• এশিয়া কাপ ২০১৮
  • " />

     

    শেনওয়ারির ব্যাট উড়ে গেল, মুস্তাফিজকে নিয়ে সংশয়গুলো?

    শেনওয়ারির ব্যাট উড়ে গেল, মুস্তাফিজকে নিয়ে সংশয়গুলো?    

    রশীদ খান, ‘দ্য সুপারস্টার অফ আফগানিস্তান’। শুধু বোলিং নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে ঠিক আগের ম্যাচটাই রশিদ জিতিয়েছেন ব্যাটিংয়েও। বাংলাদেশের সঙ্গে বাঁচা-মরার ম্যাচেও বলের সঙ্গে যখন দূরত্বটা বাড়ছে রানের, আফগানদের মাঝে যেন হাহাকার- রশীদ কই! তারা রশীদকে খুঁজছিলেন। সেই রশীদ। বাকি ৬ বল। দরকার ৮ রান। সামনে মুস্তাফিজুর রহমান। ‘দ্য ফিজ’। অভিষেকে যার আলোতে ঝলসে গিয়েছিল অনেকের চোখ। এরপর চোট, আর এরপর যেন শুধু হাহাকার। মুস্তাফিজের বোলিং একটু এলোমেলো হলেই কথা ওঠে, ‘মুস্তাফিজ আর নেই সেই মুস্তাফিজ’। ‘সেই মুস্তাফিজ কই গেল?’।  

    রশীদ বনাম মুস্তাফিজ। ‘দ্য সুপারস্টার অফ আফগানিস্তান’ বনাম ‘দ্য ফিজ’। প্রস্তুত দ্বৈরথের মঞ্চ। পুরষ্কার পুরো জ্যাকপট। হয় বগলদাবা করে বাড়ি ফিরবেন, নাহয় সব খোয়াবেন। 


    **** 

    ৪৬তম ওভারটা শুরুতে মাশরাফিই করতে চাইলেন। এদিন দুইটা গুরুত্বপূর্ণ উইকেট নিয়েছেন, তবে খরচের গ্রাফটা একটু উঁচুর দিকে ছিল তার। তার দলের ওপর দিয়ে গত কয়েকদিনে কম ধকল যায়নি। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে জয়টা যেন সুদূরে মিলিয়ে গেছে। আফগানিস্তান এরপর মাটিতে নামিয়ে এনেছে বাংলাদেশকে। ভারত চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে পার্থক্যটা। হুট করেই এশিয়া কাপের স্কোয়াডে যুক্ত হয়েছেন দুইজন ওপেনার, যে ব্যাপারে কিছুই জানতেন না মাশরাফি। সেই দুই ওপেনারের একজন খেললেন আজ, ছয় নাম্বারে। এর আগে ৭০ ইনিংসের ক্যারিয়ারে এতো নিচে কখনও খেলেননি ইমরুল। 

    মাশরাফি বোলিংয়ে এলেন না। মুস্তাফিজের বাকি তখন ৪ ওভার। মাশরাফির নিজের বাকি একটি। সাকিবের দুইটি। সে ওভারটা দিলে মুস্তাফিজকে দিয়ে করাতে পারবেন তিনটি ওভার। শেষ মুহুর্তে সিদ্ধান্তটা বদলালেন মাশরাফি। মুস্তাফিজকে নিয়ে মাশরাফির সন্দেহ বা সংশয় ছিল না। 

    এক বল পর শুয়ে পড়লেন মুস্তাফিজ। সতীর্থদের আনাগোণা। চোট কম খেল দেখায়নি বাংলাদেশকে এ কয়দিনে, এমন মুহুর্তে আবার আরেকটা? ফিজিও এলেন। মুস্তাফিজ উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু মুস্তাফিজ কি ফিরবেন আবার আগের মতো? মুস্তাফিজ কি থাকবেন সেই মুস্তাফিজ? সংশয়বাদীদের সেই সন্দেহটা মাথাচাড়া দেওয়ার কথা সে সময়। 

