• ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯
  • " />

     

    ইয়র্কার তার কবেকার...

    ইয়র্কার তার কবেকার...    

    অসম্ভব শব্দটার তল আদতে কতখানি গভীরে? কতোটা গেলে হারিয়ে যেতে হয় অসম্ভবের অতল গহবরে? নিশ্চিতভাবেই সেটা নির্ভর করছে প্রেক্ষাপটের ওপর। লাসিথ মালিঙ্গার ওই ইয়র্কার খেলার মতো। মাঝে মাঝেই আপনার অনুভূতি হবে, সেটা খেলা অসম্ভব। আপনি জানেন, কী আসতে চলেছে। আপনি জানেন, কী হতে চলেছে। তবুও আপনি নড়বড়ে হয়ে যাবেন, আপনি  মিস করে যাবেন। তা আপনি হোন না জনি বেইরস্টো বা জস বাটলার। সেই অসম্ভবে সম্ভব হবে আরেক অসম্ভব। আর প্রাণ ফিরে পাবে ক্লান্ত-শ্রান্ত বিশ্বকাপ। 

    ****

    প্রভিডেন্স, গায়ানা, ২০০৭। সে ম্যাচে আদতে কিছু বাকি নেই তখন। অথবা অনেকেই ভেবেছিলেন সেরকম। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ৬ ওভারে ১০ রান, বাকি ৫ উইকেট। এলেন মালিঙ্গা। ৩২ বলে ৪ রান দরকার। এরপর শন পোলক পেলেন সেই ডেলিভারি। ব্লকহোলে। ব্যাট নামালেন বটে, বল থামাতে পারলেন না। মালিঙ্গার উদযাপনটা বাঁধনহারা হলো না ততোটা। অ্যান্ড্রু হল পেলেন আরেকটি ইয়র্কার। অফস্টাম্পের একটু বাইরে। ‘ডিপ’ করে ঢুকছে, যেন ‘টিজ’ করছে বলটা। হল আগবাড়িয়ে খেলতে গেলেন, গড়বড় হয়ে গেল টাইমিংয়ে। দুইয়ে দুই মালিঙ্গার। 

    চামিন্দা ভাস পরের ওভারে দিলেন এক রান। আবার মালিঙ্গা। এবার সামনে জ্যাক ক্যালিস। প্রায় ১৮৭ মিনিট ধরে ক্রিজে তিনি। অফস্টাম্পের বাইরের ফুললেংথের বল, ব্যাট চালিয়ে এজড। ড্যারিল হার্পার একটু সময় নিলেন। এরপর দিলেন আউট। মালিঙ্গার তিনে তিন। ছোট বাচ্চার মতো করে উল্লাস করছেন, যেন পরম আরাধ্য উপহারটা পেয়ে গেছেন। আম্পায়ার হার্পারের মাথায় হ্যাট নেই। কারণটা বাতাস নয়, মালিঙ্গার অ্যাকশন। তার স্লিঙ্গিং অ্যাকশনে বল ডেলিভারি হয় প্রায় আম্পায়ারের মাথা বরাবর থেকে। সাদা হ্যাট, সাদা বল মিলিয়ে ধন্দে পড়ে যান ব্যাটসম্যানরা। হার্পার তাই হ্যাট খুলে হাতে রেখেছেন। 

    মালিঙ্গার অ্যাকশনটাই এমন- আলাদা। তবে আরও সব আন-অর্থোডক্স ক্রিকেটারের মতো তার চ্যালেঞ্জটাও শুরু থেকেই ছিল আলাদা। ঠিক কেন এমন স্লিংগিং অ্যাকশনে বোলিং শুরু করেছিলেন, মালিঙ্গা সেটা মনে করতে পারেন না। তবে শুরু থেকেই এমন। কোচরাও তাকে নিয়ে ধন্দে পড়ে যেতেন। তার বোলিং অ্যাকশন ‘ঠিক’ করার উপায় নেই, সে অ্যাকশনে তাকে কী শেখাবেন প্রশ্ন সেটাও। কেউ উপদেশ দিতেন, সে অ্যাকশনে পিঠ টিকবে না বেশিদিন তার। চম্পকা রমানায়েকে অবশ্য সমর্থন দিয়েছিলেন তাকে। মালিঙ্গার চিন্তা-ভাবনা তখন থেকেই ছিল পরিষ্কার। তার মস্তিস্ক বেশ প্রখর, মনে রাখতে পারেন অনেক কিছু। সঙ্গে কী করতে চান, কীভাবে করতে চান, সেসব নিয়েও ধারণা পরিষ্কার। তবে মালিঙ্গাকে সবকিছু করতে হয়েছে নিজের মতো করে। তিনি যে আর সবার চেয়ে আলাদা! 

