• বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সিরিজ ২০১৫
  • " />

     

    নিরাপত্তা তুমি কার!

    নিরাপত্তা তুমি কার!    

     

    ১.

    ‘গতকাল একটি অপমৃত্যু ঘটেছিল, যা কিনা হয়নি ছাপা,

    দৈনিক খবরের কাগজে...

    আঘাতটাও যায়নি দেখা, অন্তরে না বুকে!’

     

     

    ২.

    ২০০৩ বিশ্বকাপ। বছরখানেক আগের জন্মদিনে বাবার কাছ থেকে একটা ডায়েরি পেয়েছিলাম। আমার রেকর্ডবুক ছিল তা। বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচের স্কোর টুকে রাখতাম, সংক্ষিপ্ত করে। বেশ কয়েকটা ‘সংকেত’ ব্যবহার করতাম, কোনটা ডি-এল মেথড বোঝাতে, কোনটা আবার টসে জয়ী দল বোঝাতে, কোনটা খেলা পরিত্যক্ত বোঝাতে। একটা সংকেত একটু আলাদা ছিল। ‘ওয়াকওভার’ এর সংকেত।

     

     

    নিরাপত্তা, সরকারের সঙ্গে নিজেদের দেশের ঝামেলার কারণ দেখিয়ে নিউজিল্যান্ড খেলতে গেলনা কেনিয়ায়। ইংল্যান্ড জিম্বাবুয়েতে। ২০০৩ বিশ্বকাপের লোগোতে আয়োজক হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকারই নাম ছিল শুধু, তবে ‘আয়োজক’ ধরলে ছিল কেনিয়া, জিম্বাবুয়েও। তখন ভাবতাম, বিশ্বকাপ, এমন ম্যাচও মিস করে! কেনিয়া ওয়াকওভারের পয়েন্টগুলো কাজে লাগিয়েছিল, ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলেছিল স্টিভ টিকোলোর দেশ!

     

     

    নিরাপত্তার ঝুঁকি এর আগেও ক্রিকেটে বাগড়া বাঁধিয়েছে। বিশ্বকাপেও বাঁধিয়েছে। তবে ২০০৩ সালের পর ক্রিকেট হুমড়ি খেয়েছে অনেকবার, এই ‘নিরাপত্তা’য়!

     

     

     

    কদিন আগে ফ্র্যাঙ্ক টাইসন মারা গেলেন। তাঁকে নিয়ে লিখতে যাওয়ার আগে ভেবেছিলাম, আমাদের ক্রিকেট প্রজন্ম সময়ের সেরা তিন ফাস্ট বোলারকে দেখেছে। শোয়েব আখতার, ব্রেট লি, শন টেইট। আমাদের ক্রিকেট প্রজন্ম আবার এই নিরাপত্তার ঝুঁকিতে কেঁপেছে সবচেয়ে বেশী!

     

     

    ২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। হ্যাঁ, বিশ্বকাপের পরের বছরই! হুমকি ছিল সেখানেও, শেষ পর্যন্ত সে সফর সম্পূর্ন করেই এসেছিল ইংল্যান্ড। এরপরের ঘটনাতেও ছিল তারা।

     

     

    ২০০৮ সাল, মুম্বাই। তাজ হোটেলে বোমা বিস্ফোরণের কদিন পরই ইংল্যান্ডের সফর। অনেক অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ইংল্যান্ড এসেছিল ভারতে। টেস্টের ভেন্যু মুম্বাই থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল।

     

     

    তবে ক্রিকেট সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেয়েছিল ২০০৯ সালে। লাহোরে। শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদের বাসে বন্দুক হামলার রেশটা কাটেনি এখনও। প্রথমে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, পরে বিশ্বকাপ। দুটি বড় টুর্নামেন্টের আয়োজনের সুযোগ হারানোর পর পাকিস্তান থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই হারিয়ে গেল! মধ্যপ্রাচ্যে এখন তাদের ‘নিবাস’। ইংল্যান্ড সেখানেই খেলতে গিয়েছে, সামনে লম্বা সিরিজ।

     

     

    ভারত দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে খেলছে এখন। পাকিস্তানের জিম্বাবুয়ে সফরের পর আফগানিস্তান যাবে জিম্বাবুয়েতে। ইনজামাম-উল-হক আফগানিস্তানের কোচ হয়েছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ শ্রীলঙ্কায় পৌঁছেছে পূর্নাংগ সিরিজ খেলতে।

     

     

    বাংলাদেশও এখন থাকার কথা ছিল সরগরম। নতুন অস্ট্রেলিয়া আসবে, মুখোমুখি হবে অসাধারণ এক বছর কাটানো নতুন এক বাংলাদেশ! তার বদলে রাজ্যের নিঃস্তব্ধতা এখন বাংলাদেশের ক্রিকেটে। যে অস্ট্রেলিয়া কন্ডিশনিংয়ের জন্য আগে আসতে চেয়েছিল বলে শোনা যায়, হঠাৎ তারাই ‘স্থগিত’ করে বসলো এ সফর! কারণটা ওই ‘নিরাপত্তাঝুঁকি’!

