• ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    যেদিন ডি ইয়ংরা হয়ে যান ভ্যান গগ

    যেদিন ডি ইয়ংরা হয়ে যান ভ্যান গগ    

    আমস্টারডামকে আপনি 'খালমাতৃক' শহর বলতে পারেন। শহরের ১০০ কিলোমিটারের বেশি জায়গা জুড়ে শুধুই খাল। তবুও সেখানে নৌকার চেয়ে সাইকেলের সংখ্যাই বেশি। সাইকেলের সংখ্যা নাকি আবার জনসংখ্যার চেয়েও বেশি! তার একটা বিরাট অংশ আবার ওসব খাল থেকে উদ্ধার হয় প্রতি বছর। আমস্টারডাম কর্তৃপক্ষ এবার আগেভাগে ব্যবস্থা নিয়ে রাখতে পারেন। গত রাতে আমস্টারডামের পানশালায় ঢোকা লোকজনের সাইকেল নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারার কথা নয়।

    সাইকেল খোয়া যাওয়া আমস্টারডামে নিত্যদিনকার ঘটনা। তবে এবার হারিয়ে যাওয়া সাইকেলের কথা অন্তত ভালোভাবেই মনে থাকবে আমস্টারডামের আয়াক্স সমর্থকদের। যে রাতে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে এলাম, সেদিনই অমুক ব্র্যান্ডের সাইকেলটা হারিয়েছিলাম- বহু বছর পর হয়ত এই রাতের গল্পটা এক লাইনে এমন কিছুতে রূপ নেবে। সাইকেল হারানোর গল্প এর চেয়ে মধুর যেন আর হয়ই না!

    আমস্টারডামে সেই রাতটা আসলে কেমন গেল? উৎসবের নিশ্চয়ই। কিন্তু সে উৎসব কি পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই রূপ নিয়েছে মহোৎসবে?

    সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে দ্বিতীয় লেগের আগে হাজার চারেক আয়াক্স সমর্থক হাজির হয়েছিলেন উৎসবের প্রস্তুতি নিয়েই। মঙ্গলবার সকাল থেকে মাদ্রিদের রাস্তায় আর রেস্তোরায় যে কোলাহল চলছিল তার অর্ধেকটা জুড়েই ছিলেন নেদারল্যান্ডসবাসীরা। প্রথম লেগে ২-১ ব্যবধানে হেরেও সমর্থকদের বিশ্বাসে কাটতি পড়েনি এতোটুকুও। রিয়াল মাদ্রিদ, আগের তিনবারের চ্যাম্পিয়ন, ইউরোপের সবচেয়ে সফলতম দল- এসব কোনো বিশেষণ বা বিশ্লেষণই খাটল না তাদের কাছে।


    ওসব খাটেনি বার্নাব্যুতেও। সমর্থকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তো আর হাওয়া থেকে তৈরি হয়নি। সেটা হাওয়ায় মিলিয়েও যেতে দেননি আয়াক্স খেলোয়াড়রা। রিয়াল মাদ্রিদকে তাদের মাঠে ৪-১ গোলে উড়িয়ে আয়াক্স জানিয়েছে নিজেদের আগমনী বার্তা।

    এই মাঠে এর আগে মাত্র দুইবার জিতেছে আয়াক্স। ১৯৭৩ ও ১৯৯৫ সালে। ওই দুইবারই ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা জিতে থেমেছিল আমস্টারডামের দলটি। আয়াক্সকে এখনই শিরোপা জিতিয়ে দেওয়াটা বাড়াবাড়িই হয়ে যাবে। কিন্তু রিয়ালের বিপক্ষে আয়াক্স যা দেখিয়েছে সেটা শিরোপা জয়ের চেয়ে খুব বেশি বৈ কম কিছু নয়। আয়াক্সের ভাগ্যে তাই এবার যাই থাকুক, এই ম্যাচটাও ইতিহাসে ঢুকে গেছে অনায়াসেই।

