• " />

     

    বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচ

    বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচ    

    প্যাভিলিয়ন-কিউট আয়োজিত স্পোর্টস ফিচার লেখা প্রতিযোগিতা 'খেলার লেখা, লেখার খেলা -১' এর দশজন বিজয়ীর লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে! আজ থাকছে চতুর্থ স্থান অধিকারী নওশাদ জামান-এর লেখা ''বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচ"।

     

    উপমহাদেশীয় অঞ্চলের দলগুলোর মধ্যে ফুটবল শ্রেষ্ঠত্ব বিচারের অন্যতম মাধ্যম হল সাফ গেমস এবং সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবল। এখন পর্যন্ত দুটি টুর্নামেন্টেই একবার করে শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। ২০০৩ সালে দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে এখন পর্যন্ত একমাত্র শিরোপার দেখা পেয়েছি আমরা। ঐ টুর্নামেন্ট জয়ের পথেই সেমিফাইনালে শিরোপার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। দিন শেষে বাংলাদেশ ভারতকে বাড়ী ফেরার টিকেট ধরিয়ে শিরোপার পথে এগিয়ে যায় আর এক ধাপ। এই ম্যাচটি যারা দেখেছেন তারা চোখ বুঁজে স্বীকার করেন এটি বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা একটি ম্যাচ।

     

    টুর্নামেন্টে নিজেদের গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিতে ওঠে বাংলাদেশ। অপরদিকে নিজ গ্রুপে রানার্স-আপ হয় ভারত। ফলে যে ম্যাচকে সম্ভাব্য ফাইনাল ধরে রেখেছিলেন ফুটবল বোদ্ধারা সেটির দেখা সেমিতেই পেয়ে যান তাঁরা। আর দু-দলের খেলোয়াড়েরাও হতাশ করেননি। চমৎকার ফুটবল নৈপূণ্যে দর্শকদের উপহার দিয়েছেন সারা জীবন বলে বেড়ানোর মত স্মৃতি।

     

    ১৮ জানুয়ারী ২০০৩। মাঠে গড়াল খেলা। কিক-অফের পর থেকেই দুই দলের আক্রমণ শুরু। তখনকার বাংলাদেশী কোচ জর্জ কোটান ভারতবধের উদ্দেশ্যে ৩-৫-২ কৌশলে “পাস অ্যান্ড রান” পদ্ধতিতে খেলা শুরু করেন। অর্থাৎ দুই উইংব্যাক হাসান-আল-মামুন এবং পারভেজ বাবু ক্রমাগত ওভারল্যাপ করে উঠে আক্রমনে সহায়তা দিতে লাগলেন। সেন্ট্রাল ডিফেন্সে তিন নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ সুজন এবং অধিনায়ক রজনীকান্ত বর্মন। সেন্টার মিডফিল্ডে আরিফ খান জয় এবং মতিউর মুন্না। যার মধ্যে জয় খেলেন নীচে ডিফেন্ডারদের সামনে আস্থার দেওয়াল হয়ে আর মুন্না কিছুটা উপরে আক্রমণভাগের সাথে লিঙ্ক হিসেবে। আর প্লে-মেকার হিসেবে আরমান মিয়া। স্ট্রাইকার হিসেবে ৯৯ সাফ গেমসের ফাইনাল জেতানো দেশের ইতিহাসের সেরা আলফাজ আহমেদ এবং তৎকালীন সময়ের সেরা স্ট্রাইকার রোকনুজ্জামান কাঞ্চন। গোলকিপার ছিলেন আমিনুল হক।

     

