টস ছাড়া টেস্ট!

২০০১ সালের ঘটনা। ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিন টেস্টের সিরিজের সবক’টিতেই টস হেরেছিলেন ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। কিন্তু গাঙ্গুলি বোধহয় অমত করবেন না, তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সিরিজই ছিল সেটি!
ওই সিরিজ, সিরিজের প্রতিটা ম্যাচ নিয়ে লোকে এখনও আলোচনা করে। করার মতো যথেষ্ট কারণও তো আছে, সিরিজের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল শেষ টেস্টের শেষ সেশন পর্যন্ত। মুম্বাইয়ে প্রথম টেস্ট ১০ উইকেটে হারার পর কলকাতায় দ্বিতীয় টেস্টের তৃতীয় দিন শেষেও ফলো অনে স্বাগতিকদের পিছিয়ে থাকা, অতঃপর লক্ষণ-দ্রাবিড়দের ব্যাটে অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর দৃশ্যগুলো এতো বছর পরও টিভি পর্দায় দেখানো হলে চোখ ফেরানো কঠিন হয়ে পড়ে। আর চেন্নাইয়ে তৃতীয় ও শেষ টেস্ট ভারত জিতেছিল একেবারে শেষ দিনের শেষ সেশনে গিয়ে। চতুর্থ ইনিংসে ১৫৫ রানের জয়ের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ১৫১ রানে অষ্টম উইকেট খুইয়ে বসা...শেষ রানটা নেয়ার আগ পর্যন্ত যেন চিদাম্বরম স্টেডিয়ামের বাতাসে নিঃশ্বাস আটকে ছিল। ক্রিকেটের সৌন্দর্য এখানেই, এমন গৌরবময় অনিশ্চয়তার মাঝে।
ঘাম ঝরানো সিরিজ জয়ের পর লক্ষণ-হরভজনদের মুখে স্বস্তির হাসি
বাইশ গজে ব্যাট-বলের লড়াইয়ে জয়-পরাজয়টাই সব নয়। খেলার মান, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখানে যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। একটামাত্র বল একটা ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। বলে বলে রোমাঞ্চ ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন দর্শককে আকৃষ্ট করে রাখে। এমনই রোমাঞ্চ জাগানিয়া আরও একটি সিরিজ ছিল ২০০৫ সালের অ্যাশেজ। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে দু’ দলই পরস্পরের সেরাটা বের করে এনেছিল। পুরো সিরিজজুড়ে মাঠের খেলোয়াড়রা যেমন গা ছেড়ে দেয়ার এতোটুকু সুযোগ পান নি, দর্শকরাও পান নি গ্যালারি কিংবা টিভি পর্দার সামনে থেকে নড়ার সুযোগ। কেবলই ফলাফল নয়, ওসব খেলার প্রতিটা মুহূর্ত থাকতো উপভোগ করার মতো।
মাইকেল ক্লার্কের স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিলেন সাইমন জোন্স। ২০০৫ অ্যাশেজ।
অথচ কি পরিহাস দেখুন, রোমাঞ্চ জাগানিয়া টেস্ট ম্যাচ এখন স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে বের করতে হয়! অমন রুদ্ধশ্বাস পাঁচ দিনের ক্রিকেট যেন কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে। আজকাল ঘরের মাঠে সবাই নিজেদের মতো করে উইকেট বানাচ্ছে আর সেসবে সফরকারীরা টিকে থাকতেই রীতিমতো খাবি খাচ্ছে। ফলশ্রুতে পাঁচ দিনের ক্রিকেট শেষ হয়ে যাচ্ছে তিন কি চারদিনে, দাপটের সাথে সিরিজ জিতে নিচ্ছে স্বাগতিকরা। সদ্য সমাপ্ত অ্যাশেজেও তার ব্যত্যয় ঘটে নি। বাইশ গজের সবচেয়ে পুরনো আর মর্যাদাপূর্ণ দ্বৈরথটিও যেন দুনিয়াজোড়া ক্রিকেটপ্রেমীদের আগের মতো আর টানতে পারছে না। এ যাত্রায় ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড সিরিজ জিতে নিয়েছে ৩-২ ব্যবধানে। কিন্তু কোথায় সেই শেষদিনের রোমাঞ্চ? প্রায় প্রতিটা টেস্টেই প্রথম ইনিংসের পর নিশ্চিত বলে দেয়া গেছে কে জিততে যাচ্ছে।
