১ বল খেলেই 'সেট' হয়ে গেলেন তামিম
সেট ব্যাটসম্যান, সেট না হওয়া ব্যাটসম্যান। ঠিক কয়টা বল খেললে তাকে সেট বলা যায়? সংখ্যার দিক দিয়ে এর কোনও মাপকাঠি নেই। ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায়, ব্যাটসম্যানের স্কোরিং রেটকে কোনও একটা প্রোগ্রামে ফেলে হয়তো আপনি কিছু একটা বের করতে পারেন। ক্রিকেটে ডাটা অ্যানালাইসিস অন্য পর্যায়ে চলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে- এসবও বের হতে পারে শীঘ্রই।
তবে এই সেট হওয়ার ব্যাপারটা কিছুটা অনুভূতির মতো ব্যাপার। সবার আগে ব্যাটসম্যানের অনুভূতি। হয়তো প্রথম বল থেকেই ব্যাটের সুইট স্পটে লাগাতে পারছেন, মানসিক দিক দিয়ে তিনি হয়তো সেট হয়ে যাবেন তখনই। এরপর বোলার, বিপক্ষ দলের অধিনায়ক, দর্শক, বিশ্লেষকদের অনুভূতি। তবে সেট হোন বা না হোন- প্রতিটি ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রেই একটি তথ্য ভীষণভাবে সত্য- আউট হতে আপনার প্রয়োজন মোটে একটি বল।
তামিম ইকবাল অপরাজিত থাকতে খেললেন একটি বলই। 'সেট' হতে খেললেন একটি বলই।
চোট পেয়ে মাঠ ছাড়ার পর দলের “প্রয়োজনে” বা “ব্যক্তিগত তাড়নায়” সেই চোট নিয়েই মাঠে ফেরার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। তবে তামিমের গল্পটা একটু ভিন্ন।
****
নিল অ্যাডকক ও ডেভিড আয়রনসাইডের বল সেদিন জোহানেসবার্গে কথা বলছিল অন্য সুরে। তাদের দুজনের কারও এক বাউন্সারে ভূপাতিত বার্ট সাটক্লিফ। কানের লতি ছিঁড়ে দুভাগ হয়ে গেছে। রক্ত পড়ছে, স্ট্রেচার আসছে। স্ট্রেচারকে না করে সাটক্লিফ হেঁটেই মাঠ ছেড়েছিলেন, এরপর হাসপাতাল। এক্সরেতে চিড় ছিল না, তবে ডাক্তারের কড়া বারণ, পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে তাকে। খেলা তো দূরের কথা।
৫ উইকেট নেই, নিউজিল্যান্ডের পরের ব্যাটসম্যানদের কাছে ফলো-অন থেকে ৪০ রানের দূরত্বটাই তখন দীর্ঘ সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার মতো। সাটক্লিফ নেমে পড়লেন, ব্যান্ডেজ গলে তখনও রক্ত পড়ছে কয়েকফোঁটা। ১১২ মিনিটে চার চার ও সাত ছয়, সাটক্লিফ অপরাজিত ৮০ রানে। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে তার সঙ্গে এরপর যোগ দিলেন বব ব্লেয়ার। আগের রাতে যিনি খবর পেয়েছেন, রেল দূর্ঘটনায় মারা গেছেন তার বাগদত্তা। হোটেলে রুম বন্ধ করে বসে আছেন রেডিওর সামনে, সঙ্গ দেওয়ার জন্য ম্যানেজার, সেদিন আর মাঠে আসবেন না। দলের অবস্থা শুনে বুঝলেন, সাটক্লিফের আরেকজন সঙ্গী দরকার। ট্যাক্সি করে সোজা মাঠে। একদিকে ব্যান্ডেজ নিয়ে সাটক্লিফ, আরেকদিকে সদ্য বাগদত্তা হারানো তরুণ। দুজন মিলে ইতিহাসের অন্যতম কিপটে বোলার হিউ টায়ফিল্ডকে বানিয়ে দিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে খরুচে ওভারের মালিক হিসেবে, অন্তত পঞ্চাশ বছরের জন্য! রুপকথার জন্য এর বেশি আর কী লাগে!
সেই ফলো-অনটা তারা পেরিয়েছিলেন। জয়টা পাননি। সাটক্লিফ ক্যারিয়ারে কখনও ম্যাচ জেতেননি। তবে সেদিন সাটক্লিফরা হেরেছিলেন, এমন কথা কে বলবে!