    প্রথম লেগে দুইটি অ্যাওয়ে গোল হজম করায় আয়াক্সকেও অন্তত দুইটি গোল করতেই হত মাদ্রিদে। প্রথম লেগে আয়াক্সের ভয়ডরহীন ফুটবলের পর সেটা অবিশ্বাস্য কিছু মনে হচ্ছিল না। কিন্তু ম্যাচের প্রথম ২০ মিনিটেই যে এমন কিছু করে ফেলবে তারা, সেটা বোধ হয় সাইকেল হারাতে যাওয়া পাঁড় আয়াক্স সমর্থকও স্বপ্ন দেখেননি। বার্নাব্যুতে আয়াক্স শেষ পর্যন্ত গোল করেছে আরও দুইবার। প্রথমটার চেয়ে পরেরটা যেন আরও চোখ ধাঁধানো। আমস্টারডামে ঘুরতে গিয়ে পুরোনো স্থাপনা দেখে যেমন চোখ জুড়ানো যায়, দুসান টাডিচের ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরে করা অ্যাসিস্টে তার চেয়ে কম তৃপ্তি হয় না। এই টাডিচ প্রিমিয়ার লিগ ছেড়েছেন গতবারই। তার ঝুলিতে এমন কিছু যে ছিল, সেটা মাদ্রিদের মঞ্চে দেখানোর জন্যই জমিয়ে রেখেছিলেন হয়ত। আমস্টারডামের আলো-বাতাস তো আপনাকে আরও শৈল্পিকই করে তোলার কথা। টাডিচের ক্ষেত্রেও ঘটেছে সেটা।

    লাস শোন অবশ্য বহুদিন ধরে এই শহরে আছেন, বয়সেও তিনি টাডিচের চেয়ে বড়। আয়াক্সের সবচেয়ে পুরনো খেলোয়াড়। রিয়াল যখন এক গোল শোধ করে ম্যাচে ফেরার চেষ্টা করছে। শোন আরেক কাঠি বেশি সরেস। লেফট উইং এ যেখানে ফ্রি কিক পেয়েছিলেন সেখান থেকে গোল করতে হলে আপনাকে হতে হবে ‘পারফেকশনিস্ট‘। শোন তখন হয়ে গেলেন ভ্যান গগ। থিবো কোর্তোয়া ভুল করেননি তেমন, কিন্তু ওই একটু ফাঁকা দিয়েই রিয়ালের কফিনে পেরেক ঠুকে দিলেন শোন। ওটাই তার শেষ, এরপর মাঠ ছেড়েছেন বদলি হয়ে। তার আগে প্রচন্ড মোহে আবিষ্ট করে দিয়ে গেছেন ভেল্কি দেখিয়ে। শোনের ক্যারিয়ার এখানে থেমে গেলেও নিশ্চয়ই তার কোনো আফসোস থাকবে না। এগুলো অবশ্য আয়াক্সের বুড়োদের গল্প। ড্যালি ব্লিন্ড, টাডিচ, শোনরা আয়াক্সের নতুন দিনের সৈনিক। কিন্তু গল্পের পার্শ্বচরিত্রের বেশি কিছু নন তারা।

    এই দলটার অধিনায়কের বয়স ১৯। দলের সেন্টারব্যাক তিনি। কিন্তু ম্যাথিয়াস ডি লিট তার বয়সের চেয়ে অনেক বেশি পরিপক্ক। চার বছর পর চ্যাম্পিয়নস লিগে ফিরে এসে আয়াক্স এবার শুরু থেকেই নজর কাড়ছিল। আর ডি লিটরা আকর্ষণ কাড়ছিলেন ইউরোপের সব জায়ান্টদের কাছ থেকে। অক্টোবরে এক ম্যাচ শেষে ডি লিটকে তাই বাজিয়ে দেখতে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, ম্যানচেস্টার সিটি না বার্সেলোনা- আপনার পছন্দের দল কোনটি? ডি লিট আগপিছু না ভেবে জবাব দিয়েছিলেন, “আয়াক্স”। ১৯ বছর বয়সেই কীভাবে দলের অনুকরণীয় সদস্য হয়ে যেতে হয় তার ছিটে ফোঁটা হয়তো ওই এক জবাবেই জেনে গিয়েছিলেন ওই সাংবাদিক।


