• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    বিশ্বকাপ সাফল্যও যখন 'যথেষ্ট' নয় মদ্রিচদের

    বিশ্বকাপ সাফল্যও যখন 'যথেষ্ট' নয় মদ্রিচদের    

    যোভি, সামো যোভি, সি চে সকোলোভি
    যা তে যিভো দাতি…..

    ডাকো, একবার ডাকো
    সব ঈগল এসে পড়বে
    তোমাকে নতুন জীবন দিতে….

    ক্রোয়েশিয়ার ড্রেসিংরুম। টেবিলের ওপরে দাঁড়িয়ে কেউ, কেউ হাতে থাকা সবকিছু ছিটিয়ে দিচ্ছেন উত্তেজনায়। গাইছেন তাদের বিখ্যাত গান। সেই ফুটবলার, কর্মকর্তা, স্টাফদের ভীড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সুর মেলাচ্ছেন ৫০ বছর বয়সী এক নারী। পরনে ক্রোয়েশিয়ার বিখ্যাত লাল-সাদা ডোরাকাটা জার্সি আর ট্রাউজারস। ভদ্রমহিলা কোলিন্দা গ্রাভার-কিতারোভিচ, ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট। রাশিয়াকে হারিয়ে ১৯৯৮ সালের পর আবার সেমিফাইনালে পৌঁছে গেছে ক্রোয়েশিয়া, সে উল্লাসেই যোগ দিয়েছেন আলোচিত এই রাজনৈতিক নেতা। এদিন অবশ্য বেশ স্বচ্ছন্দ্যই ছিলেন ক্রোয়াট ফুটবলাররা, অন্তত কিতারোভিচের ফেসবুক প্রোফাইলে শেয়ার করা ভিডিওটা সেটাই বলে। কোয়ার্টার ফাইনালে জয়ের পর অবশ্য একটু ভিন্ন চিত্র ছিল ক্রোয়েশিয়ার ড্রেসিংরুমে। 

    ছড়ানো-ছিটানো জুতা, মোজা, শিনগার্ড। কেউ কেউ জার্সি ছেড়ে একেবারে অন্তর্বাসে নেমে গেছেন, হয়তো অপেক্ষা করছেন শাওয়ারের। কিতারোভিচ হাজির সেখানেই, প্রথমে কোচ ডালিচকে আলিঙ্গনে বাঁধলেন, এরপর একে একে সব ফুটবলারকে। কেউ প্রেসিডেন্ট ভেবে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়েছিলেন প্রথমে, তবে প্রেসিডেন্ট তখন অন্য মুডে। কয়েকজনকে তো দেখা গেল বেশ নির্বিকার, প্রেসিডেন্ট এসেছে ড্রেসিংরুমে, তেমন গায়েই মাখছেন না যেন! 

     

    ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট

     

    এই ভিডিওটা বেশ একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছড়িয়েছিল ক্রোয়েশিয়া জুড়ে। অনেকের মতে, কিতারোভিচ একেবারে মাটির মানুষ, মাতৃতুল্য একজন। এবং এমন একজন, যার ফুটবলের প্রতি, খেলাধুলার প্রতি অসীম মমত্ববোধ, যা তার পূর্ববর্তী নেতাদের ছিল না, বিশেষত বামদিক ঘেঁষা নেতাদের তো নয়ই। একদম বিপরীত মতও আছে। তাদের মতে, এটা শুধুই লোকদেখানো, নিশ্চিতভাবেই অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের জার্মানি দলের প্রতি আচরণ থেকে উৎসাহিত। এবং তিনি ব্যাপারটা মঞ্চায়িত করতে গিয়ে গুবলেট পাকিয়ে ফেলেছেন। 

    এই আলিঙ্গনগুলোর মধ্যে আলাদা করে চোখে পড়বে লুকা মদ্রিচেরটা। প্রেসিডেন্ট তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাও বলেছেন, তাকে দেখে যে উচ্ছ্বসিত হয়েছেন সবচেয়ে বেশি- বলা যায় সেটাও। মদ্রিচ ক্রোয়েশিয়ার সবচেয়ে বড় ফুটবল নায়ক এখন, এ বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় তারকা, দলের প্রাণভোমরা। তবে লুকা মদ্রিচ ক্রোয়েশিয়ায় এখন ভিন্ন কিছু। 