    পরিকল্পনা খুব দ্রুতই কাজে লাগাতে শুরু করলো বাংলাদেশ। শুরু থেকেই আক্রমণে তারা। মাত্র পাঁচ মিনিট বয়স যখন ম্যাচের তখনি কর্নার পায় বাংলাদেশ। আরমানের নেওয়া কর্নার লাফিয়ে উঠে চমৎকার হেড করেছিলেন বটে কাঞ্চন। তবে ঠিক যখন গোলে ঢুকতে যাবে বল,তখনি গোল লাইন থেকে ক্লিয়ার করেন ভারতের ক্লাইম্যাক্স লরেন্স। সুবর্ণ সুযোগ মিসে সবাই কিছুটা হতাশ হলেও খুব শীঘ্রই সেটা কাটিয়ে ওঠেন তারা। আবারো আক্রমণ চালাতে থাকেন একের পর এক। তবে ভারতের ডিফেন্সিভ ওয়ালে গিয়ে সেগুলো বাধা পেয়ে যাচ্ছিলো। এর মধ্যে ভারতও শুরুর হতবিহবল ভাব কাটিয়ে উঠে খেলায় ফিরতে শুরু করে। দুই দুইবার বেশ ভালো সুযোগও সৃষ্টি করে তারা। তবে দুইবারই পল আঞ্চেরির শট ফিরিয়ে দেন নির্ভরতার প্রতীক আমিনুল। এভাবেই শেষ হয় প্রথমার্ধ।

     

    টুর্নামেন্টের আগের ম্যাচগুলোতে দেখা গিয়েছিলো দ্বিতীয়ার্ধে কৌশল পালটে ৫-৩-২ ফর্মেশনে চলে যেত বাংলাদেশ। অর্থাৎ হাসান-আল-মামুন ও পারভেজ বাবু তখন ডিফেন্সিভ খেলতেন বেশ কিছুটা আর মূল খেলাটা তৈরী হত মাঝমাঠে মুন্না ও আরমানের সহায়তায়। মূলত এদেশী খেলোয়াড়েরা পুরো সমানতালে ৯০ মিনিট হয়ত খেলতে পারবেনা এমন ধারনা থেকেই কোচের এই স্ট্র্যাটেজী। তবে এই ম্যাচে এই কৌশল পালটান কোচ। এর মূল কারণ ছিলো দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে ভারতের বল নিজেদের পায়ে রাখার চেষ্টা। কাজেই ডিফেন্সিভ না হয়ে বরং অ্যাটাকে গেলেন কোচ। লেফট-ব্যাক পারভেজ বাবুকে তুলে স্ট্রাইকার আরিফুল কবির ফরহাদকে নামালেন ৫৬ মিনিটের মাথায়। তবুও আক্রমণগুলো বাংলাদেশের বিপক্ষেই হচ্ছিলো বেশী। বল পজেশনেও এগিয়ে ছিলো ভারত।তবে তিন সেন্টার-ব্যাক আস্থার দারুণ প্রতিদান দিচ্ছিলেন। বাংলাদেশের যা আক্রমণ ছিলো তা প্রতিপক্ষের ডিফেন্সিভ থার্ডে গিয়ে আর পূর্ণতা পাচ্ছিলো না।

     

    ৭৭ মিনিটে কর্ণার পায় বাংলাদেশ। বিশ্বস্ত আরমান এগিয়ে যান কর্নার নিতে। মাপা কর্নার সেকেন্ড পোস্টে। কাঞ্চন লাফিয়ে উঠে হেড করলেন। অনেকটা প্রথমার্ধের সেই গোল লাইন সেভের কার্বন কপি বলা যায়। তবে এবার আর হৃদয় ভাঙলো না খেলোয়াড়দের। মাঠ ও মাঠের বাইরে অসংখ্য দর্শককে আনন্দে ভাসিয়ে বল জালে। গোওওওল!!! খেলার ১৩ মিনিট বাকী থাকতে এমন গোল। ফাইনাল দেখতে শুরু করলো গোটা দেশ এবং ভুলটা করলো।

     

    ফাইনাল প্রায় নিশ্চিত ভেবে খেলোয়াড়েরাও মনে হয় কিছুটা গাছাড়া মনোভাব দেখাতে শুরু করেন। আর এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে ভারত। এই গোলের ঠিক চার মিনিট পরেই বাংলাদেশের ডি-বক্সের কিছুটা বাইরে বল পান ভারতের আলভিটো ডি চুনহা। আশেপাশে পাস দেবেন তেমন কেউ নেই। ডিফেন্ডার ট্যাকল করতে কিছুটা গড়িমসি করেন। গোলরক্ষক আমিনুলও কেন জানি পোস্ট থেকে কিছুটা বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। আচমকা শট নেন আলভিটো। আমিনুলের মাথার উপর দিয়ে বল জালে। খেলায় সমতা। টুর্নামেন্টে সেই প্রথম বাংলাদেশের জালে বল। এর আগে ৩৫১ মিনিট নিজের পোস্ট অক্ষত রাখলেও ক্ষণিকের ভুলে গোল খেয়ে বসলেন আমিনুল। এই গোলে কিছুটা ভড়কে যায় বাংলাদেশ।