    ডি লিট কেবল মাঠেই নয়, মাঠের বাইরেও নেতা। অ্যাথেন্সের মাঠে যখন দুইদলের সমর্থকরা রক্তারক্তিতে জড়িয়ে পড়েছিল, তখন নিজ সমর্থকদের কাছে সবার আগে এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনিই। বুঝিয়ে শুনিয়ে ওই পরিস্থিতিতেও সমর্থকদের ঠান্ডা করেছিলেন ডি লিট। চ্যাম্পিয়নস লিগের ওই ম্যাচটা আয়াক্সের জন্য ছিল আরও গুরুত্বপূর্ণ। পরে ওই ম্যাচ জিতে এবার ১৫ বছর পর চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছিল আয়াক্স। 

    ডি লিটরা সময়ের সাথে আরও পরিপক্ক হয়েছেন। ডাচ ফুটবল যখন দুঃসময়ে একজন ত্রাণকর্তার অপেক্ষা করছিল, তখন তারা একসঙ্গে পেয়েছে দুইজনকে। ফ্রাঙ্কি ডি ইয়ং আর ডি লিট উন্নতি করেছেন পাল্লা দিয়ে। ডি ইয়ং শুধু ডিফেন্স ও মিডফিল্ড খেলতে পারেন না, দুই জায়গাতেই সমান পারদর্শী। তার হাতে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব নেই। তবে তাকে একটু কাঁটা ছেড়া করলে নতুন আয়াক্সের চেহারাটা ভালোভাবে ভেসে উঠবে ওই একজনের মুখেই।

    সার্জিও রামোস ইচ্ছা করে হলুদ কার্ড দেখেছিলেন আমস্টারডামের প্রথম লেগে। হয়ত ভেবেছিলেন তাতে ক্ষতির চেয়ে লাভই বেশি হবে দলের। দ্বিতীয় লেগেও যখন রিয়াল মাদ্রিদই ফেভারিট, তখন রামোসকে একটু খোঁচাও মেরেছিলেন ডি ইয়ং। জানুয়ারিতে চুক্তি করেছেন বার্সার সঙ্গে, পরের মৌসুমে তাদের জার্সি গায়ে চড়াবেন। ডি ইয়ং আগে থেকেই প্রস্তুত। “আয়াক্স কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গেলে রামোসের আফসোসের সীমা থাকবে না”- ম্যাচের আগে সাক্ষাৎকারে বলা ডি ইয়ং এর কথা শুনে অনেকেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিলেন।

    ডি ইয়ং লুকোচুরিতেও বিশ্বাসী নন। আরেকবার বললেন, “বার্সায় চুক্তি করার সময় আমাকে ওরা বলেছে রিয়াল মাদ্রিদকে হারানোর সবরকম চেষ্টা যাতে করি”- ম্যাচের কয়েক ঘন্টা আগে এই খবর ঘুরে বেড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে। তখনও ডি ইয়ংদের পক্ষে কথা বলার লোক খুব বেশি ছিল না।

    সেই রামোসকে শেষ পর্যন্ত আফসোস করিয়েই ছেড়েছেন ডি ইয়ংরা। রিয়াল মাদ্রিদকে হারানোর সবরকম চেষ্টা নয়, নিজেদের মতো নির্ভীক খেলেই স্মরণীয় রাতটা আদায় করে নিয়েছেন তারা।

    আয়াক্সের এমন ভয়ডরহীন ফুটবল এবার প্রথম দেখেছিল বায়ার্ন মিউনিখ, গ্রুপ পর্বে। রিয়াল মাদ্রিদ আরও ভয়ঙ্কর রূপ দেখল দ্বিতীয় রাউন্ডে। এতোদিন পরেও এসে আয়াক্স-রিয়াল ম্যাচ রোমাঞ্চ ছড়াবে সেটা কয়জনই বা অনুমান করতে পেরেছিলেন! কিন্তু ডি ইয়ংদের মুখের কথা, ডি লিটের দূরদর্শীতা ইঙ্গিত করছে এমন কিছুর ছবি আগেই স্কেচ করা ছিল আয়াক্স খেলোয়াড়দের মনে। এবার তাতে রঙ চড়েছে কেবল। 