কাউড্রি অবশ্য “সফল” ছিলেন।
শেষ ওভারে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ৬ রান, বাকি ১ উইকেট, ২ বল। তবে সে উইকেটটা কলিন কাউড্রির, যার এক হাত ভেঙেছে সে ম্যাচেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্টটা তখনোই হেরে যেত ইংল্যান্ড, যদি এক হাতে প্লাস্টার আরেক হাতে ব্যাট নিয়ে কাউড্রি নেমে না পড়তেন! নবম উইকেট পড়ার সময় ব্যাটসম্যানরা ক্রস করেছিলেন, কাউড্রি তাই নন-স্ট্রাইকে। ডেভিড অ্যালেন ওয়েস হলের দুই বল ঠেকিয়ে দিলেন, ম্যাচ ড্র! কাউড্রি শুধু মাঠে নেমেই ইতিহাস হয়ে গেলেন।
মার্শালের এক হাতের জাদু, হেডিংলিতে
ম্যাককোস্কার প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৪ রান, দ্বিতীয় ইনিংসে ২৫। টেস্টের একদিনও ফিল্ডিং করেননি। এমসিজির সেই টেস্টের কারণে তবুও তাকে মনে রেখেছে ক্রিকেট।
প্রথম ইনিংসে বব উইলিসের বলে স্টাম্পের সঙ্গে চোয়াল ভেঙেছিল রিক ম্যাককোস্কারের। এরপর হাসপাতালে দেড়দিন। ডেনিস লিলিরা ইংল্যান্ডকে আটকে দিলেন কম রানেই। দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৫৩ রানে ৮ম উইকেট পড়লো অস্ট্রেলিয়ার। তবে লিডটা ঠিক যথেষ্ট নয়, পরে প্রমাণিত হয়েছিল সেটাই। ভাঙা চোয়াল নিয়ে নেমে পড়লেন ম্যাককোস্কার। তিনি খেলেছিলেন ৬৮ বল। অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল ৪৫ রানে। নবম উইকেটে রড মার্শের সঙ্গে ম্যাককোস্কার করেছিলেন ৫৪ রান।
মার্শাল আদতেই এক হাতেই জিতিয়ে দিতে পারতেন ম্যাচ! হেডিংলিতে করেছিলেন সেটাই।
নবম উইকেটে মাইকেল হোল্ডিংকে নিয়ে ৮০ রান যোগ করেছিলেন ল্যারি গোমেজ। তবে গোমেজকে ৯৬ রানে ফেলে আউট হয়ে গেলেন হোল্ডিং। বাকি শুধু ম্যালকম মার্শাল, প্রথমদিন সকালেই যার বাঁহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ভেঙেছে। মার্শাল প্লাস্টার নিয়ে নামলেন। দুই হাতে ব্যাট ধরছিলেন বলের আগ পর্যন্ত, এরপর খেলছিলেন এক হাতে। তার অদ্ভুত ব্যাটিংয়ে হাসছিলেন ইংলিশরা, হাসছিলেন “ম্যাচো” নিজেও। তবে গোমেজকে সেঞ্চুরি করানো পর্যন্ত টিকেছিলেন ঠিকই। এরপর বোলিংয়ে ৫৩ রানে নিয়েছিলেন ৭ উইকেট।
মাঠে সবাই খেলবেন, আর কুম্বলে বাইরে থেকে দেখবেন, তা কী করে হয়! হোক না, চোয়াল ভেঙেছে। হোক না, পরদিন তার দেশে ফেরার ফ্লাইট। হোক না দেশে ফিরেই তার অস্ত্রোপচার!
এরও আগে ভাঙা চোয়াল নিয়েই ব্যাটিং করেছিলেন অনীল কুম্বলে, যদিও চোয়ালের সেই অবস্থাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি তখনও। সিরিজ ১-১ এ ড্র ছিল, ভারতের বড় সংগ্রহের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজও এগুচ্ছিল সে পথেই। ভারত অধিনায়ক অ্যান্টিগায় বোলিং করিয়েছিলেন ১১ জনকে দিয়েই। সে তালিকায় ছিলেন ভাঙা চোয়াল নিয়ে টানা ১৪ ওভার বোলিং করা কুম্বলেও। “ইতিহাসের একমাত্র বোলার” হিসেবে ভাঙা চোয়াল নিয়ে আউট করেছিলেন ব্রায়ান লারাকে। কুম্বলে বোলিং না করলেও সে ম্যাচের চিত্রটা বদলাতো না, তবে দেশে ফেরার আগে “সব দিয়েছি” মন্ত্রটা উজ্জীবিত করেছিল তাকে।
সেদিন হেলমেট পরার অবস্থায় ছিলেন না ম্যাককোস্কার
গ্যারি কার্স্টেনের নাক ভেঙেছিল শোয়েব আখতারের বলে, ৫৩ রানে প্রথম ইনিংসে উঠে যেতে হয়েছিল তাকে। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে দলের স্কোর যখন কার্যত ৬৮ রানে ৪ উইকেট, নেমে পড়েছিলেন কারস্টেন। কালশিটে দাগে তাকে চেনায় যায় না! সে অবস্থাতেই করলেন ৪৬, লিডটা গেল ১৬০ পর্যন্ত। পাকিস্তান অবশ্য লাহোরে জিতেছিল ৮ উইকেটেই।
