• " />

     

    'বেকার' জাইদিই দেখাচ্ছেন জাদু!

    'বেকার' জাইদিই দেখাচ্ছেন জাদু!    

    বয়সের ঘড়িটা চৌত্রিশ পেরিয়ে পঁয়ত্রিশের ঘরও পাড়ি দিয়ে ফেলেছে প্রায় অর্ধেকটা। ক্রিকেটারদের জন্য ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলাই বলা চলে। এই বয়সের একজন ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক তারকাবহুল একটি টিটোয়েন্টি টুর্নামেন্টের আসর মাতিয়ে চলেছেন- এর মূলত দুটো মানে দাঁড়াতে পারে, হয় তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার যথেষ্ট সমৃদ্ধ নতুবা দেশ-বিদেশ ঘুরে ঘুরে ‘মার্সেনারি’ ক্রিকেট খেলাই তাঁর পেশা। অথচ আসহার জাইদির ব্যাপারে খোঁজখবর করতে গিয়ে একটু চমকেই যেতে হল। চলতি বিপিএলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের হয়ে খেলা এই পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ক্রিকেটারের বর্তমানে স্থায়ী কোন দল নেই, এই টুর্নামেন্ট শেষ হয়ে গেলে সহজ বাংলায় যাকে বলে ‘বেকার’ বনে যাবেন!

     

    প্রায় সোয়া যুগের ক্যারিয়ারে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ পাওয়া দূরে থাকুক, এই টুর্নামেন্টের আগে পাকিস্তানের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট আর ইংলিশ কাউন্টি মিলিয়ে হাতে গোনা ক’টি টিটোয়েন্টিই ছিল তাঁর সম্বল। নিজের ভাষায় ‘নিজ দেশে বৈষম্যে’র শিকার এই মধ্যবয়সী অলরাউন্ডারের ‘অলরাউন্ড’ পারফরম্যান্সে ভর করেই বিপিএলের তৃতীয় আসরে ‘কোয়ালিফায়ার’ ম্যাচ জিতে প্রথম দল হিসেবে ফাইনাল নিশ্চিত করেছে কুমিল্লার ফ্র্যাঞ্চাইজিটি।

     

     

    প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১০৭ ম্যাচ খেলে ৫ হাজার ৮৬৬ রান আর ৭৮টি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে ২ হাজার ৩৪৯, দু’ ধরণের ক্রিকেটেই ব্যাটিং গড় ৩৬-এর উপর; সব সংস্করণের ক্রিকেট মিলিয়ে উইকেটও আছে ১৭০টির বেশী। গড় বিবেচনায় পরিসংখ্যানগুলো খুব মন্দ নয়, কিন্তু ওই বয়সের অংকে চোখ গেলেই কেমন খটকা লাগে। এতো লম্বা সময় ধরে ক্রিকেট খেলেও ক্যারিয়ার সংক্ষেপটা কেমন যেন উঠতি ক্রিকেটারদের মতো! একটু ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়েই জানা গেলো জাইদির সংগ্রামের গল্পটা।

     

    প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমের নজরে এসেছিলেন সেই ২০০০ সালে, শ্রীলংকায় অনুষ্ঠেয় অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের পাকিস্তান দলে ছিলেন করাচির তরুণ জাইদি। পাকিস্তানের বয়সভিত্তিক ঘরোয়া ক্রিকেটে ইসলামাবাদের হয়ে সপ্রতিভ পারফর্ম করেই ডাক পেয়েছিলেন যুবাদের জাতীয় দলে। কিন্তু সে আসরে সেমিফাইনাল পর্যন্ত যাওয়া পাকিস্তান দলের হয়ে দুয়েকটি ম্যাচের বেশী খেলার সুযোগ হয় নি। ঘরোয়া ক্রিকেটেও পরের দুটো মৌসুম ভালো যায় নি। কিন্তু ঘরোয়া একটি টুর্নামেন্টে পাকিস্তান টেলিকম্যুনিকেশন কোম্পানী লিমিটেডের (পিটিসিএল) হয়ে টানা দু’ বছর দারুণ পারফর্ম করে (প্রায় ১ হাজার করে রান) ডাক পেয়ে যান পাকিস্তানের ‘এ’ দলে। বেশ কিছু সফরেও যাবার সুযোগ হয় তখন।

     

