• জিম্বাবুয়ের বাংলাদেশ সফর
  • " />

     

    একটি ফেসবুক পোস্টের সঙ্গে একজন 'ওয়ার্ল্ড ক্লাস' ও 'ধারাবাহিক' লিটনের খোঁজ

    একটি ফেসবুক পোস্টের সঙ্গে একজন 'ওয়ার্ল্ড ক্লাস' ও 'ধারাবাহিক' লিটনের খোঁজ    

    পোস্টটায় আরেকটা রি-অ্যাকশন পড়লো। 

    প্রায় ৫ বছর আগে, প্যাভিলিয়নে নিজের একেবারে শুরুর দিকের একটা লেখা পোস্ট করেছিলাম একসময় বেশ নিয়মিত থাকা এক ফেসবুক গ্রুপে- ক্রিকেটরঙ্গ। গ্রুপ-ট্রুপে লেখালেখি বা পোস্ট করা কমে এসেছে ততদিনে, সেই লেখাটা হয়তো শেষ দিককার পোস্টগুলির একটি। অদ্ভুত কোনও এক কারণে সেই গ্রুপ থেকে ‘হাওয়া’ হয়ে গেলাম হঠাৎ, ব্ল্যাক মিরর টাইপ অনুভূতি মোটামুটি। এখন একটু পরিবর্তিত অবস্থা- আপাতত এমন রি-অ্যাকশন পড়লে লিঙ্কটা কাজ করে এখন, ক্লিক করলে গ্রুপে নিয়ে যায়। 

    এই পোস্টের আচার-আচরণ একটু অদ্ভুতুড়ে। ঠিক শীর্ষেন্দুর পটাশগড়ের জঙ্গলে বা মনোজদের অদ্ভুত বাড়ির মতো কোনও ঘটনা এই পোস্টে ঘটে না অবশ্যই। ব্ল্যাক মিররের মতো তেমন ‘ডার্ক’ও না তো বটেই। এ সমস্যা সমাধানে মিসির আলির টুকটাক কাজ করে দেওয়া কোনও বালিকারও প্রয়োজন পড়বে না। তবে এই পোস্টে রি-অ্যাকশন পড়ার টাইমিংটা মার্ক জাকারবার্গের অ্যালগরিদমের খেল নিয়ে একটু ভাবিয়ে তোলে। দিন চারেক আগে সেখানে শেষ একটা কমেন্ট এসেছে।  

    ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এসেছিল, সে বছরের অক্টোবরে আবার। এরপর এ বছরের জানুয়ারিতে, এবং দিন পাঁচেক আগেও। 

    ২০১৮-র জানুয়ারিতে লিটন দাস আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তখনকার সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর গড়েছিলেন, চট্টগ্রামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৯৪। অক্টোবরে রংপুরের হয়ে জাতীয় লিগে ১৪০ বলে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন। এ বছরের জানুয়ারিতে রাজশাহী রয়্যালসের হয়ে বিপিএলে করেছিলেন ৪৮ বলে ৭৫ রান। দিন পাঁচেক আগে তামিম ইকবালের রেকর্ড ভেঙে বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ১৭৬ রান করেছিলেন তিনি। 

    পোস্টটা লিটনকে নিয়ে ছিল- এই কথাটা আলাদা করে বললে আপনার ‘কমনসেন্স’ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে একেবারে। সেটা করে নিজেকেই বোকা প্রমাণ করার চেষ্টা করার ইচ্ছা আপাতত নেই আমার। তবে সময়টা বলা যায়। লিটন তখন মাত্র জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন। 


    ****


    সংবাদ সম্মেলনকক্ষে আসতে আসতে লিটনকে একটু বিরতি নিতে হলো। দুজন ধরেছেন তাকে- একটা সেলফি তোলা চাই। লিটন তাদেরকে বোধহয় কিছু একটা বললেন, নিজের ক্যাপটা ঠিক করে নেবেন বা কোন অ্যাঙ্গেলে তুললে সেলফিটা ভাল আসবে- এমন কিছু। লিটন এদিন ম্যাচসেরা হয়েছেন, ওয়ানডের পর টি-টোয়েন্টিতেও সিরিজসেরা হয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনের ‘অলিখিত রীতি’ মেনে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর সঙ্গী তাই তিনি। 

    ৫৩, ১২৬*, ৯, ১৭৬, ৫৯, ৬০*- জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সব ফরম্যাট মিলিয়ে লিটনের ইনিংসগুলি এমন। নিশ্চিতভাবেই এই পাঁচ বছরের বা ৯৯ ইনিংসের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে লিটন এমন ধারাবাহিক এর আগে ছিলেন না কখনোই। 

