• ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯
  • " />

     

    যেভাবে টন্টন-কাব্য লিখলেন সাকিব-লিটন

    যেভাবে টন্টন-কাব্য লিখলেন সাকিব-লিটন    

    ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩২১/৮, ৫০ ওভার 
    বাংলাদেশ ৩২২/৩, ৪১.৩ ওভার 
    বাংলাদেশ ৭ উইকেটে জয়ী 


    টন্টন, ১৯৯৯। শ্রীলঙ্কার প্রতিপক্ষ ভারত। সৌরভ গাঙ্গুলি ও রাহুল দ্রাবিড় চালালেন ধ্বংসযজ্ঞ। দর্শক ছিলেন ছোট্ট জস বাটলার, যার মনে হয়েছিল, এমন ব্যাটিং যদি করতে পারতেন তিনি! সেদিন গাঙ্গুলি-দ্রাবিড় দুজনই পেয়েছিলেন সেঞ্চুরি, গড়েছিলেন রেকর্ড। ওভারপ্রতি ভারত রান তুলেছিল ৭.৪৬ হারে। ২০ বছর পর সেই টন্টনে এদিন সেঞ্চুরি পেলেন একজন, আরেকজন অল্পর জন্য পেলেন না। তবে গ্যালারিতে ভবিষ্যতের বাটলারের জন্য রসদ থাকল এদিনও। কীভাবে ‘ক্ল্যাসিক’ ব্যাটিং করে বড় রানতাড়াকে বানানো যায় ছেলেখেলা, কীভাবে প্রতিপক্ষর ওপর চালানো যায় ধ্বংসযজ্ঞ, সেসব ভাবনার রসদ। এদিন দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের রানরেট থাকলো ৭.৭৫।

    অথচ ৩২২ রানের এই লক্ষ্যটা প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেসারদের সামনে শক্ত এক পরীক্ষায় বসার কথা ছিল বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের। সাকিব আল হাসান ও লিটন দাসরা সেটিকে বানিয়ে ফেললেন ছেলেখেলা। শুরুতে তামিম ইকবাল রাখলেন অবদান, এর আগে এ উইকেট ও এ মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৩২১ রানে বেঁধে ফেলার কৃতিত্বটা নিলেন বোলাররা। টন্টনে বাংলাদেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে উড়িয়ে দিয়ে তাদের বিপক্ষে পেল বিশ্বকাপে প্রথম জয়। সাকিব করলেন বিশ্বকাপে টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি, লিটন বিশ্বকাপ অভিষেকেই উজ্জ্বল ৬৯ বলে ৯৪ রানে। বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে রোমাঞ্চিত হওয়ার ষোল আনা অধিকার আছে আপনার, এ ম্যাচটা যেন দেখিয়ে দিল সেটাই। 

    রানতাড়ায় সৌম্য সরকার ও তামিম ইকবাল শুরুতে নেমেছিলেন মিশন নিয়েই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের শর্ট বা শর্ট অফ আ লেংথের বলে ‘টাচ’ পন্থা বেছে নিয়েছিলেন সৌম্য। খেলছিলেন থার্ডম্যান থেকে পয়েন্টের দিক করে। রাসেলকে একটা ছয় মারলেন জোরের ওপর খেলে, তবে পরের বলেই আগের মুডে ফিরে গিয়ে হারিয়েছেন উইকেট, স্লিপে ক্রিস গেইলের কাছে গেছে ক্যাচ। আগের ম্যাচগুলিতে শর্ট বলে দারুণ ভোগা তামিমও বের করলেন নিজের পথটা। শুরুতে একটু ধীরগতির ছিলেন, জেসন হোল্ডারকে দুই চারে গিয়ার বদলালেন। এরপর রাসেলকে আরও দুটি, স্ট্রাইক রেটটা হয়ে গেল ১০০। ফর্মটা ফিফটি করেই ফিরে পাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন, অদ্ভুত এক রান-আউটে সেটা পাওয়া হলো না তার। 


    সাকিব-লিটন, ফিরিয়ে আনলেন ২০ বছর আগের স্মৃতি?/এএফপি


    কটরেলকে বোলারস ব্যাক-ড্রাইভ খেলে ফলো-থ্রুতে এগিয়েছিলেন তামিম, কটরেল সে সুযোগেই বুলেটগতির থ্রো করে ভেঙেছেন স্টাম্প। ডাইভ দিলেও তার নিচে বল গেছে তামিমের। সাকিবের সঙ্গে ৬৯ রানের জুটি ভেঙেছে তাতেই। ৯ বল ও ১২ রানের ব্যবধানে থমাসের লেগস্টাম্পের বাইরের বলে ফ্লিক করতে গিয়ে এজড মুশফিক, বাংলাদেশের সামনে হাজির তখন চাপ। 

    এর আগে বৃষ্টি উঁকি দিচ্ছিল, তবে ঝড়োগতির ব্যাটিং ডি-এলে এগিয়ে রেখেছিল বাংলাদেশকে। এবার যেন হাজির অন্যরকম চ্যালেঞ্জ, ‘আসল’ চ্যালেঞ্জ। সাকিবের সঙ্গে যোগ দিতে এলেন লিটন দাস, বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো খেলতে নেমেছেন যিনি। এরপর যা হলো, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওপর সেটাকে বলা যায় ধ্বংসযজ্ঞ। ২২.৩ ওভার, ১৮৯ রান, ০ উইকেট। ম্যাচ শেষ। এমনই! 

    ওয়েস্ট ইন্ডিজের ছিল ‘অল-আউট’ পেস আক্রমণ, তার ওপর আন্দ্রে রাসেলকে দেখেই মনে হচ্ছিল তিনি ফিট নন। কয়েকবার মাঠও ছেড়েছিলেন। ক্রিস গেইলকে দিয়ে ২ ওভার করিয়েছেন হোল্ডার, তবে গেইল গুণেছিলেন ২২ রান।

    ৪০ বলে ফিফটি করেছিলেন সাকিব, এ বিশ্বকাপে চার ইনিংস খেলে চতুর্থ ফিফটি বা তার বেশি রানের ইনিংস ছিল এটি। এর আগেই দ্বিতীয় বাংলাদেশী হিসেবে ওয়ানডেতে ছয় হাজার রানও হয়ে গেছে তার। রাসেলের শর্ট বলে হুক করেছিলেন একটা, তবে সেটা নিতে পারেননি শেই হোপ বা শ্যানন গ্যাব্রিয়েলের কেউই। সে মুহুর্ত থেকেই যেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ছিটকে দিয়েছেন সাকিবরা। 

    থমাসকে রাজকীয় কাভার ড্রাইভে পূর্ণ করেছেন টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। শেষ পর্যন্ত ৯৯ বলে অপরাজিত ছিলেন ১২৪ রানে। ১৬টি চার মারলেও ছয় মারেননি। বলা ভাল, ছয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি তিনি। টন্টনের 'ছোট' মাঠেও সাকিব দেখিয়েছেন ব্যাটিং মাস্টারক্লাস! আর লিটন খেলেছেন দারুণ এক ইনিংস। ৪০ বলে ফিফটি পূর্ণ করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত সেঞ্চুরি পাননি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোর্ডে আর রান ছিল না বলেই। তার পূর্বসূরীর মতো অতটা ‘ঝুঁকিহীন’ ব্যাটিং করেননি লিটন, মেরেছেন ৮টি চারের সঙ্গে ৪টি ছয়। যে চারটির তিনটিই এসেছে গ্যাব্রিয়েলের করা ৩৮তম ওভারের প্রথম তিন বলে! মূলত সে ওভারের পরই বাংলাদেশের জয়টা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সময়ের অপেক্ষা। 



    অথচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিংয়ের সময়ও লক্ষ্যটা কঠিনই মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের জন্য। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটিংয়ের মূল কারিগর ছিলেন শেই হোপ, বাংলাদেশকে পেলেই বড় ইনিংস খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে যার জন্য অভ্যাস। শুরুতে এভিন লুইসের সঙ্গে ১১৬ রানের জুটির পর শিমরন হেটমায়ারের সঙ্গে মাত্র ৪৩ বলে ৮৩ রানের পর জেসন হোল্ডারের সঙ্গে তার ২২ বলে ৩৯ রানের জুটিই মূলত ৩০০ পেরুতে সহায়তা করেছে তাদের। 

    শুরুতে গেইল-হুমকিটা কাটিয়েছিলেন মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন। ১৩তম বলে গিয়ে শূন্যতে ফিরেছেন গেইল, লেংথে ব্যতিব্যস্ত রেখেছিলেন, এরপর লাইন ধরে রাখা বলে চেক শট খেলতে গিয়ে আউটসাইড-এজড হয়েছিলেন গেইল। প্রথম ১০ ওভারে ৩২ রান তুলেছিল তারা। পরের ১০ ওভারে এভিন লুইসকে নিয়ে মেরামতের কাজটা করেছেন হোপ।  

    ফিফটির পরপর লুইসকে ফিরিয়েছেন ২১তম ওভারে প্রথম বোলিং করতে আসা সাকিব, যিনি নিজের ২য় ওভারে গুণেছিলেন ১৪ রান। লুইসের পর সাকিব ফিরিয়েছেন পুরানকেও। এরপরই শুরু হয়েছিল হেটমায়ার ঝড়। মাত্র ২৫ বলে ফিফটি করেছেন এই বাঁহাতি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের নাগালের মধ্যেই ছিল তখন ৩৫০ বা এর বেশি কিছু। মোস্তাফিজুর রহমানের এক ওভারই বদলে দিয়েছে চিত্রটা। 

    এর আগে ৫ ওভারে ৪০ রান দিয়ে বিবর্ণ ছিলেন মোস্তাফিজ, ৬ষ্ঠ ওভারে এসে হেটমায়ারের পর ফেরালেন রাসেলকে। রাসেলের উইকেটটা মনে করালো ইন-ফর্ম মোস্তাফিজকে। ওভার দ্য উইকেট থেকে করা ক্রস সিমের বলটা অ্যাঙ্গেল করে বেরিয়ে গেল, যাওয়ার আগে চুমু দিয়ে গেল ব্যাটসম্যানের ব্যাট। আর হেটমায়ার পরিণত হয়েছিলেন তামিমের দারুণ এক ক্যাচের, ডিপ থেকে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে যে ক্যাচটা নিলেন তিনি, সেটাই ফুটিয়ে তুলল বাংলাদেশের এদিন ফিল্ডিংয়ের চিত্রটা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের পর সাকিব বলেছিলেন, তারা ‘টপ’-এ থাকলে ফিল্ডিংটাও ‘টপ’ হয় তাদের। গ্রাউন্ড ফিল্ডিং বা ক্যাচিং, দুটিতেই বাংলাদেশ ছিল ‘টপ’-এ। 

    শেষদিকে হোল্ডারের ১৫ বলে ৩৩ রানের পরও ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাই গেছে ৩২১ পর্যন্ত। যেটিকে মনে হচ্ছিল খুব সহজ পথ নয়। 

    যেটিকে শেষ পর্যন্ত খুব সহজ কিছু বানিয়ে ফেলল বাংলাদেশ। গ্যালারি হয়তো ছিলেন ভবিষ্যতের কোনও বাটলার! অনেকদিন পর যিনি বলবেন, সাকিব-লিটনের ব্যাটিংয়ের কথা।