    ২০০৪ সালে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ে ‘এ’ দলের বিপক্ষে দ্বিশতক হাঁকিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমে মোটামুটি একটা হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। অনেকেই তাঁকে পাকিস্তানের জাতীয় দলের ভবিষ্যৎ উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে আখ্যাও দিতে শুরু করেছিল। কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে ইনিংস উদ্বোধনের স্বপ্নপূরণ দূরে থাকুক, স্কোয়াডেই কোনদিন ডাক পান নি। দিনের পর দিন উপেক্ষিত থেকে রাগ-ক্ষোভ আর অভিমানে যেদিন দেশ ছাড়ার মনঃস্থির করলেন তার আগে ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনটি শতক আর একটি দ্বিশতক হাঁকান। অথচ ওই মৌসুমের পরপরই ঘোষিত পাকিস্তানের ‘এ’ দল থেকেও বাদ দেয়া হয় তাঁকে। জাইদি আজও জানেন না তাঁর প্রতি দেশের ক্রিকেট কর্তাদের এহেন ‘অবিচার’-এর কারণটা ‘রাজনৈতিক’ নাকি অন্যকিছু।

     

    ইংল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েও থিতু হতে পারছিলেন না। তিন-চার বছর খেলেছেন আঞ্চলিক কিছু টুর্নামেন্টে। বেশ ক’টি লিগে খেলে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা পুঁজি করে অভিনব এক কাজ করে বসেন জাইদি। ইংলিশ কাউন্টির বড় দলগুলোর কাছে ‘ট্রায়াল’-এর সুযোগ চেয়ে মেইল পাঠাতে শুরু করেন। সাড়া পাবার প্রত্যাশা জাইদি নিজেই করেছিলেন কিনা কে জানে। তবে পেয়েছিলেন। কাউন্টি দল সাসেক্সের দ্বিতীয় একাদশের কোচ মার্ক ডেভিস তড়িৎ জবাব দিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। সাসেক্সের দ্বিতীয় একাদশের হয়ে ‘ট্রায়াল’ ম্যাচে ব্যাট হাতে অপরাজিত ১৯২ রান আর বল হাতে ছয় উইকেট দখলে নিয়ে সামর্থ্যের জানানটা দেন বেশ ভালোভাবেই। ২০১৩ সালে তাঁর সাথে দুই বছরের চুক্তি করে কাউন্টি দলটি।

     

     

    গত সেপ্টেম্বরে শেষ হওয়া মৌসুমে শেষ হয়ে গেছে তাঁর সাথে সাসেক্সের চুক্তিও। একজন খণ্ডকালীন স্পিনার আর আট নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে হয়তো দলে তাঁর অবস্থানটা আর অপরিহার্য মনে করছে না কর্তৃপক্ষ।

     

    তবে বিপিএলের তৃতীয় আসরে নিজের বাঁহাতি স্পিন আর মিডল অর্ডার ব্যাটিংয়ে যথেষ্টই সপ্রতিভ দেখা গেলো জাইদিকে। প্রথম ম্যাচটি বাদে কুমিল্লার হয়ে এ পর্যন্ত সবক’টি ম্যাচেই বিদেশী কোটায় একটি স্থান দখলে রেখেছিলেন তিনি। ৬৬.৩৩ গড়ে ১৯৯ রান করে এই মুহূর্তে আছেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় ছয় নম্বরে। আর ওভারপ্রতি ৪.৫৭ রান দিয়ে ও প্রতি ৯.৪৩ রানের বিনিময়ে এক উইকেট নিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর সংগৃহীত উইকেট সংখ্যা ১৬টি, সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তালিকাতেও আছেন চার নম্বরে।

     

     

    শেষ চারের লড়াইয়ে প্রথম কোয়ালিফায়ারে আজ রংপুরের বিপক্ষে মাশরাফি বাহিনীর ৭২ রানের বিশাল জয়ে বলে-ব্যাটে রেখেছেন সমান ভূমিকা। ব্যাট হাতে শেষবেলায় ১৫ বলে ৪০ রানের অপরাজিত ‘ক্যামিও’তে দলের সংগ্রহটা নিয়ে যান ১৬৩-তে। এরপর বল হাতে  ফেরান রংপুরের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানসহ চার ব্যাটসম্যানকে। অলরাউন্ড নৈপুণ্যে শিরোপা নির্ধারণী লড়াইয়ে দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ম্যাচে সেরা খেলোয়াড়ও ‘ফাইনালের পর বেকার’ জাইদি!