• লা লিগা
  • " />

     

    যে ৫ কারণে ধুঁকছে রিয়াল মাদ্রিদ

    যে ৫ কারণে ধুঁকছে রিয়াল মাদ্রিদ    

    টানা তিন চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেও হঠাৎই রিয়াল মাদ্রিদের দায়িত্ব ছাড়লেন কোচ জিনেদিন জিদান। কোচের আকস্মিক বিদায়ে সামলে নেওয়ার আগেই আরেকটি বোমা ফাটালেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। যোগ দিলেন জুভেন্টাসে। জিদানের জায়গায় কোচ হয়ে আসলেন হুলেন লোপেতেগি। দলে ভেড়ানো হল না কোনও বড় মাপের ফরোয়ার্ডকেও। প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের এমন সিদ্ধান্তের চড়া মূল্য দিতে হল রিয়ালকে। নিজেদের ইতিহাসে অন্যতম বাজে সূচনা করল ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নরা, লোপেতেগিও হারালেন চাকরি। তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে সান্তিয়াগো সোলারির অধীনে শুরুটা ভাল হলেও আবারও ফর্মহীনতায় ভুগতে শুরু করেছে রিয়াল। ২০০৯ সালের পর প্রথমবারের মত নিজেদের মাঠে চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপপর্বে হেরেছে তারা। হঠাৎই কেন এভাবে জৌলুস হারিয়ে ফেলল রিয়াল? 

     

    ১. রোনালদোর অপূরণীয় শূন্যতা

    কিয়েভে লিভারপুলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের রাতেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ক্লাব ছাড়ার। মাসখানেক পরই জুভেন্টাসে যোগ দিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। বিস্ময়করভাবে রোনালদোর রেখে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণ করেনি রিয়াল। কিলিয়ান এম্বাপ্পে, নেইমার, এডেন হ্যাজার্ডদের নাম শোনা গেলেও বড় কাউকেই দলে ভেড়াননি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। গ্যারেথ বেল, করিম বেনজেমাদের ওপর এমন অপার আস্থার বেশ চড়ামূল্যই দিতে হয়েছে রিয়ালকে।

     

     

    মৌসুমের শুরুতে বেল, বেনজেমারা আশার আলো দেখালেও সময়ের সাথে ফর্ম হারিয়েছেন দুজনই। লোপেতেগির অধীনে তো নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গোলখরা কাটিয়েছে ‘লস ব্লাঙ্কোস’রা। গত সপ্তাহে হুয়েস্কার বিপক্ষে লা লিগায় ১০ ম্যাচ পর গোল পেয়েছেন বেল। আক্রমণে মার্কো আসেন্সিও, ইস্কোরাও যেন ভুলে গেছেন জাল খুঁজে পেতে। রোনালদোর '৭' নম্বর জার্সি গায়ে জড়ানো মারিয়ানো দিয়াজকে নামাতেই ভরসা পাচ্ছেন না সোলারি। এই মৌসুমে ২০ ম্যাচ খেলা বেল গোল করেছেন মাত্র ৭টি, বেনজেমার গোলসংখ্যা ১০; যা মৌসুমে রিয়ালের হয়ে সর্বোচ্চ। রিয়ালের আক্রমণে রোনালদোর উত্তরসূরি ধরা হলেও এই মৌসুমে নিজেকে প্রমাণ করতে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছেন বেল। রোনালদোর মত প্রতি মৌসুমেই ৪০-৫০ গোল করা ফরোয়ার্ডের অভাবটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে রিয়াল।  

     

    ২. সমস্যার নাম রক্ষণ

    রোনালদোকে হারিয়ে রিয়ালের আক্রমণ যতটা না বিবর্ণ, তার চেয়েও হয়ত বড় দুশ্চিন্তার নাম রক্ষণ। মৌসুমের কখনোই সার্জিও রামোস বা রাফায়েল ভারানরা নিজেদের স্বরূপে ছিলেন না। রামোসদের ফর্মহীনতার সুযোগটা বেশ ভালমতই কাজে লাগিয়েছে প্রতিপক্ষ। লেভান্তে, এইবারের মত দলগুলোর বিপক্ষে হার মানতে হয়েছে তাদের। নড়বড়ে রক্ষণের কারণে প্রতিপক্ষের মনে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর ব্যাপারে থাকা 'ফিয়ার ফ্যাক্টর' উবে গেছে বেশ আগেই। রক্ষণভাগে রামোসদের সাথে আছেন কারভাহাল, মার্সেলোরাই। এই ডিফেন্স লাইন নিয়েই জিদানের অধীনে সাফল্যমন্ডিত তিন বছর কাটিয়েছিল রিয়াল। 'আন্ডারস্টাডি' হিসেবে থাকা নাচো, হেসুস ভায়েহোরাও নিজেদের প্রমাণ করতে পারেননি। রক্ষণে আশার আলো বলতে আছেন কেবলই তরুণ রাইটব্যাক আলভার ওদ্রিওজোলা। বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষক হয়ে রিয়ালে আসা থিবো কর্তোয়া যেন ক্লিনশিট কী- সেটাও ভুলে গেছেন। হুয়েস্কার বিপক্ষে ম্যাচটি বাদে পুরো মৌসুমে রিয়ালের গোল সামলাতে ব্যর্থই হয়েছেন বেলজিয়ান গোলরক্ষক।

     

     

    গত মৌসুমে এই সময়টায় মোট ১৮ গোল হজম করেছিল রিয়াল। আর এই মৌসুমে করেছে ২৪টি। ব্যবধান খুব একটা না হলেও গোল করতে না পারায় বেশ ভুগতে হয়েছে রিয়ালকে। নিয়মিত গোল করায় রক্ষণের সমস্যাটা গত মৌসুমে তেমন প্রকটভাবে ধরা পড়েনি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নদের। কিন্তু বেল, বেনজেমাদের ব্যর্থতায় উভয় সংকটেই পড়েছেন সোলারি।

