• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    লাল মস্কোতে ফ্রান্সের নীল উৎসব

    লাল মস্কোতে ফ্রান্সের নীল উৎসব    




    ৬ কেজি ওজনের ১৮ ক্যারেট সোনা মোড়ানো শিরোপাটা উঁচিয়ে ধরার ম্যাচ। এক দলের আজীবনের আক্ষেপ, আরেক দল ফিরবে সেই স্বপ্নপূরণ করে। ৩১ দিনশেষে আবারও সেই সমীকরণের সামনে দাঁড় করে দিয়েছিল বিশ্বকাপ। রোমাঞ্চ আর শিহরণ জাগানো মুহুর্তের জন্ম দিয়ে যেটা আগেই ইতিহাসে ঢুকে গিয়েছিল। রাশিয়ার বিশ্বকাপের ফাইনালটা হলো রাশিয়া বিশ্বকাপের মতোই, আর বাকি দশটা বিশ্বকাপ থেকেও যেটা আলাদা। লুঝনিকির মঞ্চে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দিদিয়ের দেশমের ফ্রান্স হাঁটল অমরত্বের পথে, বিশ্বকাপ শিরোপা উঁচিয়ে ধরতে। আর ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্নযাত্রার থামল ওই সিঁড়ি দিয়ে নেমেই, রানার আপের মেডেল গলায় পরে।



    ক্রোয়েশিয়াকে ৪-২ গোলে হারিয়ে ফ্রান্স পরেছে সোনার মুকুট। আর্জেন্টিনা আর উরুগুয়ের সঙ্গে এখন একই কাতারে তারা, সবাই দুই বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। একটা বিশ্বকাপ ফাইনাল থেকে যতটুকু চাওয়ার থাকতে পারে, তার সবটুকুই পূরণ করেছেন লুঝনিকি। গোল, বিতর্ক, রোমাঞ্চ- কিছুই বাদ গেল না। পুরো বিশ্বকাপ যে ধারায় চলেছে, তার শেষটা হয়েছে রাজকীয়ভাবে। ফ্রান্সকে সপ্তম স্বর্গে পৌঁছে দিয়েছেন সেই দেশমই। ২০ বছর আগে অধিনায়ক হিসেবে ফ্রান্সের প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছিলেন, দ্বিতীয়টা ধরলেন কোচ হিসেবে। ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের পর প্রথম কেউ অধিনায়ক আর কোচ হিসেবে জিতলেন বিশ্বকাপ। খেলোয়াড় আর কোচ হয়ে বিশ্বকাপ জেতার তালিকাটা আরেকটু বড়, একজনের, সেখানে আছেন ব্রাজিলের মারিও জাগালো।

    ম্যাচ শেষে ‘ফিল দ্য ম্যাজিক ইন দি এয়ার’ গানের সঙ্গে ‘লা ব্লুজদের’ উৎসব মিশে গেছে। তার আগেই মস্কোর উৎসবটা ছড়িয়ে পড়েছে প্যারিসের রাস্তায়, সেখান থেকে গোটা ফ্রান্সে লাখ লাখ মানুষের মাঝে। ২০১৬ ইউরোর ফাইনালে ঘরের মাঠে এই গানটাই ছিল বাজার অপেক্ষায়। বেজেছিলও, কিন্তু তাতে উৎসবে মেতেছিল পর্তুগাল। সেই দুঃস্বপ্নও আজ ভুলেছেন দেশম, ভুলেছে পুরো ফ্রান্স। ফাইনালে 'ম্যাজিক'টা বুঝতে ফ্রান্সের লেগেছে ১৮ মিনিট। ক্রোয়েশিয়া দারুণ শুরুর পরও পিছিয়ে পড়েছে। সেটাও নিজেদের দোষে। আঁতোয়া গ্রিযমানের ফ্রি-কিক ডিফেন্ড করতে লাফ দিয়েছিলেন মারিও মাঞ্জুকিচ। সেমিফাইনালে ক্রোয়াটদের হিরো তাতেই বিপদ ডেকে আনলেন দলের। তার মাথায় লেগে বল ঢুকে গেল নিজের জালে। মাঞ্জুকিচ হয়ে গেলেন বিশ্বকাপের ফাইনালে আত্মঘাতী গোল করা প্রথম খেলোয়াড়। ম্যাজিকের মতোই এগিয়ে গেল ফ্রান্স।



    আত্মঘাতী গোলের দিক দিয়ে এই বিশ্বকাপ ছাগেই ছাড়িয়ে গিয়েছিল আগের সবগুলোকে। বিশ্বকাপের ফাইনালও পিছু ছাড়ল না এবার। কিন্তু এই ক্রোয়েশিয়াকে তো দমিয়ে রাখা যায় না। নক আউট পর্ব প্রতিবারই তারা পিছিয়ে পড়েছে, প্রতিবারই সেখান থেকে ফিরে এসেছে। ফাইনালেও ফিরে আসল ক্রোয়াটরা, ১০ মিনিটের ব্যবধানে। ইভান পেরিসিচের বাঁ পায়ের দারুণ শট জড়াল ফ্রান্সের জালে, খেলায় সমতা। এর আগে ১১ মিনিটে রাকিটিচের বাড়ানো বল থেকেই পেরিসিচ একটা দারুণ সুযোগ পেতে পারতেন, কিন্তু সে দফায় বাঁ পায়ে বলটা নামাতেই পারেননি ভালোমতো।

