• লা লিগা
  • " />

     

    যে শূন্যতা রেখে গেলেন রোনালদো

    যে শূন্যতা রেখে গেলেন রোনালদো    

    সারা সপ্তাহ, সারা মাস ধরে আপনি অপেক্ষা করছেন দিনটার জন্য। রবিবাসরীয় রাতে আপনি নির্ঘুম চোখে বসে আছেন, কখন শুরু হবে ম্যাচটা। একটু যদি ঘুম চোখে লেগেও থাকে, সেটা ম্যাজিকের মতো দূর করে দিলেন একজন। আপনি যদি রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থক হয়ে থাকেন, জার্সি খুলে গোল উদযাপনের ওই দৃশ্যটা প্রতিটি শিরায় উপশিরায় রোমাঞ্চ বইয়ে দিয়েছে। আর আপনি যদি বার্সেলোনা সমর্থক হয়ে থাকেন, খানিক পর লাল কার্ড দেখে তাঁর মাঠ ছাড়া আপনাকে দিয়েছে স্বস্তি। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো লোকটা আসলে এরকম। তাঁকে আপনি ভালোবাসতে পারেন, আবার চাইলে ঘৃণাও করতে পারেন। কিন্তু তাঁকে ছাড়া ক্লাসিকো আপনার কাছে মনে হতে পারে জিভে জল আনা সেই বিরিয়ানির মতো, ভুলে যেটাতে লবণ দেওয়া হয়নি।

    আপনার জন্ম যদি ৯০ এর পরে হয়, তাহলে আপনার লা লিগার স্মৃতির অনেকটা আকাশ রোনালদোর দখল করে রাখার কথা। কারও জন্য সেই আকাশে রোনালদো মানে একফালি সূর্য, আর কারও জন্য ঘনিয়ে আসা কালো মেঘ। লিওনেল মেসির বার্সেলোনা একটা সময় যখন স্পেনে দোর্দন্ড প্রতাপে রাজত্ব শুরু করেছিলেন, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে রোনালদো এসেছিলেন দলবদলের রেকর্ড গড়ে। রিয়ালের সিংহাসনটা তাঁর জন্য ছেড়ে দেওয়া ছিল আগে থেকেই, রোনালদো মুকুট পরে এরপর একের পর এক রাজ্য শুধু জয় করে গেছেন।

    একটু ভুল হলো অবশ্য। রোনালদোর জন্য ব্যাপারটা আসলে ততটা সহজ ছিল না শুরুতে। নিজের প্রথম এল ক্লাসিকোর কথাই ধরুন, ২০০৯ সালের সেই ম্যাচ নিজের করে নিয়েছিলেন ইব্রাহিমোভিচ। ফিরতি ম্যাচে রোনালদো আবারও ম্লান, লিগে নিজের ৪০তম গোল করে বার্সাকে জেতালেন মেসি। সেবারের লিগও পেয়েছিলেন মেসি, রোনালদো পাননি কিছুই।

     

     

    মাদ্রিদে আসার পর প্রথম তিন বছরে রোনালদোর কোনো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নেই, লা লিগা শুধু একটি। সেই রোনালদো পরের ছয় বছরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতলেন চার বার, এক বার জিতলেন লা লিগা। ক্লাসিকোতে রোনালদোর প্রথম জ্বলে ওঠা ২০১১ সালে, সেবার তাঁর হেডই ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল স্প্যানিশ সুপার কাপে।

     

    তবে চ্যাম্পিয়নস লিগ তখনও রোনালদোর কাছে মরিচীকা। ক্লাসিকোতে ইউরোপের মঞ্চে নিজেকে চেনানোর দারুণ একটা সুযোগ পেলেন ২০১১ সালে। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে রিয়ালের মুখোমুখি বার্সেলোনা। কদিন আগেই রোনালদো জিতে এসেছেন কোপা ডেল রে, আত্মবিশ্বাস তখন তুঙ্গে।

     

     

    কিন্তু হোসে মরিনহো ভাবলেন অন্য কিছু। ঠিক করলেন, গোল দেওয়ার চেয়ে গোল ঠেকানোটাই হবে মূলমন্ত্র। রোনালদো চেয়েছিলেন পিকেদের ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে, কিন্তু কোচের কৌশলে তাঁকে অনেকটাই খোলসে ঢুকে থাকতে হলো। রোনালদো নির্দেশ মানতে চাননি, কিন্তু একা তাঁর কিছুই করার ছিল না। শেষ পর্যন্ত লাল কার্ড দেখলেন পেপে, দশ জনের মাদ্রিদকে পেয়ে সুযোগটা হাতছাড়া করেননি মেসি। সেমিফাইনালে বার্সাই জিতল, কিছুদিন পর পুরনো ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে হারিয়ে বার্সার শিরোপা জয়টা রোনালদোকে দেখতে হয়েছিল টিভিতে।