     

    ৩. ইনজুরি আক্রান্ত খেলোয়াড়দের লম্বা তালিকা

    ইনজুরি সমস্যাটা প্রায় প্রতি মৌসুমেই বেশ ভুগিয়েছে রিয়ালকে। কিন্তু এবারের মত হয়ত এতটা সমস্যা পোহাতে হয়নি তাদের। পুরো মৌসুমে লোপেতেগি বা সোলারি- পূর্ণ শক্তির মূল একাদশ নামাতে পারেননি কেউই। কাসেমিরো, রামোস, বেল, বেনজেমা- ইনজুরিতে পড়েছেন প্রায় সবাই-ই। এমনকি নাচো ফার্নান্দেজ বা টনি ক্রুসরাও বাদ যাননি। জিদানের অধীনে স্কোয়াড ডেপথ ছিল রিয়ালের অন্যতম বড় অস্ত্র। এবার নেই সেটাও।

    রোনালদোর '৭' নম্বর জার্সির উত্তরসূরি মারিয়ানো, মার্কোস ইয়োরেন্তে, দানি সেবায়োসদের কেউই বেঞ্চ থেকে এসে খেলায় পার্থক্য গড়ে দিতে পারছেন না। প্রায় প্রত্যেকের ইনজুরিই মাসখানেক বা তারও বেশি হওয়ায় নির্দিষ্ট কোনো একাদশই দাঁড় করাতে পারছেন না সোলারি। রিয়ালের আক্রমণ এবং মাঝমাঠ নির্বিষ হওয়ার এটি অন্যতম বড় কারণ।

     

    ৪. সোলারি যখন 'অসহায়'

    দায়িত্ব নেওয়ার পর নিজের মত দল সাজিয়ে, ভাল ফলাফল আনতেই বেশিরভাগ কোচের কিছুটা সময় লেগে যায়। কিন্তু লোপেতেগির অধীনে রিয়ালের যে অবস্থা ছিল, তাতে সোলারিকে ঐ সময়টুকু দেওয়ার বিলাসতা ছিল না রিয়ালের কাছে। সেটা ছাড়াই শুরুটা অবশ্য দুর্দান্ত ছিল সোলারির। যেই রিয়াল গোল করা বা ম্যাচ জেতাই ভুলে গিয়েছিল; তাদের টানা ৫ ম্যাচ জিতিয়েছিলেন, ঐ সময়টায় রিয়াল গোলও করেছিল ১৬টি। কিন্তু সময়ের সাথে বেলদের মত বিবর্ণ হয়ে গেছে সোলারির ভাগ্যও।

     

     

    নিজের মনমত দলই বাছাই করতে পারেননি সোলারি। লোপেতেগির বিধ্বস্ত রিয়ালকে যতটা সম্ভব ফর্মে ফিরিয়েছিলেন, কিন্তু নড়বড়ে রক্ষণ এবং বিবর্ণ আক্রমণ নিয়ে আসলে তারও খুব একটা কিছু করার নেই। এইবার বা সিএসকেএ মস্কোর বিপক্ষে ম্যাচগুলো যেন সোলারির শুভসূচনাকে অনেকটা 'বিগিনার্স লাইক'ই বানিয়ে দিল। দলের যেরকম অবস্থা, তাতে এই মৌসুমে হয়ত ট্রফিশূন্যই থাকতে যাচ্ছে রিয়াল। সেক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পেলেও সোলারি আসলে কতদিন টেকেন, তা-ই দেখার বিষয়।

     

    ৫. হারিয়ে গেছে মাঝমাঠের মানিকজোড়ও

    ২০১৫ থেকে রিয়ালের সব সাফল্যের পেছনের কারিগরটা ছিলেন তারা দুজন। রোনালদো পাদপ্রদীপের আলোর প্রায় পুরোটাই নিয়ে নিলেও লুকা মদ্রিচ এবং টনি ক্রুসের অবদান চোখে পড়েছে সবারই। গত তিন মৌসুম ধরেই ফিফা বা ইউয়েফা- দুই জায়গার সেরা একাদশেই তারা নিয়মিত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রিয়ালের সবচেয়ে খারাপ মৌসুমের ছোঁয়াটা যেন লেগেছে রিয়ালের মাঝমাঠের মানিকজোড়েরও।

     

     

    মদ্রিচ বা ক্রুস ফর্মে নেই কেউই। বিশেষ করে মদ্রিচ বিশ্বকাপের পর রঙ হারিয়েছেন অনেকটাই। বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়, ব্যালন ডি'অর জয়ী, ফিফার বর্ষসেরা- সব পুরস্কার জিতেছেন মদ্রিচ। তার কাছে আশাটা এবার একটু বেশিই ছিল রিয়ালের। আর জার্মানির বিশ্বকাপের 'গোবরে পদ্মফুল' ছিলেন ক্রুস। কিন্তু রিয়ালের হয়ে এই মৌসুমে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা কাউকেই। ইনজুরির কারণে ক্রুস মাঠের বাইরে ছিলেন কিছুদিন, কিন্তু মৌসুমের শুরুতেও তার ফর্ম ছিল বেশ নড়বড়ে। স্বরূপে না থাকায় বার্নাব্যুর দুয়োও শুনতে হয়েছে দুজনকেই। একক পারফরম্যান্স দিয়েও দলকে অনুপ্রারিত করতে পারছেন না কেউই। দলের সবচেয়ে সংকটময় মুহূর্তে মদ্রিচদের ফর্মহীনতা যেন রিয়ালের জন্য কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিঁটার মতই।