    শুরু থেকেই অনুমিত কৌশলেই খেলছিল দুই দল; ফ্রান্স নিজেদের অর্ধে, আর ক্রোয়েশিয়া বল পায়ে পজেশন ধরে রেখে। ২৮ মিনিটেই আবার যখন একই বিন্দুতে ফিরে আসলো খেলা, এরপরও খুব বেশি বদলালো না দুইদলের খেলার ধরন। কিন্তু ৩৪ মিনিটে সবকিছু বদলে গেল আবার। একটা কর্নার থেকেই ব্লেইস মাতুইদি হেড করেছিলেন, কিন্তু সেটা লাগলো তার পেছনে থাকা পেরিসিচের হাতে। ভিএআরের বিশ্বকাপে, ফাইনালেও দরকার হলো ভিএআর। রেফারি প্রথমে পেনাল্টি দেননি, পরে মাঠের বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত বদলালেন, পেরিসিচের  আজীবন মনে রাখার মতো ফাইনাল হুট করেই হয়ে গেল ভুলে যাওয়ার মত। ড্যানিয়েল সুবাসিচ হয়ে দুইবার টাইব্রেকার জিতিয়েছেন, কিন্তু আজ রঙ হারালেন। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন পেনাল্টি থেকে গোল করলেন গ্রিযমান। প্রথমার্ধ শেষের আগে আরও একবার ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছিল ক্রোয়েশিয়া, কিন্তু সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারল না আর তারা।



    দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেও আক্রমণাত্মক ক্রোয়েশিয়া। ৪৮ মিনিটে রাকিটিচের পাস, শট করলেন রেবিচ, সেটা গোলই হত। কিন্তু উগো লরিস বাধা হয়ে দাঁড়ালেন, তার শক্ত হাত ভেঙে আর গোল পাওয়া হলো না ক্রোয়েশিয়ার। মিনিট খানেক পর ভারান করলেন একটা ভুল, সেখান থেকে বল পেলেন মাঞ্জুকিচ, তিনিও শাপমোচন করতে পারলেন না। ক্রোয়াটদের কর্তৃত্বও শেষ ওখানেই। ফ্রান্স কেন এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে গোছানো দল সেই প্রমাণটা আগেই পেয়েছে আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম। এবার পেল ক্রোয়েশিয়াও।  

    ৫১ মিনিটে ডিবক্সের বাইরে থেকে বল পেয়েছিলেন পল পগবা। বাঁ পায়ের শটে দারুণ এক গোল করে ক্রোয়েশিয়াকে তখনই ম্যাচ থেকে ছিটকে দিলেন ফ্রেঞ্চ মিডফিল্ডার। এই বিশ্বকাপে জিদান হতে চেয়েছিলেন পগবা, গ্রিযমানরা- সেটা হয়েছেনও শেষ পর্যন্ত। কিন্তু ফ্রান্সের আক্রমণভাগের আরেক তরুণ খেলোয়াড় স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি। কিলিয়ান এমবাপ্পে আজও শুরু থেকে গতি আর ড্রিবলিং দিয়ে তটস্থ করে রেখেছিলেন প্রতিপক্ষের রক্ষণকে। প্রথমার্ধে একবার ডিবক্সের ভেতর ঢুকেছিলেন, ক্রস করেছিলেন কিন্তু সেটা থেকে ক্রোয়াটদের কাঁদাতে পারেননি। পরে আরেকবার ঢুকে শটও করেছিলেন, কিন্তু সুবাসিচ বঞ্চিত করেছিলেন তাকে। ৬৫ মিনিটে আর এমবাপ্পেকে আটকানো গেল না। ডিবক্সের বাইরে থেকেই শট নিলেন, গোল করে তিনি চলে গেলেন পেলের কাতারে। বিশ্বকাপের ফাইনালে টিনএজার হিসেবে শেষ গোল করেছিলেন পেলে, এবার করলেন এমবাপ্পে।

    ফ্রান্সের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জেতা তখন সময়ের ব্যাপার। কিন্তু শিরোপাটা উঁচিয়ে ধরার আগে লরিসকে পার করতে হলো একটা অস্বস্তিকর মুহুর্ত। ৬৯ মিনিটে তার ভুলেই গোল খেয়ে বসে ফ্রান্স, মাঞ্জুকিচ করলেন গোল। বিশ্বকাপজুড়ে চলা গোলরক্ষকদের হাস্যকর ভুলের অধ্যায়টাও বাদ গেল না ফাইনালেও! তাতে ক্ষণিকের জন্য স্বস্তি ফিরে এসেছিল ক্রোয়াটদের, কিন্তু রূপকথার মতো ফিরে আসার গল্পটা আর লেখা হয়নি তাদের। ফ্রান্সের জমাট বাধা রক্ষণ হতাশই করেছে ক্রোয়েশিয়াকে। ইতিহাসও তাই আর বদলানো হয়নি।  

    ম্যাচ শেষে মস্কোর মাঠে আকাশ ভেঙে নেমে আসল বৃষ্টি। সেটা মিশে গেল ফরাসি উৎসবের সঙ্গে। আর ক্রোয়াট জন্য সেই বৃষ্টি মন খারাপ করা। ছল ছল চোখে মদ্রিচ, রাকিটিচরা দেখলেন ফ্রান্সের উৎসব। পাওয়া না পাওয়ার দূরত্ব অতোটুকুই, তবে এই ফাইনালে দুই দলের দূরত্বটা বোঝা গেল ভালোভাবেই। ফ্রান্স বিশ্বকাপটা জিতল যোগ্য চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই।