• কোপা আমেরিকা
  • " />

     

    তিতের ব্রাজিলের শেষ সুযোগ

    তিতের ব্রাজিলের শেষ সুযোগ    

    ১২ জুন, ২০১৬। কোপা আমেরিকার শতবর্ষপূর্তিতে আয়োজিত 'কোপা আমেরিকা সেন্টেনারিও'-তে পেরুর বিপক্ষে ড্র করলেই পরের রাউন্ডে যেত ব্রাজিল। কিন্তু বিতর্কিত ১-০ গোলের হারে ১৯৮৭ সালের পর সেবারই প্রথম কোপার গ্রুপপর্ব থেকে বিদায় নেয় 'সেলেসাও'রা। দিন দুয়েক বাদেই চাকরি হারান তৎকালীন কোচ দুঙ্গা, সপ্তাহখানেক বাদে দায়িত্ব নেন তিতে। রাশিয়া বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব দুর্দান্ত কাটলেও শেষ আটে বেলজিয়ামের বিপক্ষে বিদায় নিতে হয় পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের। দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম কোপা আমেরিকা মিশনে যাচ্ছেন তিনি। ১৪ জুন থেকে ব্রাজিলেই পর্দা উঠছে ৪৬তম কোপা আমেরিকা আসরের। ফেভারিট হিসেবেই টুর্নামেন্ট শুরু করবে ব্রাজিল, কিন্তু তারপরও পুরোপুরি স্বস্তি যেন নেই তিতের দলে। 'এ' গ্রুপে ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া এবং পেরুর বিপক্ষে খেলবে ব্রাজিল। ১২ বছরের কোপা অপেক্ষা ঘোচানোর খুব সম্ভবত সেরা সুযোগটাই এবার পাচ্ছে তিতের দল।

    ২০১৪ বিশ্বকাপও হয়েছিল ব্রাজিলেই, সেবার জার্মানির কাছে সেমিতে জার্মানির কাছে ভরাডুবির পর চাকরি হারিয়েছিলেন লুই ফিলিপে স্কোলারি। পাঁচ বছর পর আবারও ব্রাজিলে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট, এবার অন্তত ফাইনাল না খেললে হয়তো স্কলারির ভাগ্যই বরণ করে নিতে হতে পারে তিতেকে। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ৪-৩-৩ ফর্মেশনে দলকে খেলাচ্ছেন তিতে। নেইমার না থাকলেও একই ফর্মেশনেই দল সাজানোর সম্ভাবনাই বেশি ব্রাজিলের। রাশিয়া বিশ্বকাপের আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'কে কত বড় মাপের ফুটবলার তা ভাবার বিষয় নয়। দল বাছাইয়ে ফর্ম এবং ধারাবাহিকতাই দেখব আমি।' কথা ঠিকই রেখেছেন তিতে। বরাবরের মত এবারও নামের চেয়ে ফর্ম বা ধারাবাহিকতার দিকেই নজর দিয়েছেন তিনি। ইউরোপে প্রমাণিত মার্সেলো, ডেভিড লুইজরা জায়গা পাননি; কিন্তু দলে আছেন ডেভিড নেরেস, রিচার্লিসনদের মত তরুণরা। 

     

    শক্তিশালী এবং প্রতিশ্রুতিশীল স্কোয়াড

    অপ্রতিরোধ্য অ্যালিসন

    লিভারপুলের হয়ে পুরো মৌসুম ছিলেন দুর্দান্ত। ২০১৮-১৯ প্রিমিয়ার লিগে ক্লিনশিট রেখেছিলেন মোট ২১টি, জিতেছেন 'গোল্ডেন গ্লাভস' ও চ্যাম্পিয়নস লিগ। সুযোগ পেয়েছেন চ্যাম্পিয়নস লিগের মৌসুমসেরা স্কোয়াডেও। ব্রাজিলের গোলবারের নিচে অ্যালিসন বেকার জায়গা পাকা করেছেন অনেক আগেই। ইনজুরিতে না পড়লে কোপাতেও ব্রাজিলের গোলবারের নিচে দেখা যাবে অ্যালিসনকেই। 

    অনেক দল যখন বিশ্বমানের গোলরক্ষক খুঁজতে ব্যস্ত, সেখানে ব্রাজিলের বিলাসীতা রীতিমত ঈর্ষনীয়। অ্যালিসনের 'আন্ডারস্টাডি' হয়েই খুব সম্ভবত কোপায় যাচ্ছেন ম্যানচেস্টার সিটির গোলরক্ষক এডারসন মোরায়েস। ইংলিশ চ্যাম্পিয়নদের হয়ে দুর্দান্ত ছিলেন এডারসন, কিন্তু এবার হয়তো তার স্থান হবে ডাগ আউটেই। গোলরক্ষকদের মাঝে তিতের তৃতীয় পছন্দ করিন্থিয়ান্সের কাসিও।

     

