• বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের ধর্মঘট
  • " />

     

    ক্রিকেটারদের জন্য বোর্ড না বোর্ডের জন্য ক্রিকেটাররা?

    ক্রিকেটারদের জন্য বোর্ড না বোর্ডের জন্য ক্রিকেটাররা?    

    ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্রেজিনস্কির একটা তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি আছে, ‘ইতিহাস যতটা না ষড়যন্ত্রের, তার চেয়ে অনেক বেশি বিশৃঙ্খলার ফসল।’

    ষড়যন্ত্র-তত্ব্ব এমন ঢাল, যেটি দিয়ে আপনি চাইলে অনেক কিছু আড়াল করে ফেলতে পারেন। এটা এমন একটা জায়গা, যেখানে কয়েকদিনের জন্য আপনি গিয়ে নিশ্চিন্তে লুকোতে পারেন। সমস্যা হচ্ছে, সেটা ওই কয়েক দিনের জন্যই। অন্ধ থাকলে তো আর প্রলয় বন্ধ থাকে না, চোখ বন্ধ করলেও কান তো আর বন্ধ করা যায় না। বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপন ক্রিকেটারদের এই আন্দোলনকে যতই ‘ষড়যন্ত্র’ বলে উড়িয়ে দিতে চাইছেন, ততই এই সমস্যার প্রাসঙ্গিকতা আরও বেশি করে সামনে চলে আসছে।

    ক্রিকেটারদের আন্দোলন বা ‘বিদ্রোহ’ নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই চলছে তুমুল হইচই। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এমন নাড়িয়ে দেওয়া ঘটনাও হয়নি নিকট অতীতে। ১১ দফা দাবিতে ক্রিকেটারদের সংঘবদ্ধতা বলে দিচ্ছে, অনেক দিনের জমতে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণটাই হয়েছে সশব্দে। আর সেটাই বিনা মেঘে একেবারে বজ্রপাতের মতো বিসিবির ওপর আঘাত হেনেছে। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন যেভাবে কাল কথা বলেছেন, তাতে একটা ব্যাপার পরিষ্কার- পুরো বিষয়টা এখন ‘বিসিবি বনাম ক্রিকেটারদের’ ডুয়েলে রূপ নিচ্ছে। আর প্রচারমাধ্যম শুধু এখানে কাজ করছে দুই পক্ষের সংযোগসেতু হিসেবে।

    কিন্তু আদর্শ পরিস্থিতিতে তো এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। সাকিবদের ১১ দফা দাবি জানানোর পরেই বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরী বলেছিলেন, ক্রিকেটাররা বিসিবির কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর বোর্ড তো ক্রিকেটারদের জন্যই, সেটাও বলেছিলেন। কিন্তু কাল বিসিবি সভাপতির বক্তব্য একেবারেই তার উলটো হাওয়া। ক্রিকেটারদের জন্য কী করেছেন সেটার ফিরিস্তি দিয়ে প্রমাণ করেছেন, অভিভাবকের গুরুদায়িত্বটা তিনি আসলে ঠিকভাবে পালন করতে পারেননি। এ যেন স্কুলের বেয়াড়া ছাত্রদের পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে তাদের স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকির মতো। এবং সেই দাবির পেছনে ‘যে-দু একজন’ আছে তাদের বের করার সুরটাও চোখে পড়ার মতো। সমস্যা হচ্ছে, বিসিবি কোন স্কুল নয়, আর বিসিবি সভাপতি কোনো হেডমাস্টারও নন যে এখানে পিটিয়ে ছেলেদের মানুষ করা যাবে।