     

     

    প্রভিডেন্সেও সেদিন আলাদা কিছু করলেন মালিঙ্গা। হ্যাটট্রিক হয়ে গিয়েছিল আগেই, এবার মাখায়া এনটিনি হলেন তার চতুর্থ শিকার। আবার সেই ইয়র্কার, নেই স্টাম্প। চার বলে চার উইকেট নেওয়া প্রথম বোলার হলেন মালিঙ্গা। যে ম্যাচে আদতে কিছু ছিল না, সে ম্যাচে শুধু প্রাণ ফেরালেন না, মালিঙ্গা শ্রীলঙ্কাকে দেখালেন অসম্ভব এক স্বপ্ন। 

    হেডিংলিতে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং ইনিংস শুরু হওয়ার সময় ক্রিকভিজ অনুযায়ী শ্রীলঙ্কার জয়ের সম্ভাবনা ছিল ২ শতাংশ। অসম্ভবের মাপকাঠি থাকলে সেটার চেহারা নিশ্চিতভাবেই এমন হতো। ১০ দলের বিশ্বকাপ, শুরু থেকেই ছিল রোমাঞ্চের হাতছানি। দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এমনকি আফগানিস্তানও সেই রোমাঞ্চকে দেখাচ্ছিল বুড়ো আঙুল। সঙ্গে বেপরোয়া বৃষ্টি। যা রোমাঞ্চ যেন বাংলাদেশ আর সাকিব আল হাসানকেই ঘিরেই! 

    দ্বিতীয় বলেই বেইরস্টো পেলেন মালিঙ্গার সেই ক্ল্যাসিক ডেলিভারি। ইয়র্কার। খেলতে গিয়ে মিস। হতাশ হেডিংলি। ইয়র্কশায়ারের ঘরের ছেলে বেইরস্টোকে তারা আরও কিছুক্ষণ দেখতে চেয়েছিলেন হয়তো ব্যাটিংয়ে। তখনও ম্যাচের পরিস্থিতি ছিল এমনই। বিশ্বকাপে প্রাণ ফেরেনি তখনও। ইংল্যান্ড তখনও এক পা বাড়িয়ে রেখেছে সেমিফাইনালের দিকে। টালমাটাল শ্রীলঙ্কা এক পা এগিয়ে গেছে বিশ্বকাপের বাইরে। 

    মালিঙ্গা এবার বাইরে পাঠালেন জেমস ভিনসকে। পরপর দুই বলে চার মেরেছিলেন ভিনস। তবে মালিঙ্গা ভড়কে গেলেন না, করুনারত্নে বিশ্বাস রাখলেন মালিঙ্গার ওপর। শর্ট এক্সট্রা কাভারে ফিল্ডার এলো। চোখের সামনে ফিল্ডার দেখে ভড়কে গেলেন ভিনসই। কিছুটা ক্রিজে আটকে থেকে ব্যাট চালিয়ে এজড, স্লিপে গেল ক্যাচ। মালিঙ্গা উল্লাসে মত্ত। শ্রীলঙ্কার জয়ের সম্ভাবনা অবশ্য তখনও রয়ে গেছে গেছে দশের নিচেই। 

    জো রুট-অইন মরগানের জুটি এরপর শ্রীলঙ্কাকে ছিটকে দিতে চেয়েছে ম্যাচ থেকে। মালিঙ্গা ফিরেছেন। লেগস্টাম্পের বাইরের নিরীহ বলটায় ফ্লিক করতে গিয়ে খোঁচা দিয়েছেন রুট। তবে দাঁড়িয়ে ছিলেন, চেহারায় কেমন একটা ভাব। রিভিউ নিলেন করুনারত্নে। আল্ট্রা-এজ দেখালো স্পাইক। যেন এনজিওগ্রাম রিপোর্টে হার্ট-অ্যাটাক করা রোগীর হৃদস্পন্দন ফিরে এসেছে। ম্যাচে স্পন্দন আনলেন মালিঙ্গা। 