    গোলরক্ষক

    অ্যালিসন বেকার (লিভারপুল), এডারসন মোরায়েস (ম্যানচেস্টার সিটি), কাসিও (করিন্থিয়ান্স)

     

     

    রক্ষণে অভাব নেই অভিজ্ঞতার

    শেষ ৫ ম্যাচে ব্রাজিলের রক্ষণে সিলভা এবং মার্কিনিয়োস জুটিকেই বেশি খেলিয়েছিলেন তিতে, ফুলব্যাক হিসেবে খেলেছেন আলভেজ এবং লুইস। সাম্প্রতিক একাদশে ব্রাজিলের রক্ষণে হয়তো খেলবেন তারাই। 

    মার্সেলো, লুইজদের না নিলেও অভিজ্ঞতার বিচারে হয়তো এবারের আসরে সবচেয়ে এগিয়ে ব্রাজিল। পিএসজি ত্রয়ী দানি আলভেজ, থিয়াগো সিলভা এবং মার্কিনিয়োসের সাথে আছেন ইন্টার মিলানের মিরান্ডা এবং অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের ফিলিপে লুইস। মার্সেলোর অনুপস্থিতিতে রক্ষণের বাঁ-পাশে লুইস এবং জুভেন্টাস লেফটব্যাক অ্যালেক্স সান্দ্রোর মাঝেই হয়তো একজন বেছে নেবেন তিতে। রক্ষণে আরও আছেন রিয়াল মাদ্রিদের নতুন সাইনিং এডার মিলিতাও। ডানপ্রান্তে অধিনায়ক আলভেজের 'ব্যাক আপ' হিসেবে থাকছেন করিন্থিয়ান্সের ফাগনার।

    ডিফেন্ডার

    অ্যালেক্স সান্দ্রো (জুভেন্টাস),  দানি আলভেজ, মার্কিনিয়োস, থিয়াগো সিলভা (পিএসজি), এডার মিলিতাও (রিয়াল মাদ্রিদ), ফাগনার (করিন্থিয়ান্স), মিরান্ডা (ইন্টার মিলান), ফিলিপে লুইজ (অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ) 

     

    দুশ্চিন্তার নাম মিডফিল্ড

    রাশিয়া বিশ্বকাপে ব্রাজিলের বিদায়ে অনেকেই নিষ্প্রাণ মিডফিল্ডকেই দায়ী করেছিলেন। কাসেমিরোর মত 'ডিপ লায়িং মিডফিল্ডার' এবং কুতিনিয়োর মত 'নাম্বার টেন' থাকায় হয়তো অপেক্ষাকৃত রক্ষণাত্মক চিন্তাধারার ফার্নান্দিনহো বা অ্যালানের চেয়ে হয়তো কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকবেন আর্থার। বার্সার হয়ে মাঝমাঠ থেকে ডিফেন্সচেরা পাস ছাড়াকে রীতিমত শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তিনি। অবশ্য পাকেতার সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, অভিষেকেই গোল পেয়ে নিজের সামর্থ্যের জানানটাও দিয়েছেন এসি মিলান মিডফিল্ডার।

    দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মূল একাদশ নিয়ে তেমন এক্সপেরিমেন্ট করেননি তিতে। কিন্তু মাঝমাঠ নিয়ে বেশ চিন্তায়ই পড়তে হয়েছে তাকে। কাসেমিরোর সাথে মিডফিল্ডে আর্থার মেলো, পাউলিনহোদের খেলালেও নিশ্চিতভাবে কোপায় ব্রাজিলের মিডফিল্ডে কারা খেলবেন- সেটা হয়তো জানেন না তিতে নিজেও। কাসেমিরো এবং ফিলিপ কুতিনিয়োর সাথে ব্রাজিলের মাঝমাঠে আর্থার, অ্যালান, ফার্নান্দিনহো বা তরুণ লুকাস পাকেতাদের কে নামবেন- সে বিষয়ে হয়তো এখনও দোটানায় ভুগছেন তিতে।

    মিডফিল্ডার

    অ্যালান (নাপোলি), ফিলিপ কুতিনিয়ো, আর্থার মেলো (বার্সেলোনা), কাসেমিরো (রিয়াল মাদ্রিদ), ফার্নান্দিনহো (ম্যানচেস্টার সিটি), লুকাস পাকেতা (এসি মিলান)

     

     

    নেইমার না থাকাই ব্রাজিলের 'শাপে বর'?

