• আইপিএল ২০১৮
  • " />

     

    কলকাতার ফুটপাত থেকে রাজ্য ক্রিকেটার

    কলকাতার ফুটপাত থেকে রাজ্য ক্রিকেটার    

    ‘এক উইকেট নে, দশ রুপি পাবি।’ পাড়ার বড় ভাইরা রোজই এটা বলত তাকে। অনেকেই ভাবতে পারেন, দশ রুপি আর কিই বা বড় কিছু। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া পাপ্পু রায়ের কাছে কিন্তু ওই দশ রুপিটাই তখন জীবন বাঁচানোর অন্যতম উপায়! নিজের সবটুকু দিয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে ফেরানোর চেষ্টা করতেন। নাহ, উইকেট পাওয়াটা বড় ছিল না, বড় ছিল দশ রুপিটাই। সেটা হলে যে একবেলা পেটে কিছু জুটবে! ক্ষুধা দারিদ্রের সাথে আজন্ম লড়াই করা ২৩ বছর বয়সী কলকাতার তরুণ স্পিনার পাপ্পুই এবার খেলবেন দেওধার ট্রফিতে, প্রতিনিধিত্ব করবেন ভারত-সি দলের।

    জন্মের কিছুদিন পরেই মারা যান ট্রাক ড্রাইভার বাবা জমদার রয়। বাবার মৃত্যুর কিছুদিনের মাঝেই মারা যান পাপ্পুর মা পার্বতী দেবীও। মা-বাবা হারিয়ে এতিম পাপ্পুর জায়গা হয় চাচার বাসায়। কলকাতার এক বস্তিতে থাকতেন সবাই, এক বেলা খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খেতেন চাচা। পাপ্পুর বয়স যখন ১৫, মারা যান সেই চাচাও। শৈশবেই পাপ্পু বুঝে যান, টাকা রোজগার করতে হবে তাকেও। মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলতে গিয়েও তাই থাকত টাকার চিন্তা।

    মাঠে বড় ভাইয়ার উইকেট পাওয়ার বিনিময়ে টাকার ‘লোভ’ দেখাতো। সেই ‘লোভেই’ ধীরে ধীরে নিজের বোলিংয়ের ধার বাড়িয়েছে। শুরুতে ছিলেন পেসার। হাওড়া ইউনিয়ন ক্রিকেট একাডেমীর কোচ সুজিত সাহার পরামর্শে বনে যান স্পিনার। আসতে আসতে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের এলাকায়। ডালহৌসি ক্লাবের হয়ে খেলতে নেমে ২০১১ সালে নিয়েছিলেন ৫০ উইকেট! সবাই ভেবেছিলেন, এবার রাজ্য দলে বোধহয় জায়গাটা পেয়েই যাবেন! কিন্তু কোনো এক কারণে সেবার পাপ্পুর জায়গা হয়নি বাংলার রাজ্য দলে।

     

     

    কলকাতা ছেড়ে তাই উড়িষ্যায় পাড়ি জমান পাপ্পু। সেখানে থাকবেন কোথায়? খাবেন কী? পাপ্পুর দিকে তখন হাত বাড়িয়ে দেন বন্ধু মুজাকির আলি খান ও আসিফ ইকবাল খান। দুজনের বাসাতেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। পাপ্পুর যুদ্ধ চলতে থাকে উড়িষ্যাতেও।

    ২০১৫ সাল। উড়িষ্যা অনূর্ধ্ব-২৩ দলের জন্য ক্রিকেটার নির্বাচন করা হচ্ছে। নিজের প্রতিভা দিয়ে সেই দলে সুযোগ পান পাপ্পু। তিন মৌসুমেই নিজের জাত চিনিয়েছেন, আট ম্যাচে নিয়েছিলে ৪৪ উইকেট।

    উড়িষ্যার হয়ে এই সাফল্যই ভাগ্যের দরজা খুলে দিয়েছে পাপ্পুর। এবার দেওধার ট্রফিতে ভারত-সি দলের হয়ে খেলার ডাক পেয়েছেন। পাপ্পুর দলের অধিনায়ক থাকবেন ভারতের অজিংকা রাহানে। পাপ্পু বলছেন, দলে ডাক পেয়ে মা বাবার কথা একটু বেশিই মনে পড়ছে তার, ‘তাদের চেহারাই তো মনে নেই। শুধু মানুষের কাছেই শুনেছি। এখন মনে হচ্ছে, তারা যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তাহলে হয়ত আমার চেয়েও বেশি খুশি হতেন। দলে সুযোগ পাওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকে রাতে ঘুমাতে পারিনি, রাতভর কেঁদেছি। আমার এত বছরের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে।’

    অনেক কষ্টের পর সুদিন এসেছে। সুসময়েও দুঃসময়ের বন্ধুদের ভোলেননি পাপ্পু, ‘আমাকে সবাই অনেক সাহায্য করেছে। আমার চাচা-চাচি নিজেদের অভাবের সংসারেও আমায়ে জায়গা দিয়েহচিল।উড়িষ্যাতে মুজাকির ও আসিফ না থাকলে তো আমি কিছু করতে পারতাম না। আমি তাদের সবার আশীর্বাদ নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। এখন আমার একটাই লক্ষ্য, ভারতের হয়ে জাতীয় দলে খেলার।’

    যেখানে দুইবেলা ভাত জোগাড় করতেই হিমশিম খেতেন, আজ পাপ্পু স্বপ্ন দেখছেন জাতীয় দলে খেলার। দশ রুপির জন্য একটা উইকেট নিতে কত কষ্টই না করেছেন কৈশোরের দিনগুলোতে! সেই কষ্টকে শক্তি বানিয়েই পাপ্পু হতে চান ‘ভারতের সেরা’। একদিন কোহলিদের সাথে টিভির স্ক্রিনে ভেসে উঠবে তার নাম, পাপ্পু অপেক্ষায় আছেন সেই দিনের।