    গ্রাভার-কিতারোভিচের এই কর্মকান্ড হতে পারে তার ফুটবলের প্রতি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ, আবার হতে পারে পরের বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে একটা জনসংযোগের অংশ। তবে ক্রোয়েশিয়ার এই সোনালী প্রজন্মের এমন ফুটবল সাফল্যের পরও বর্তমান চিত্রটা বেশ গোলমেলে। 


    **** 

    হ্যারি কেইন যদি ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারেন, একটা নাইটহুড তার জন্য অপেক্ষা করে থাকতেই পারে। কিলিয়ান এমবাপ্পের গোলে যদি ফ্রান্স জেতে ফাইনাল, নতুন ফরাসী রাজা উপাধি পেয়ে যেতে পারেন তিনি। কিন্তু লুকা মদ্রিচ যদি ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে যান, গিয়ে শিরোপাও জেতেন, তাহলে কী অপেক্ষা করছে তার জন্য? 

    অন্তত কেইন বা এমবাপ্পের মতো তেমন কিছুর আশা তিনি নিজেও করছেন না বোধহয়। নিজ দেশের জনগণই যে বেশ চটে আছে তার ওপর! এমনকি অপেক্ষা করে আছে কারাভোগের হুমকিও!

     

     

    বাস্তবতা বলছে, অনেক গভীরে প্রোথিত দূর্নীতি, বিচার-ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে ক্রোয়াটরা খুব একটা আশাবাদি নন তাদের দেশের ব্যাপারে। রাজনৈতিক নেতাদের দ্বন্দ্বের মাঝে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও মুখ থুবড়েই পড়ছে শুধু। নব্বইয়ের দশকের ‘খেলাধুলায় ক্রোয়েশিয়াকে খেপ্রতিনিধিত্ব করাটা দেশপ্রেমের অংশ’, এমন তত্ত্বের এতো অসদ্ব্যবহার হয়েছে, ক্রোয়াট জনগণরা রীতিমতো বিরক্ত। এই ‘পাবলিক ফিগার’রা শুধু নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যবহার করেছেন ক্রোয়েশিয়ার ‘ট্যাগ’টা। সমাজের আর দশটা সমস্যা ঢাকতেও ঢাল হিসেবে এই ফুটবলের মতো খেলাকেই ব্যবহার করা হয় বলেও মত তাদের। 

    মদ্রিচ তেমনই একজন, যার ওপর বিরক্ত ক্রোয়াটরা। শুধু বিরক্ত নন, মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ার মামলাও আছে তার নামে। এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে ফুটবলই। 

    এর মূলে আছে মদ্রিচের সঙ্গে ক্রোয়েশিয়ান ফুটবলের একসময়ের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি দ্রাভকো মামিচের সঙ্গে সম্পর্ক। মামিচ বিভিন্ন সময় ডায়নামো যাগরেবের নির্বাহী কর্মকর্তা, ক্রোয়েশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন। 

    ডায়নামো যাগরেবে খেলার সময় আর সবার মতো মদ্রিচও চুক্তি করেছিলেন মামিচের সঙ্গে। সেসব চুক্তিপত্রে ছিল, কোনও খেলোয়াড়ের পরবর্তী আয়ের অংশিদারীত্বের বিনিময়ে মামিচ তাদেরকে বর্তমানে আর্থিক সহায়তা করবেন। এবং পরবর্তীতে যেসব আয় হবে, তা করতে হবে তার পুত্র মারিওর অধীনে, যিনি একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত এজেন্ট। সুতরাং, একজন ফুটবলার যদি পরবর্তীতে অন্য কোনও ক্লাবের কাছে বিক্রি হয়ে যান, তাহলে সেই ট্রান্সফার ফির একটা বড় অংশ পাবেন মামিচ ও তার পরিবার। 

     

    মাথায় এতকিছু নিয়ে এমন খেলছেন কিভাবে মদ্রিচ? 