    কাতারের বিপক্ষে গত সপ্তাহে প্রীতি ম্যাচে নিজেদের ঝালিয়ে নেওয়ার ম্যাচে ইনজুরিতে পড়েছিলেন তিনি। ঐ ম্যাচেই শেষ হয়ে যায় নেইমারের কোপা স্বপ্ন, কিছুদিন আগে আলভেজের কাছে হারিয়েছিলেন অধিনায়কত্বও। পিএসজি ফরোয়ার্ডের বদলি হিসেবে চেলসির উইলিয়ানকে দলে নিয়েছেন তিতে। নেইমারের না থাকা একদিকে যেমন ব্রাজিলের জন্য হতাশার, অন্যদিকে তার অনুপস্থিতিই দলকে হয়তো করতে পারে আরও চমৎকার।

    রাশিয়া বিশ্বকাপের পর থেকে ব্রাজিলের আক্রমণে সবচেয়ে ধারাবাহিক নাম রিচার্লিসন, অভিষেকেই করেছিলেন জোড়া গোল। আক্রমণের ডানপ্রান্তে নেমেছিলেন এভারটনের ফরোয়ার্ড। বাঁ-প্রান্তে নেরেস এবং নেইমারকেই খেলিয়েছিলেন তিনি। গত বিশ্বকাপে ফিরমিনোকে কম সুযোগ দেওয়ায় বেশ সমালোচনা সইতে হয়েছিল তিতেকে। কিন্তু এ বছর প্রায় প্রতি ম্যাচেই হেসুস এবং ফিরমিনোকে অদলবদল করে খেলিয়েছেন তিনি। তাই রিচার্লিসনের সাথে আক্রমণে বাকি দুজন কে হবেন, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না এখনই।

    নেইমার না থাকায় মাঠের বাইরের বিতর্ক নিয়ে হয়তো এবার তেমন মাথা ঘামাতে হবে না ব্রাজিলকে। অবশ্য তাকে ছাড়াও খুব সম্ভবত কোপার সেরা ফরোয়ার্ড লাইন ব্রাজিলেরই। রিচার্লিসন এবং নেরেস নিজেদের লিগে সামর্থ্যের জানান দিয়েছেন, উইলিয়ান তো বেশ আগের পরীক্ষিত এবং প্রমাণিত ফুটবলার। আয়াক্সের রূপকথার মত মৌসুমে নিজেকে প্রমাণ করেই ব্রাজিলের দলে ডাক পেয়েছেন নেরেস। সাথে আছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা রবার্তো ফিরমিনো এবং ম্যানচেস্টার সিটির গ্যাব্রিয়েল হেসুস। আক্রমণ নিয়ে তাই ব্রাজিল সমর্থকদের উচ্ছ্বসিত থাকারই কথা। অভিজ্ঞতা এবং তারুণ্যের মিশেলে দারুণ সব ফরোয়ার্ডদের নিয়ে কোপা মিশন শুরু করবেন তিতে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্লাবের হয়ে প্রমাণিত, এবার অপেক্ষা দেশের জার্সিতে জ্বলে উঠার।

    ২০১৪ বিশ্বকাপে স্ট্রাইকারের গোলের অভাবটাই বেশ ভুগিয়েছে ব্রাজিলকে। পুরো টুর্নামেন্ট নিষ্প্রাণ ছিলেন হেসুস এবং ফিরমিনো। কিন্তু ২০১৮-১৯ মৌসুমে ১৬ গোল করেছেন ফিরমিনো, হেসুস জাল খুঁজে পেয়েছেন ২১বার। ক্লাবের হয়ে দারুণ ফর্মে থাকা দুই স্ট্রাইকারের দিকেই তাকিয়ে থাকবে ব্রাজিল।

     

     

    ফরোয়ার্ড

    উইলিয়ান (চেলসি), রবার্তো ফিরমিনো (লিভারপুল), রিচার্লিসন (এভারটন), এভারটন (গ্রেমিও), গ্যাব্রিয়েল হেসুস (ম্যানচেস্টার সিটি), ডেভিড নেরেস (আয়াক্স)

    সব কিছুই যখন ব্রাজিলেরই পক্ষে

    অন্তত কাগজে কলমে স্কোয়াডের শক্তিমত্তার বিচারে হয়তো অন্য সবার চেয়ে এগিয়েই থাকবে ব্রাজিল। অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে তাদের সমকক্ষ নয় এবার কেউই, তরুণরাও অন্যান্যদের চেয়ে বেশি প্রতিশ্রুতিশীল। সাথে আছে নিজেদের সমর্থকদের সামনে খেলার অনুপ্রেরণাও। সব মিলিয়ে 'ফেভারিট' ব্রাজিলই। কিন্তু ফুটবলের মত অনিশ্চয়তার খেলা যে কাগজে কলমে নয়, জেতা হয় মাঠে- সেটা তো ২০১৫ এবং ২০১৬-এর কোপার আসরেই টের পেয়েছে 'সেলেসাও'রা। কিন্তু তিতে নিশ্চিত করেছেন, আপাতত গ্রুপপর্ব পেরুনোর দিকেই নজর দিচ্ছেন তারা।

    বাস্তবতা যা বলে

    'এ' গ্রুপে ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া এবং পেরুর বিপক্ষে খেলবে ব্রাজিল। গ্রুপপর্ব থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়েই শেষ আটে যাওয়ার কথা 'সেলেসাও'দের। সব মিলিয়ে মারাকানায় ৭ জুলাইয়ের ফাইনালে ব্রাজিলকেই দেখার সম্ভাবনা প্রবল।