    তবে ছিলেন বাটলার। শ্রীলঙ্কার জয়ের সম্ভাবনা তখনও দশ শতাংশের নিচে। আবার মালিঙ্গার সেই ইয়র্কার। বাটলার ফ্লিক করতে গিয়ে এলবিডব্লিউ। মালিঙ্গা বোলিং করে গেছেন আম্পায়ার পল উইলসনের প্রান্ত থেকে। বেশ ব্যস্ত দিন গেছে ‘ডকার’ নামের অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ারের। তবে হার্পারের মতো হ্যাট খুলে হাতে নিতে হয়নি তার, অনেকদিন থেকে আম্পায়ারদের হ্যাটের রঙ সাদা থেকে বদলে হয়ে গেছে কালো। বাটলার অবশ্য বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে রিভিউ নিলেন, যেন ইনসাইড-এজ হয়েছে তার। আল্ট্রা-এজ কোনও স্পাইক দেখালো না, ইংল্যান্ডের হৃদস্পন্দন থেমে গেছে। বাটলারের উইকেটের পর শ্রীলঙ্কার জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে গেল প্রায় ১৫ শতাংশ। অন্তত তখন আর ব্যাপারটা অসম্ভবের পর্যায়ে নেই। 

    তবে ইংল্যান্ডের আশা ছিল বেন স্টোকস থাকা পর্যন্ত। শ্রীলঙ্কা ও জয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনিই। মালিঙ্গার বাকি এক ওভার। স্টোকসের ট্যাকটিকস তখন পরিস্কার। আর যাকেই হোক, মালিঙ্গাকে আক্রমণ করা যাবে না। পঞ্চম বলে অবশ্য ফ্লিক করলেন জোরের ওপর। তবে মিডউইকেটে ঠিকঠাক ক্যাচটা হাতে নিতে পারলেন না সেটা ফিল্ডার। 


    ****

    ২০১৬, ২১ জুন, ট্রেন্টব্রিজ। শেষ বলে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ৭ রান, ৬ হলে টাই। নুয়ান প্রদিপ সে ওভারে ব্লকহোলেই করছিলেন, শেষ বলটাও করতে গেলেন সেখানেই। একটু শর্ট করে ফেললেন, লিয়াম প্লাঙ্কেট টেনে মারলেন ছয়। তিন বছর পর ঠিক সেই দিনেই আবার শেষ ব্যাটসম্যানের মুখোমুখি প্রদিপ। কদিন আগেই আঙুলে চোট পেয়ে বাইরে গিয়েছিলেন। এবার আর ব্লকহোল নয়, প্রদিপ মার্ক উডকে করলেন ‘অনিয়শ্চয়তার করিডোর’-এ। উড খোঁচা না মেরে পারলেন না। উল্লাসে মাতল শ্রীলঙ্কা। 

    ম্যাচজুড়ে দারুণ বোলিংয়ের পুরস্কার পেলেন প্রদিপ। আর ম্যাচসেরা মালিঙ্গা। ম্যাচশেষে তার একটা ছবি ঘুরে ফিরছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। আদুল গায়ে ভুড়িটা ঠেলে বের হয়ে আছে সামনে। মাহেলা জয়াবর্ধনে টুইট করলেন- ভাল বোলিংয়ের জন্য সিক্স প্যাক দরকার নেই, দরকার স্কিল। এ ম্যাচে অন্য যে কোনও বোলারের চেয়ে বেশি সুইং পেয়েছেন মালিঙ্গা, তবে সেসবকে ছাপিয়ে গেছে তার ইয়র্কারের স্কিল। সেই ইয়র্কার, যা সময়ে সময়ে ব্যাটসম্যানদের জন্য খেলা হয়ে পড়ে অসম্ভব। 

    সেই ইয়র্কার, যা প্রাণ ফিরিয়েছিল ২০০৭ বিশ্বকাপে প্রভিডেন্সের সেই ম্যাচে। সেই ইয়র্কার, যা প্রাণ ফেরালো ২০১৯ বিশ্বকাপে। মালিঙ্গার চুলের রঙ বদলে গেছে। বিশ্বকাপের ফরম্যাট বদলে গেছে। আম্পায়ারের হ্যাটের রঙ বদলে গেছে। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট বদলে গেছে। শুধু বদলায়নি মালিঙ্গার ইয়র্কার আর তার স্কিল।

    যে ইয়র্কার ক্লান্ত বিশ্বকাপকে দুদন্ড শান্তি দেয়। যে ইয়র্কারে শ্রীলঙ্কা জয় করে অসম্ভবকে।