় না। সবাই এখন আমাদের নাম জানে।”