    পঞ্চম বলে নবীকে বেশি জায়গা দিয়ে ফেললেন মুস্তাফিজ। চার। আফগানিস্তানের এ স্কোয়াডে নবীর চেয়ে আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান আর কেউ নেই। ক্রিকভিজের ডাটা অনুযায়ী, নবী ক্রিজে আসার পর তার আক্রমণাত্মক শটে প্রতি ওভারে ৯.৬১ হারে রান তোলেন। নবী মুস্তাফিজকে পাত্তা দিলেন না। নবী সেটাই করলেন, যা করে থাকেন। 


    **** 

    ‘আমার কাছে মনে হয়, এখন যেটা ঘটছে সেটাই স্বাভাবিক। এর আগে যেটা ঘটেছে, সেটাই অস্বাভাবিক ছিল। আন্তর্জাতিকে আপনি এসেই চার-পাঁচ ম্যাচে ত্রিশ উইকেট পাবেন, এটা অবিশ্বাস্য।’

    মাশরাফির কথা বলছিলেন মুস্তাফিজকে নিয়ে। বছরখানেক আগে। মুস্তাফিজের কী হলো, মুস্তাফিজ কেন আগের মতো নেই- সেদিনও এমন প্রশ্নই গিয়েছিল অধিনায়কের দিকে। মাশরাফি বাস্তবতাটা বুঝিয়েছিলেন। 

     

     

    ‘এখন যেটা করতে হবে, ওকে কষ্ট করে উইকেট নিতে হবে। ওকে ব্যাটসম্যানরা ভাল পড়তে পারছে। প্রত্যেক দলেই উঁচুমানের ভিডিও বিশ্লেষক আছে। তারা ওর শক্তিশালী দিকগুলো বের করছে।’

    মুস্তাফিজকে এখন ক্রিকেট বিশ্বের অনেকেই চেনেন। ব্রেট লি বা ডিন জোন্স বা কুমার সাঙ্গাকারা- এশিয়া কাপের কমেন্ট্রিতেও তারা বলে দিতে পারেন, মুস্তাফিজের শক্তি কী, মুস্তাফিজ কেন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেন। 

    মুস্তাফিজ নিজে যতোই নির্লিপ্ত থাকুন, চাপ তো থাকেই তার ওপর! 

    ‘আমরা যদি তাকে চাপমুক্ত রাখতে পারি, ও যেটা করে এসেছে সেদিকে না তাকিয়ে বাস্তবতা মেনে নেই, সে তাহলে পরবর্তী দশ বছরে আমাদের জন্য অনেক বড় সম্পদ হবে’, মাশরাফি বলেছিলেন সেদিন। 


    **** 


    ক্রিকভিজ অনুযায়ী, মুস্তাফিজের একটা মিশ্র ম্যাচ গেছে এদিন। ডেথ ওভারে ১২০ কিলোমিটারের নীচে করা তার ডেলিভারি ওভারপ্রতি রান খরচ করে সাধারণত ৫.১৪ করে। এদিন আফগানিস্তান তুলেছে দশের ওপরে রান। ডেথ ওভারে একটা সময় তার বোলিংয়ের মাত্র ১৬.৬ শতাংশ গুডলেংথে করেছিলেন তিনি, ম্যাচের এমন পর্যায়ে ক্যারিয়ারে এর চেয়ে কম গুডেলংথ ডেলিভারি ছিল না তার। মুস্তাফিজ আজ ‘অফ’ ছিলেন। এই দিনটি হয়তো তার হওয়ার কথা ছিল না। 

    ফাইন লেগ ওপরে নিয়ে লেগস্টাম্পের বাইরে বলটা করলেন মুস্তাফিজ। সুযোগটা নিলেন নবী। শর্ট ফাইন লেগে মাশরাফি শুধু একরাশ হতাশা নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন। চাপটা ফিরে এলো বাংলাদেশের ওপর। মুস্তাফিজকে দিয়ে তখনও শেষ ওভারটা করানো বাকি মাশরাফির। এদিন আফগান ব্যাটসম্যানরা দুইটি বল একেবারেই ছেড়ে দিয়েছেন খেলার চেষ্টা না করে। দুটিই মুস্তাফিজের বলে। 