সিরিজজুড়ে জো রুটদের মনোমুগ্ধকর ব্যাটিং কিংবা ব্রড-অ্যান্ডারসনদের চোখধাঁধানো বোলিংয়ের পিছনে অনেক ক্রিকেটবোদ্ধাই ইংলিশ পিচ কিউরেটরদের অবদানও দেখছেন। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক রিকি পন্টিং তাঁদের একজন। টেস্টখেলুড়ে দেশগুলোর ‘হোম অ্যাডভান্টেজ’-এর এমন ‘নির্লজ্জ’ ব্যবহার হ্রাসে অন্য অনেক বোদ্ধার মতো পন্টিংও মনে করেন, টেস্ট ক্রিকেট থেকে টসের প্রচলন উঠিয়ে দিয়ে প্রথমে ব্যাটিং বা বোলিংয়ের সিদ্ধান্তটা সফরকারীদের পছন্দমতো বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া উচিৎ।
পন্টিংয়ের মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক পেসার মাইকেল হোল্ডিংয়েরও ধারণা সফরকারী অধিনায়ককে এই একটা সুবিধে দিলেও টেস্ট ক্রিকেটের ক্ষীয়মাণ আবেদনটুকু পুনরুদ্ধার হতে পারে, “সময় বদলাচ্ছে, টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি লোকজনের আগ্রহ কমছে। ব্যাট-বলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাটুকু ধরে রাখার জন্য সম্ভব সবকিছুই আপনাকে করতে হবে।”
টস-কন্ডিশনের উপর নির্ভরতা কমানোর পক্ষে অস্ট্রেলীয়রা আরেক সাবেক সেনাপতি স্টিভ ওয়াহ, “সম্ভবত টস আর বিদেশের মাঠের কন্ডিশনের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এটা কমাতে যদি কর্তৃপক্ষ বিকল্প কিছু চিন্তা করে তাহলে আমি অন্তত কোন সমস্যা দেখি না।”
পিচটা যারা বানান তাঁরা কি বলেন? ভারতের দুই স্বনামধন্য পিচ কিউরেটর দলজিত সিং ও সুধির নায়েকও একমত পন্টিংদের সাথে। দলজিত যেমন সমস্যাটার ক্রমবর্ধমান সার্বজনীনতা নিয়ে শংকা প্রকাশ করলেন, “আগে কেবল উপমহাদেশীয় দেশগুলোকে দোষ দেয়া হত যে তাঁরা নিজেদের সুবিধেমত উইকেট বানায়। কিন্তু এখন আপনি যেখানেই যান না কেন সর্বত্রই এই ‘অশোভন’ চর্চা হচ্ছে।”
ভারতের সাবেক অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির সাথে মোহালির পিচ কিউরেটর দলজিত সিং। ছবিটি ২০১০ সালের।
টস ক্রিকেটে গুরুত্বপূর্ণ হলেও খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করেন দলজিত, “টসটা ক্রিকেটীয় রোমাঞ্চের অংশ। কেমন একটা রহস্য রহস্য গন্ধ লুকিয়ে থাকে এর মধ্যে। কিন্তু টসের কারণে যদি একটা টেস্ট তিনদিনে শেষ হয়ে যায় সেটা ক্রিকেটের জন্য মোটেও ভালো কিছু নয়। যোগ্য দলেরই এখানে জেতা উচিৎ।”