     

    ২০০৮ সালে ১০.৫ মিলিয়ন ইউরোতে টটেনহামে গিয়েছিলেন মদ্রিচ। তবে প্রায় ৮.৫ মিলিয়ন ইউরোই তাকে দিয়ে দিতে হয়েছিল মামিচ ও তার পরিবারকে। বাগড়া বেঁধেছিল মদ্রিচের বর্তমান ক্রোয়েশিয়া দলের বেশ কয়েকজনের ট্রান্সফার ফি-তে মামিচ পরবর্তীতে এসব শর্ত যুক্ত করায়। ডেয়ান লভরেন, সিমে ভ্রসালিকো, মাতেও কোভাচিচ- সবাইকেই বিক্রি করে দিয়েছিল ডায়নামো, এবং সবার চুক্তিপত্রেই নিজের অংশের ব্যাপারটা ঢুকিয়েছিলেন মামিচ। এসব লেনদেনেই অবৈধ পন্থা অবলম্বনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল মামিচকে, ট্যাক্স ফাঁকি সহ কয়েকটি মামলায় গ্রেফতার করার পর। তিনি সেখানে দোষী প্রমাণিত হয়েছেন, তার সাজাও হয়েছে ৬ বছরের। 

    মামিচ অবশ্য পালিয়ে গেছেন বসনিয়া ও হার্জেগোভেনায়। তিনি আবার সেখানকারও নাগরিক, এবং ক্রোয়েশিয়া চাইলেই এখন তাকে এনে শাস্তি দিতে পারবেও না। 

    এই মামলায় সাক্ষী দিতে গিয়েই ফেঁসে গেছে মদ্রিচ। 

    ২০১৭ সালের জুনে লভরেনের সঙ্গে সাক্ষী দিতে গিয়ে মদ্রিচ বলেছেন, ডায়নামো ও আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরুর দিনগুলিতে তিনি ঠিক কতো আয় করতেন, তা তিনি “ঠিক মনে করতে পারেন না”। এবং চুক্তিপত্রে যেসব শর্ত নিয়ে অভিযোগের ভিত্তিতে এই মামলা, সেসব শর্ত তার টটেনহামে যাওয়ার আগে থেকেই ছিল বলে দাবি করেছিলেন তিনি। 

    তবে এই সাক্ষী তার আগের দেওয়া জবানবন্দির সঙ্গে সাংঘর্ষিক প্রমাণিত হওয়ার পরই আনা হয়েছে মিথ্যা সাক্ষীর এই অভিযোগ। বিশ্বকাপের পরই শুনানি শুরু হবে তার, দোষী প্রমাণিত হলে পাঁচ বছরের কারাদন্ডও হয়ে যেতে পারে মদ্রিচের। লভ্রেনের সাক্ষী নিয়েও তদন্ত হয়েছিল অবশ্য, তবে তার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আনা হয়নি। 

    এই মামিচ আবার বেশ ভাল বন্ধু ছিলেন ক্রোয়েশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্টের। তার নির্বাচনী তহবিলের অন্যতম দাতা ছিলেন মামিচ, প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথগ্রহণের অনুষ্ঠানে মামিচ ছিলেন ‘গেস্ট অব অনার’দের একজন। প্রেসিডেন্টের সম্মানে বেশ নিয়মিত পার্টিও আয়োজন করতেন তিনি। অবশ্য এতকিছু ফাঁস হয়েছে মামিচ মামলায় ফেঁসে যাওয়ার পরই। 


    ****

    এতোকিছু মাথায় নিয়েও এমন পারফরম্যান্স কিভাবে করছেন মদ্রিচ? 