     

    এই ভড়কে যাওয়ার সুযোগ নিতে ভারতও পিছপা নয়। কিছুক্ষণ পরেই বাম প্রান্ত থেকে ভারতের এক খেলোয়াড় ক্রস করেন। এক স্ট্রাইকার অভিষেক যাদব সেটা বুকে রিসিভ করার পর বাংলাদেশী ডিফেন্ডারদের এলোমেলো অবস্থার কারণে বল গিয়ে পড়ে ভারতের বিখ্যাত স্ট্রাইকার আই,এম, বিজয়নের পায়ে। ছোট ডি-বক্সের ঠিক বাইরে থেকে বিজয়নের শট চলে গেল ক্রসবারের ওপর দিয়ে। অল্পের জন্যে বেঁচে গেলো বাংলাদেশ। বাকী সময়টুকু টেনশনের! একদিকে হঠাত ভঙ্গুর হয়ে পড়া ডিফেন্স অপরদিকে আচমকা গোলে মনোবলে ফাটল। কোনোমতে কাটিয়ে খেলা অতিরিক্ত সময়ে নিলো বাংলাদেশ।

     

    শুরু হয় অতিরিক্ত সময়ের খেলা। তখন পর্যন্ত গোল্ডেন গোল নিয়ম চালু ছিলো। অর্থাৎ এই ৩০ মিনিটে যে দল আগে গোল করবে তারাই জয়ী। একদল আক্রমণে উঠলেই অপর দলের সমর্থকদের বুক কাঁপে, এই বুঝি সব শেষ! অতিরিক্ত সময়ের শুরুতেই কোচ দুটি পরিবর্তন আনেন। দুই অভিজ্ঞ খেলোয়াড় হাসান-আল-মামুন আর আলফাজ আহমেদকে বসিয়ে মাঠে নামান ফিরোজ মাহমুদ হোসেন টিটু আর মেহেদী হাসান উজ্জ্বলকে। তবে তারা নিজেদের কোচের এই সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা প্রমাণের কোনো সুযোগ পাননি। কারণ গোল্ডেন গোলের টেনশনে যে এদেশের মানুষকে খুব বেশীক্ষণ থাকতে হয়নি!

     

    ম্যাচের বয়স তখন অতিরিক্ত সময়ের আট মিনিট। মাঝমাঠে বল কেড়ে নিয়ে মতিউর মুন্নার দৌড় এবং কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে  প্রায় বিশ মিটার দূর থেকে আচমকা জোরালো লং-রেঞ্জ শট। পুরো ভারতীয় দলকে হতবাক করে এবং এদেশের আপামর মানুষকে আনন্দে ভাসিয়ে বল গোল লাইন অতিক্রম করলো। গোল্ডেন গোল! এই নামটির একেবারে সার্থক উদাহরণ যেন গোলটি! সত্যিই এদেশের ফুটবলের শ্রেষ্ঠ সাফল্যের পেছনে এই গোলটির ভূমিকা স্বর্ণের চেয়েও দামী!

     

    সাফ র‍্যাকিং এর শীর্ষে থাকা ভারতকে হারানোর পরে ফাইনালে বাকী থাকলো মালদ্বীপ। সেই মালদ্বীপকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নও হল বাংলাদেশ। কিন্তু নিঃসন্দেহে গুরুত্ব এবং খেলার মান বিবেচনা করলে এটিই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সেরা ম্যাচ ছিলো।

     

    এরপরে এগারো বছর কেটে গেছে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফিটা তখন থেকে আজো অধরাই রয়ে গেছে। মনে সবার ঠিকই বিশ্বাস, আবার কোনো একদিন আমরা জিতবোই। হয়ত এমনি কোনো নখ কামড়ানো, শ্বাসরুদ্ধকর একটা ম্যাচ জিতেই হবে সেই ট্রফি উদযাপন।