সুধির নায়েক জানালেন অনেক সময় স্বাগতিকদের চাহিদা মোতাবেক উইকেট না বানালে কিউরেটরকে বেশ সমস্যায়ই পড়তে হয়। সামনের মাসেই ভারত সফরে আসছে দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রোটিয়াদের দুর্ধর্ষ পেস আক্রমণ উপমহাদেশের উইকেটেও পরীক্ষিত। কিন্তু ওই ‘হোম অ্যাডভান্টেজ’-এর ‘অন্যায়’ ব্যবহার করতে গিয়ে হয়তো সফরকারী দলের পেসারদের জন্য উইকেটে কিছু রাখাই হবে না! এসব বিবেচনায় দলে ভালো স্পিনার না থাকলেও বাধ্য হয়েই তাঁদেরকে গড়পড়তা মানের স্পিনার নিয়েই একাদশ সাজাতে হবে! আর তাতে যে ফলাফলটাও পূর্বানুমিত হয়ে যায় সেটাই বলছিলেন নায়েক, “এটা এখন নিয়মই হয়ে গেছে যে ঘরের মাঠে আমরা টার্নিং উইকেট বানাবো যাতে ভারতের জয়ের সম্ভাবনা ১১০% থাকে! দক্ষিণ আফ্রিকা যখন এই উইকেটে এসে খেলবে তখন কার্যত কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হবে না! এভাবে তো ক্রিকেটের ক্ষতি বৈ লাভ হচ্ছে না।”
টস কিংবা বিদেশের মাঠের কন্ডিশন বিষয়ে বোদ্ধামহলের এমন মতামত নিয়ে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি এখনও কিছু ভাবছে না বলে জানালেন সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী ডেভ রিচার্ডসন। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক এই ক্রিকেটার বক্তিগতভাবে টস উঠিয়ে দেয়ার পক্ষপাতী নন বলেই মন্তব্য করলেন, “আমার মনে হয় না এটা ভালো কিছু হবে। আর তেমন কিছু করতে হলে অনেক চিন্তাভাবনার প্রয়োজন আছে। আমি নিজে এমন অনেক ম্যাচ খেলেছি যেখানে কিউরেটররা স্বাগতিক দলের মতো করে উইকেট বানায় নি। উইকেটে আবহাওয়ারও একটা বড় প্রভাব থাকে। আর টস তো উভয় দলেরই জেতার সমান সমান সম্ভাবনা থাকে।”
আইসিসির প্রধান নির্বাহী ডেভ রিচার্ডসন
আইসিসি প্রধান নির্বাহীর সাথে একমত ভারতের সাবেক অধিনায়ক দিলিপ ভেংসরকার, “উইকেট ধীর গতির হোক কিংবা দ্রুত গতির হোক, সেটা তো দু’ দলের জন্যই হবে। আর টসকে ঘিরে যে চমকটা থাকে সেটার আবেদন আপনি ফেলে দিতে পারেন না।” ভারতের আরেক সাবেক সেনাপতি গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথও টস উঠিয়ে দেয়ার পক্ষপাতী নন, “এতদিনে খেলাটায় বহু পরিবর্তন আনা হয়ে গেছে। টসের ঐতিহ্যটা অন্তত থাকতে দিন। টস হারলেই ম্যাচ হারবেন, এমন তো কোন কথা নেই!”
টস বাতিলের পরিবর্তে ক্রিকেটকে ত্রুটিমুক্ত করার কথা বলছেন পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক জাভেদ মিয়াঁদাদ, “শতবর্ষ পুরনো একটা সংস্কৃতি বাতিলের প্রশ্ন না তুলে আইসিসির উচিৎ টেস্ট ক্রিকেটটাকে গড়পড়তা মানে নামিয়ে আনা ত্রুটিগুলো দূর করার দিকে মনযোগী হওয়া।”
টসবিহীন নয়, ত্রুটিমুক্ত টেস্ট খেলা চান জাভেদ মিয়াঁদাদ
টেস্ট ক্রিকেটের জৌলুস বাড়ানোর স্বার্থে প্রয়োজনে টস বাতিলের পক্ষপাতী হলেও সেটা যে সহজসাধ্য নয় তা মানছেন দলজিত সিং, “তেমন কিছু করাটা অনেক বড় একটা সিদ্ধান্তের ব্যাপার, অনেক বছরের পুরনো চল কিনা।” তবে আইসিসি চাইলে সবই সম্ভব বলেই ধারণা তাঁর, “পরিবর্তন তো আর কম হয় নি। রঙিন পোশাকে ক্রিকেট খেলার কথা নব্বইয়ের আগে কে ভেবেছিল? কিংবা টি টুয়েন্টি ক্রিকেট যে এতো জনপ্রিয়তা পেয়ে যাবে সেটাই বা কে জানতো? সবই তো শেষ পর্যন্ত হয়েছে।”