    আয়াক্সের এই দলের উত্থান আসলে প্রথম বিশ্ব দেখেছিল ২০১৭ এর ইউরোপা ফাইনালে। তরুণ দল নিয়ে সেদিন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে হেরেছিল আয়াক্স। ফুটবলকে প্রেমের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া লোকেদের অল্পের জন্য অমৃত সুধা পান করা হয়নি,  আয়াক্সের উত্থান হতে হতেও তো হয়নি সেবার। এরপর জাস্টিন ক্লুইভার্টের মতো খেলোয়াড়কে বিক্রি করে দেওয়ার পর পুরনো বাস্তবতাটাই আরেকবার নতুন করে হতাশ করেছিল তাদের। ইউরোপের টাকার ঝনঝনাঝনির রঙিন পটের সামনে ডাচ লিগ তো সাদাকালো এক ছবি।

    যেমনটা আরও একবার হয়েছে, ফ্রাঙ্কি ডি ইয়ংকে মৌসুমের মাঝপথেই কিনে নিয়েছে বার্সেলোনা। এটাই যেন আয়াক্সের বাস্তবতা। এটা অবশ্য নতুন করে জানতে হয়নি আমস্টারডামের লোকেদের। ১৯৭৩ এর সেই দলে ছিলেন ইয়োহান ক্রুইফ। ইউরোপিয়ান শিরোপা জিতে এরপর তিনিও পাড়ি জমিয়েছিলেন বার্সেলোনায়। এরপর বাকিটা তো ইতিহাস হয়ে গেছে। ক্রুইফ হয়ে গেছেন ফুবটলের বিশুদ্ধতম দার্শনিকদের একজন। সেই আয়াক্স দলটা ছিল পরের বছর বিশ্বকাপের টোটাল ফুটবল খেলা নেদারল্যান্ডসের প্রাণ। ১৯৯৫-এর দলটাও তো কম বিখ্যাত নয়। এডউইন ভ্যান ডার সার, ডি বোয়ের ভাতৃদ্বয়, সিডর্ফ, রাইকার্ড, ওভারমার্সদের আমল ছিল সেটা। সে দলটাও ধরে রাখতে পারেনি আয়াক্স। ভ্যান ডার সার, মার্ক ওভারমার্সরা এখন আয়াক্সের নীতি নির্ধারক। স্যুট, টাই পরা দুই  নিপাট ভদ্রলোক কাল বার্নাব্যুতে যেন ফিরে গিয়েছিলেন ২৩ বছর আগের সেই রাতে। ম্যাচশেষে খেলোয়াড়দের আনন্দও ছাপিয়ে গেছে এই দুজনের উদযাপনে। দুজনই জানেন, এই দলটাও হয়ত খুব বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে না তাদের ক্লাব। তারা নিজেরাও তো খুব বেশিদিন আর থাকেননি আয়াক্সে। কিন্তু এই ক্লাবের সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক হয়ে গেছে ডাচ ফুবটলের।  

    নিজেদেরকে আয়াক্স তাই দেখে খেলোয়াড় তৈরির কারখানা হিসেবে। নতুনরা আসবেন, তাদের সঙ্গ দিতে থাকবেন টাডিচ, ব্লিন্ডরা। আয়াক্সকে আরেকবার জায়গামতো বসিয়ে দিয়ে কয়েকদিন পর দল ছাড়বেন আলো ছড়ানো তরুণেরা। বাকিরা শোনদের মতো অপেক্ষায় থাকবেন, এক মুহুর্তে রাঙিয়ে নেবেন নিজেদের। আর এভাবেই চলবে আয়াক্স। অনেক বছর পর হয়ত আবার ডি লিট, ডি ইয়ংরা কাঁধ মিলিয়ে উদযাপন করবেন 'ভদ্রলোক সেজে'। 

    তাই আরও একবার স্বেচ্ছায় সাইকেল হারাতে আমস্টারডামের লোকেদের কতোদিন অপেক্ষা করতে হবে- সেটা অজানাই থাকল। সবকিছুর সাফল্যের মাপকাঠি তো শিরোপাতে হয় না। বহু বছর পরও এই ম্যাচের হাইলাইটস সে কথাটাই মনে করিয়ে দেবে হয়ত।

    সকালে উঠে আগের রাতে হারিয়ে ফেলা সাইকেল খোঁজার সমস্যাটা তো আর প্রতিদিন মধুর মনে হয় না।