     

     

    ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অনূর্ধ্ব-১৯ দল সফর বাতিল করে চলে গিয়েছিল চট্টগ্রামে হোটেলের সামনে এক বিস্ফোরণের পর। ‘রাজনৈতিক অস্থিতীশীলতা’ দেশে তখন ‘চরম’ আকার ধারণ করেছে। কদিন পরই শ্রীলঙ্কার সফর, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। সেই টেস্ট পূর্ববর্তী যুগে ‘মিনি বিশ্বকাপ’ আয়োজন করা দেশ, নিরপেক্ষ ভেন্যু হয়েও দুই দেশের টেস্ট আয়োজন করে স্টেডিয়ামভর্তি দর্শক হাজির করতে পারা আয়োজক, বিশ্বকাপের মতো আসর কত সফলতার সঙ্গে আয়োজন করতে পারা দেশের ক্রিকেটায়োজন কি পড়ে গেল হুমকির মুখে!

     

     

     

    নাহ্‌, চার-ছক্কার হইরই ঠিকই হয়েছে। বলের মতো ওই ‘নিরাপত্তার হুমকি’ উড়ে গিয়ে কোন সুদূরে পড়েছে, কে রাখে তার হদিস! ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে থাকে তাই সাংগা-জয়ার পাওয়া বিদায়ী উপহার ওই ট্রফিটা! অথবা আয়ারল্যান্ড-নেদারল্যান্ডসের সেই ম্যাচটা!

     

     

    তবে আপাতত সব ভুলে ক্রিকেটে মশগুল থাকার সুযোগটা পাচ্ছে না বাংলাদেশ, কোনো এক ‘অজ্ঞাত’ কারণে! নামহীন, পরিচয়হীন এক ‘ঝড়ের শঙ্কাই’ যে অস্ট্রেলিয়াকে থামিয়ে দিল। সিজার তাভেল্লি নামের এক ইতালীয় স্বেচ্ছাসেবক কর্মীর মৃত্যুটা জানা, এদেশের থাকা অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড এর নাগরিকদের অনুষ্ঠান বাতিলের খবরটা জানা। জানা নেই আর কিছু।

     

     

    ৩.

    রাস্তার দুপাশে মানুষ দাঁড়িয়ে, রাস্তা ফাঁকা পুরোটাই। শুধু যানবাহন কেন, পথচারীদের চলাচলও বন্ধ। ঢাকার রাস্তায় প্রায়ই দেখা যায় এমন দৃশ্য। ‘ভিআইপি, ভিভিআইপিরা’ যাবেন। সেই ‘ভিআইপি’ যখন ক্রিকেটাররা হন, মানুষের অসন্তোষ তখন অনেক কম থাকে, এটা নিশ্চিত। এদেশের মানুষের কাছে ক্রিকেট শুধুই একটা খেলা হিসেবে নেই এখন আর, বেঁচে থাকার অনেক বড় ‘অবলম্বন’ও যে তা! সেই ক্রিকেট যদি বন্ধ থাকে ‘অজ্ঞাত’ কোনো কারণে, ‘অদ্ভূত’ কোনো এক তালিকার কারণে, তাহলে ক্রিকেটপ্রেমীদের অসহায়ত্বটা টের পাওয়া যায়। চায়ের দোকানে, ফেসবুকে, নিতান্ত আড্ডায়!

     

     

    নিরাপত্তার হুমকিটা কত বড় ছিল, ঝুঁকি আসলে কতটা তা মাপার মতো পরিমাপক নেই সাধারণ মানুষের কাছে। ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে। কেন সেই ‘রহস্যময়’ তালিকার ছয় নম্বরে থেকেও ভারতে দিব্যি খেলা হচ্ছে, কেন ২৩ নম্বরে থেকেও বাংলাদেশ হচ্ছে বঞ্চিত, সে প্রশ্নেরও উত্তর মেলে না! ব্যাপারটা কতখানি কূটনৈতিক, কতখানি রাজনৈতিক, কে জানে!

     

     

    সেই গানের লাইনটার মতোই।

     

     

    আঘাতটা কোথায় লাগলো, ঠিক জানা নেই। ঠিক সুনির্দিষ্ট কোন কারণ, জানা নেই। শুধু অপমৃত্যু না ঘটলেও একটা ক্রিকেট সিরিজ বাজেভাবে ‘আহত’ হলো। সঙ্গে একটা দেশের ক্রিকেটায়োজনের ‘ভাবমূর্তি’তেও লাগলো আঁচড়!

     

    সে আঁচড়কে ক্রিকেটই মিশে দিতে পারবে কিনা, বলে দেবে সময়।

     

     

    আর সময়ের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া এখন করারই আছে কীইবা!