    ঝুলন্ত ট্রান্সফারের চিন্তা থেকে বেরুতে পারেন না বলে ফুটবলারদের বসিয়ে রাখতে হয়, অথচ কারাভোগের সাজা হতে পারে, এমন কিছু মাথায় নিয়েও বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা পারফর্মার মদ্রিচ। অবশ্য এমন ফুটবলার থাকেন, যারা মাঠে নামলেই ভুলে যেতে পারেন সবকিছু। 

    লি বওয়ের তাই লাঞ্ছনার শুনানি মাথায় নিয়েও লিডসের হয়ে দারুণ পারফর্ম করে যেতে পারেন, বাবা অপহরণ হয়েছে জানার পরও মাঠে নেমে সবটা ঢেলে দিতে পারেন জন ওবি মিকেল। মদ্রিচও তেমনই একজন। 

    ক্রোয়েশিয়ার এই দলের প্রাণভোমড়া তিনি, দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরও শেষ ম্যাচে যে দুইজনকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখেননি ডালিচ, মদ্রিচ তাদের মধ্যে একজন। ক্রোয়াটদের এই দলের ফুটবল হয়তো এতোটাই আবর্তিত মদ্রিচকে ঘিরে। 

    অবশ্য তাতে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গী খুব একটা বদলাচ্ছে না। এ বিশ্বকাপেও যেমন দর্শককে দেখা গেছে, মদ্রিচের দশ নাম্বারের ওপর “আমার কিছু মনে নেই” অংকিত জার্সি পরে ক্রোয়েশিয়াকে সমর্থন দিতে। 

     


    মদ্রিচকে ঘিরে উল্লাস ক্রোয়েশিয়ার

     

    ইউরোর আগে ক্রোয়েশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ডেভর সুকার বলেছিলেন, “বড় টুর্নামেন্ট শুরু হলে আমরা সবাই চেকারস (ক্রোয়েশিয়ান)”। 

    বিশ্বকাপের এই সাফল্যের পর মদ্রিচের ব্যাপারেও কি হবে তেমনটিই? 

    সে আশার আলো অবশ্য নেই খুব একটা। 

    ক্রোয়াটদের ব্যাপারে যারা জানেন, তাদের মতে, মদ্রিচ আসলে তার সম্মানের জায়গাটা খুইয়েই বসেছেন। যারা মদ্রিচকে নিয়ে উল্লাসে মাতেন না, তার বেশ দৃঢ়প্রত্যয়ী। আর অন্যদের বিশ্বাস, বিশ্বকাপ শুধুই ফুটবলের ব্যাপার, যেখানে মদ্রিচ আগে থেকেই নায়ক। তবে তাকে নিয়ে মনোভাব বদলে যাবে সে সম্ভাবনা আদতে কম। 

     

     

    এরপরও অবশ্য প্রেসিডেন্ট গ্রাবার-কিতারোভিচের মতো কেউ কেউ তাদের স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবিটা ধরে রাখতে চান, ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল সাফল্যের নিজের উচ্ছ্বাসটা ঢালাওভাবে প্রচার করেন। তবে ক্রোয়াটরা এখন আর ফুটবলের মতো খেলায় রাজনৈতিক বা বেআইনী সম্পৃক্ততার চরম বিরোধী। এবং এতদিন ধরে চলে আসা এসব অনিয়মের ব্যাপারে যে খেলোয়াড়রাও চুপ করে ছিলেন, ক্রোয়েশিয়ার জনগণদের পছন্দ নয় সেটাও। 

     

             ক্রোয়েশিয়ার দেয়ালে মদ্রিচকে নিয়ে লেখাটার অর্থ দাঁড়ায়, 'তুমি একটা আবর্জনা'                

     

    কেউ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, কারও কাছে পারিপার্শ্বিকতা মিলিয়ে ফুটবল ঘিরে আর আগের মতো আবেগ নেই। আর কারও কারও কাছে, এটা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে অহর্নিশ। 

     

    লুকা মদ্রিচ হয়তো তাই বিশ্বকাপজয়ী কেউ হতে পারেন, গোটা বিশ্বে সমাদৃত হতে পারেন। ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট হতে পারেন ফুটবলপ্রেমে আলোচিত। 

    শুধু ক্রোয়েশিয়ার জনগণের কাছেই হয়তো মদ্রিচ আর তাদের ফুটবলটা ফিরবে না আগের জায়গায়। 


    তথ্যসূত্র
    দ্য গার্ডিয়ান
    ইএসপিএন
    ফেসবুক