     ব্যালন ডি অরেও তখন মেসির জয় জয়কার। ২০১৩ সালে মেসি সেটি জিতলেন চতুর্থ বারের মতো, রোনালদোকে তখন মনে হচ্ছিল অনেকটা ক্রোশ পথ পিছিয়ে। সেই ব্যবধান কমিয়ে আনার কাজ শুরু ২০১৩ সালের কোপা ডেল রে থেকে। সেমিতে আবার ক্লাসিকো, আবার গোল রোনালদোর। ন্যু ক্যাম্পে গোল পেলেন টানা ছয় ম্যাচে।

    সেবারই মরিনহো গেলেন, আনচেলত্তিকে পেয়ে রোনালদো যেন খুঁজে পেলেন একটা বটবৃক্ষ। যে লা ডেসিমার জন্য রিয়ালের অপেক্ষাটা মনে হচ্ছিল অনন্তকালের, সেই ট্রফি অবশেষে এলো বার্নাব্যুর শোকেসে। রোনালদো আবারও পেলেন ব্যালন ডি অর।

    পরের বছর মেসি চ্যাম্পিয়নস লিগ আর লা লিগা জিতে আবারও সেটি পেলেন বটে, কিন্তু রোনালদোকে সেটি যেন আরও তাতিয়ে দিল। জিনেদিন জিদান এলেন, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ হয়ে উঠল রিয়ালের জন্য মৌসুমের বাঁধাধরা ট্রফি। ব্যালন ডি অরেও আর হাত দিতে দেননি কাউকে। একটা সময় প্রশ্নটা যখন ছিল, ‘মেসিই কি সর্বকালের সেরা?’ সেই প্রশ্ন এবার হয়ে দাঁড়াল, ‘এই মুহূর্তে কে সেরা, মেসি না রোনালদো?’ ২০১৬-তেই ইউরো জিতে রোনালদো অমরত্বের দিকে আরেকটু পা বাড়ালেন। এর মধ্যে কয়েক বারই রিয়াল ছাড়ার গুঞ্জন উঠেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। রোনালদোও নতুন চুক্তির পর বললেন, মাদ্রিদে তিনি ভালোই আছেন, এটাই তাঁর ঘর। কিন্তু চিত্রনাট্যে তখনও বাকি ছিল আরও অনেক কিছুর।

    ব্যালন ডি অর আর ট্রফি বাদ দিলেও শুধু গোলের সংখ্যাটাই তো এই আধুনিক ফুটবলে প্রায় মিরাকলের মতো। ৪৩৮ ম্যাচে ৪৫০ গোল, এর মধ্যে লা লিগায় ৩১১টি। চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়ালের হয়েই ১০৫ গোল, সব প্রতিযোগিতা মিলে হ্যাটট্রিক ৪৪টি। দুই বার এক ম্যাচে করেছেন পাঁচ গোল। এসব এমনই এক পরিসংখ্যান, রিয়ালের হয়ে যা নেই ডি স্টেফানোর মতো কিংবদন্তিরও।

     

     

    কিন্তু লা লিগাকে শুধু গোলের পর গোলই দিয়ে গেছেন? পরিসংখ্যানে গোলই লেখা থাকবে। তবে লেখা থাকবে না, মেসির সঙ্গে এমন একটা দ্বৈরথের জন্ম দিয়ে গেছেন, যেটার সাক্ষী হতে পারাটাও পরম একটা সৌভাগ্য। দুই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর এই লড়াইয়ে কখনও মেসি এগিয়ে গেছেন, কখনো রোনালদো, কিন্তু ফুটবল শুধুই জিতেছে। তার চেয়েও বড় কথা, প্রিমিয়ার লিগ থেকে ছাড়িয়ে লা লিগা নিয়ে গেছেন নতুন উচ্চতায়, এল ক্লাসিকোর ৯০ মিনিটকে বানিয়ে গেছেন অফুরান এক বিনোদনের অমৃতভাণ্ডার। নিজে প্রমাণ করে গেছেন, পরিশ্রম দিয়ে যে কোনো ব্যবধান ঘোচানো সম্ভব। শুধু কথায় নয়, নিজের কাজেই সতীর্থদের দিয়ে গেছেন অফুরান প্রেরণা। যখন সমালোচনাটার তীর সবচেয়ে বেশি করে এসেছে, ততই যেন সেই আঘাত সয়ে আরও বেশি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ফিরে এসেছেন।

    রোনালদো জুভেন্টাসে যাচ্ছেন, কিন্তু রিয়াল আর লা লিগাকে দিয়ে গেছেন পরিশ্রম আর হার না মানার সেই চিরন্তন শিক্ষা। আর আমাদের মতো দর্শকদের দিয়ে গেছেন মেসির সঙ্গে এমন একটা দ্বৈরথ, যেটা হয়তো আর ফিরবে না কখনোই।