      বিসিবি থেকে কদিন আগেই একরকম নির্বাসিত হয়েছেন কোচ ও ক্রিকেট-ব্যক্তিত্ব নাজমুল আবেদীন ফাহিম। নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘বিসিবি কোনো ক্লাব নয়, আর জাতীয় ক্রিকেট দল কোনো ক্লাব দল নয়। এই সত্যটা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করা যাবে, ততই মঙ্গল। ক্রিকেটাররা আমাদের পরিচয়। ছেলে হোক মেয়ে হোক, জুনিয়র হোক, সিনিয়র হোক যেসব ক্রিকেটার দেশের প্রতিনিধত্ব করে তারাই সত্যিকারের দূত। তাদের জন্যই আমরা সব জায়গায় সম্মান পাই। ওদের সম্মান করতে শিখুন।’ ক্রিকেটারদের ১১ দফা দাবি থাকলেও সেটার মূল সুর কিন্তু একটাই- তাদের প্রাপ্য সম্মানটা দিতে হবে। এবং সেলুকাস, এই দাবির পরদিনই বিসিবি সভাপতি এমন কথা বললেন যে এই সম্মান আদৌ কখনো ছিল কি না সেই প্রশ্নও উঠে আসছে। জাতীয় একজন ক্রিকেটারকে নিয়ে যখন বিসিবি সভাপতি তাচ্ছিল্য করে বলেন, ‘যে ক্রিকেটার ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে দাম পেল না, কখনও তাকে ডাকেনি, ডাকবেও না, সে বলে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে দুইটির বেশি লিগে খেলতে দিতে হবে। ইস দিজ এ জোক?’; বোঝা যায় ক্রিকেটারদের সব দাবি যদি পূরণও হয়, সম্মানের সেই জায়গা কখনো দেওয়া হবে কি না সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠে যাবে।

    প্রশ্ন করতে পারেন, বিসিবি সভাপতির কিছু কথায় তো যৌক্তিকতা আছে। ক্রিকেটারদের যদি দাবি দাওয়া থেকেই থাকে, তাহলে সেটা সরাসরি এমন আল্টিমেটাম দিয়ে বলা হলো কেন? আগে তো বোর্ডের কাছে দাবিদাওয়া পেশ করাই যেত, এরপর মেনে না নিলে এরকম চূড়ান্ত কিছুতে যাওয়া যায়। কিন্তু বোর্ডের সাথে কথা না বলেই সরাসরি ধর্মঘট কেন? ক্রিকেটারদের এই পদক্ষেপ যদি কিছুটা বাড়াবাড়িও হয়, সেটার উত্তরটাও সেই প্রথম দাবিতে লুকিয়ে আছে। যে ১১ দফা দাবি ছিল, সেখানে জাতীয় দলের তারকা ক্রিকেটারদের চেয়ে অন্য ক্রিকেটাদেরই বেশি উপকার হবে। আর একটা টেস্ট খেলুরে দেশের ক্রিকেটারদের এই অধিকার এমনিই প্রাপ্য, এই ১১ দফা যে তাদের পেশ করতে হয়েছে সেটাই একটা লজ্জার ব্যাপার। যে সম্মানের দাবিতে তাদের এতকিছু, সেটা ভুলুন্ঠিত হতে হতেই তারা হয়তো এরকম চূড়ান্ত কিছুর কথা ভেবেছেন। আর যদি তাদের এই পদক্ষেপটা হঠকারীও হয়, অভিভাবক হিসেবে বিসিবি সভাপতি তো অন্তত দাবিগুলোর যৌক্তিকতা স্বীকার করে সমাধানের পথে আসতে পারেন। কিন্তু তিনি ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের কথা বলে পুরো ব্যাপারটাই অন্যদিকে নিয়ে গেলেন। এমন নয়, কাল কোনো দাবি পূরণের আশ্বাস দেননি। প্রিমিয়ার লিগে আগের নিয়মে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে যেমন তাৎক্ষণিক সমাধান দিয়েছেন। কিন্তু ঘুরেফিরে সেই ‘সম্মানের’ জায়গায় গিয়েই বেঁধেছে যত গোল। যখন একজন সভাপতি বলেন, মুশফিকের বাবার, মিরাজের খালার সমস্যার সমাধানও তাকে করতে হয়, তখন প্রশ্ন উঠে যায় ক্রিকেটারদের আসলে কী চোখে দেখেন বিসিবির কর্তাব্যক্তিরা? একজন ক্রিকেটারের বিপদে বোর্ডের সাহায্য করারই কথা- সেটা অভিভাবক হিসেবে নাজমুল হাসানেরও দায়িত্ব। কিন্তু সেটার জন্য ক্রিকেটারদের মুখে তালা মেরে রাখতে হবে- সেই ইঙ্গিত দেওয়া বুঝিয়ে দেয় ক্রিকেটারদের কেমন চোখে দেখেন বোর্ডের শীর্ষকর্তারা।

    পুরনো প্রশ্নটাই আজ আবার নতুন করে উঠে যাচ্ছে- ক্রিকেটারদের জন্য বোর্ড না বোর্ডের জন্য ক্রিকেটাররা?