সিডনি টেস্টের আগেই অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকা জিতেছিল সিরিজ।
তবুও গ্রায়েম স্মিথ নেমেছিলেন ভাঙা হাত নিয়ে, শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে। ম্যাচে বাকি ৮.২ ওভার। জ্যাক ক্যালিসের শার্ট, ব্যাট মুড়ে রাখেন যে ট্রাউজারস দিয়ে- সেসব পড়ে নেমে পড়লেন ব্যাটিংয়ে। আরেকপ্রান্তে মাখায়া এনটিনিকে নিয়ে ১৭ বল খেললেন স্মিথ, তবে ১০ বল বাকি থাকতে মিচেল জনসনের বলে হলেন বোল্ড। জনসনের বলেই হাত ভেঙেছিল তার।
ব্রিস্টলে শেষ ওভারে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল ১০ রান, জোনাথন ট্রট অপরাজিত ৯০ রানে। ফিল্ডিংয়ের সময় পায়ের পাতা ভেঙে গেছে ইয়ান বেলের। তিনি যখন রানার এওইন মরগানকে নিয়ে নামছেন, এক পায়ের চেয়ে আরেক পায়ের প্যাডের আকারের পার্থক্যটা খোলা চোখেই স্পষ্ট, তার নিচে যে প্লাস্টার! ট্রট আউট হলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে প্রথম ওয়ানডে পরাজয় ঠেকাতে পারলেন না বেল, সতীর্থের কাঁধে ভর দিয়ে শুধু মাঠ ছাড়তে হলো।
****
আর তারপর। তামিম ইকবাল।
খানিক আগে স্লিংয়ে হাতটা ঝুলছিল। সে হাত নিয়ে নেমে পড়লেন। এশিয়া কাপের প্রথম ম্যাচ, প্রথম ইনিংস। বাকি তিন ওভার এক বল। দলের স্কোর ২২৯। দুবাইয়ের এ মাঠে ২১০ রান করেও ৬৬ রানে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে জিতেছিল পাকিস্তান। ২৮৫ রান করেও আবার হেরেছিল শ্রীলঙ্কার কাছেই। মুশফিকুর রহিমের সেঞ্চুরিও হয়ে গেছে আগেই। ওয়ানডে ম্যাচের প্রথম ইনিংস, ম্যাচ বাঁচানো বা পরাজয় ঠেকানোর প্রশ্ন ওঠে না তাই।
তবুও নামলেন তামিম। সুরাঙ্গা লাকমালের বাউন্সারে চোট পেয়েছিলেন, সেই তারই আরেকটা লাফিয়ে ওঠা বল খেললেন এক হাতে। তাও আবার ডানহাতে, তার ব্যাটিংয়ের কম শক্তিশালি যেটি।
মুশফিকের ওপর এরপর অন্য কিছু ভর করলো। ১৫ বলে তুললেন ৩২ রান। হয়তো আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়লো সবার মাঝে।
তামিম না নামলে বাংলাদেশ ২২৯ রানেই অল-আউট হয়ে যেতো। তবুও ম্যাচশেষের ফল বলছে, বাংলাদেশ জিতেছে ১৩৭ রানে, শেষ উইকেটের সেই ৩২ রানের চেয়ে আরও ১০৫ রান বেশিতে। ২২৯ রানে অল-আউট হয়ে যাওয়ার পরও হয়তো বোলারদের উজ্জীবিত করতে পারতেন মাশরাফি। শ্রীলঙ্কার ইনিংসে হয়তো তবুও নামতো ধস।
সাটক্লিফ ফলো-অন বাঁচাতে নেমেছিলেন। কাউড্রি, স্মিথ নেমেছিলেন ম্যাচ বাঁচাতে। বেল নেমেছিলেন জেতার জন্য। ম্যাককোস্কার, কারস্টেন লিড বাড়াতে নেমেছিলেন, একজন সফল ছিলেন, আরেকজন নন। মার্শালের সামনে ছিলেন ৯৬ রানে অপরাজিত সঙ্গী। কুম্বলে মাঠের বাইরে বসে থাকতে পারেননি বোলিংয়ের নেশায়।
সাহস, নিবেদন, বিস্ময়-জাগানিয়া ত্যাগসহ আরও অনেক অনেক শব্দ প্রয়োজন আর সবার মতো তামিমের ক্ষেত্রেও। তবে এরপরও তামিম আরেকটু চিন্তা-ভাবনা দাবি করছেন, ব্যাখ্যা দাবি করছেন। আর সে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে- ব্যাপারটা সেট হওয়ার মতো।
তামিম এদিন ৩ বলে ২ রান করে ‘রিটায়ার্ড হার্ট’ হয়েছিলেন। সেভাবেই থাকতে পারতেন। এরপর এক হাতে আরও ১ বল খেলে ৪ বলে ২ রানে থাকলেন অপরাজিত।
ওই ১ বলেই তামিম ইকবাল খান ‘সেট’ হয়ে গেলেন “ক্রিকেটের জীবন ছাপিয়ে যাওয়া কিছু-মুহুর্ত”-র ফ্রেমে। তার গল্পটাও তাই ভিন্ন হয়ে গেল আরেকটু।