    ক্রিকভিজের ‘উইনভিজ’ বা ‘কে জিতছে’ প্রেডিকশনে আফগানিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে ছিল মাত্র দুইটি ডেলিভারিতে। মোহাম্মদ নবী ও রশিদ খান আউট হওয়ার ঠিক আগের সময়ে। 

    নবীকে ফেরালেন সাকিব, রীতিমতো জুয়া খেললেন। আগের বলে নবী শুরুতে কিছুটা জায়গা বানানোর ‘অভিনয়’ করলেন, সরে এলেন। সাকিব ঝুলিয়েই দিলেন। নবীর সোজা হিটে ছয়, আফগানিস্তানের জয়ের প্রয়োজনটা নেমে এলো ১০ বলে ১২ রানে। পরের বলে আবার ঝুলিয়ে দিলেন সাকিব, একটু ভেতরের দিক করে। নবী লো-ফুলটস করে মারতে গিয়ে ক্যাচ। সাকিব পরের তিন বলে দিলেন চার রান। মুস্তাফিজের জন্য রাখলেন আট। 

    আর মুস্তাফিজের সামনে থাকলেন রশীদ। 


    **** 


    মুস্তাফিজের অফকাটারটা আগেই বুঝেছিলেন রশীদ, পেছনে গিয়ে খেললেন। আফগান তারকা যেন ছাপিয়ে গেলেন বাংলাদেশের জনকে। মুস্তাফিজ এর আগে শর্ট বল করতে গিয়ে ওয়াইড দিয়েছেন, শর্ট বলের ফাঁদে শেনওয়ারিকে ফেলেও ফিল্ডার শান্তর ভুলে খেয়েছেন চার। 

    আবার করলেন শর্টই। 

    রশীদ পুল করতে গেলেন। বলটা উঠছিল, সঙ্গে অ্যাঙ্গেল মিলিয়ে মোমেন্টামটা ঠিক বাউন্ডারির দিকে সরাতে পারলেন না রশীদ। খাড়া উঠলো। অনায়াস ভঙিমায়, জায়গায় দাঁড়িয়ে ক্যাচটা নিলেন মুস্তাফিজ। রশীদের কাছ থেকে মঞ্চের আলোটা কাড়লেন। 

    এরপর শেনওয়ারিকে বিট করলেন। গুলবাদিনকে করলেন। আবার শেনওয়ারিকে বিট করলেন। মুস্তাফিজ শেষ চার বলে আদতে কোনও রান দিলেন না, যে দুই রান এলো, সেগুলোও লেগবাইয়ে। এর আগে ক্যারিয়ারে ৫০তম ওভারে এতো কম রান দেননি মুস্তাফিজ। যখন করলেন, তখন দল টুর্নামেন্টের এমন অবস্থায়- 'যাওয়াটা মঞ্জুর হয়নি, থাকাটাও কষ্টকর'। যখন ম্যাচটা ঝুলছে। যখন তার পায়ে ক্র্যাম্প।  

    শেষ বলের পর মুশফিক ওদিকে উল্লাসে মত্ত। কার ওপর ক্ষোভ ঝাড়ছেন- কে জানে! ফাইন লেগ থেকে দুহাত তুলে ছুটে আসছেন মাশরাফি- আলিঙ্গনে বাঁধবেন মুস্তাফিজকে। 

    মুস্তাফিজও তখন উদ্বাহু। কাউকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন হয়তো। চুমু ছুঁড়লেন আকাশপানে। আকাশকে কাছে টানতে চাইছেন। অথবা ছুঁতে চাইছেন আকাশটা। 

    শেনওয়ারিকে করা শেষ বলটা অফস্টাম্পের বাইরে ছিল। এমন কোনও বিচিত্র, ভারিক্কী নামের কোনও ডেলিভারি না। এটা অফস্টাম্পের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে একটা শর্ট বল। আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ একটা বল। যে বলে রান হয়নি। যে বলে রান হয় না। যে বল খেলতে গিয়ে শেনওয়ারির হাত থেকে শুধু ব্যাটটাই ছুটে যায়। 

    মুস্তাফিজকে নিয়ে সংশয়গুলোও কি সেভাবে চলে যায়?