    চট্টগ্রামের ২০১৮ সালের সেই টেস্ট ইনিংসটা লিটনের জন্য ছিল ৬ রানের আক্ষেপের। একটা বড় ইনিংস যে কোনও ব্যাটসম্যানকেই আত্মবিশ্বাস জোগায়। তবে মাইলফলকে যাওয়ার তৃপ্তির চেয়ে বোধহয় কাছাকাছি গিয়ে থেমে যাওয়াটা বেশি আক্ষেপের। রঙ্গনা হেরাথকে বেরিয়ে এসে খেলতে গিয়ে আকাশে বল তোলা লিটনের আক্ষেপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। ২০১৮ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি পেলেন, তবে মিশে থাকলো দলের হারের আক্ষেপ। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সেঞ্চুরি পেলেন মোটামুটি ৪ দিনের ব্যবধানে- দল জিতল দুটিতেই। 
     


    লিটনকে নিয়ে এতদিন আক্ষেপ ছিল- ইনিংস বড় করতে না পারা/বিসিবি


    অবশ্য লিটনকে নিয়ে এতদিন আক্ষেপ ছিল- ইনিংস বড় করতে না পারা, কিংবা অসময়ে আউট হয়ে যাওয়া। অথবা ধারাবাহিকতার অভাব। দল থেকে বেশ লম্বা সময় বাইরেও থাকতে হয়েছে তাই তাকে। ঘরোয়াতে রানবন্যা বইয়ে দেওয়া লিটন কেন এখানে খরার কবলে পড়েন, ঘরোয়ার সঙ্গে আন্তর্জাতিকের ব্যবধানের সেই চিরায়ত প্রশ্নও তাই উঠতো বারবার। গত বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তার ৯৪ রানের ইনিংস অবশ্য আক্ষেপ জোগায়নি, বাংলাদেশের রেকর্ড রানতাড়ায় সাকিবের সঙ্গে তার জুটি ছিল ‘ওয়ার্ল্ড-ক্লাস’ই। 

    এ সিরিজ তাই শুধু ইঙ্গিত নয়, প্রমাণও দিল- লিটনকে নিয়ে আশা করাটা আর যাই হোক- ভুল নয়। তাকে পাশে বসিয়েই মাহমুদউল্লাহ বললেন, লিটন তার কাছে একেবারে শুরু থেকেই ‘ওয়ার্ল্ড-ক্লাস’ ব্যাটসম্যান। 

    শেষ বিপিএলের সময়ও তার পারফরম্যান্স ছিল ধারাবাহিক, সেখানে নিজের মানসিকতার পরিবর্তনের কথাও বলেছিলেন। তবে এর আগে-পরে ভারত-পাকিস্তান সফরে ইনিংস বড় করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

    এবার লিটন বলছেন, কীভাবে বদলানোর চেষ্টা করছেন তিনি, “এর আগেও আমি পারফরম্যান্স করেছি। একটা ম্যাচ খেলার পর একটু ‘রিল্যাক্সড’ হয়ে যেতাম। একটা ম্যাচে তো রান করেছি, পরের ম্যাচেও রান হয়ে যাবে (এমন)। এই সিরিজে আমি চিন্তা করেছি, প্রতিটা ম্যাচই নতুন। আউট হতে এক বলই যথেষ্ট। এবার অনেক ফোকাসড ছিলাম। শট নির্বাচনেও সীমাবদ্ধ ছিলাম। আমি যে খুব ওপরে দিয়ে মেরেছি পুরো সিরিজে তা কিন্তু না। ‘মেরিট অফ দ্যা বল’ খেলার চেষ্টা করেছি। মনযোগটা ছিল বেশি।” 

    ****

    চার্লটন শুমার বলটা মোটামুটি ফুললেংথের, অফস্টাম্পের একটু বাইরে। লিটন যেন প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। কাভারের ফিল্ডার শুধু নিচু হলেন, এছাড়া তার আর কিছু করার ছিল না, বল তার নাগালের বাইরেই। কাভার-পয়েন্টের ফিল্ডার দৌড়ালেন, তবে বৃথা চেষ্টা। 

    পরের ওভার কার্ল মুম্বার ডেলিভারির লেংথটা শুমার ওই বলের চেয়ে আরেকটু কম, আরেকটু বেশি বাইরে। লিটন এবারও খেললেন একই শট- কাভার ড্রাইভ। এবার আরও অনায়াসে, আরো মোলায়েম করে। কাভার-পয়েন্টের ফিল্ডার দৌড়ালেন এবারও, তবে শুধু বলটা কুড়িয়ে আনবেন বলে। কাভারের ফিল্ডার দাঁড়িয়ে থাকলেন সেখানেই। লিটন দাপুটে, নিজের ব্যাটিংয়ের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ দুর্দান্ত। ১৭৬ রানের রেকর্ড ইনিংসে লিটন ছিলেন এমনই। 

    ক্রিকইনফো বলছে, প্রথম ওয়ানডেতে লিটনের ইনিংসে তার নিয়ন্ত্রণ ছিল ৯০ শতাংশ। রেকর্ডভাঙা ইনিংসে বৃষ্টি-বিরতির পর দ্রুত রান তুলতে বেশ কিছু আলগা শটই খেলে ফেলেছিলেন বলে নিয়ন্ত্রণ নেমে এসেছিল ৮০ শতাংশে। প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ৮৪ শতাংশের পর শেষ টি-টোয়েন্টিতে তার নিয়ন্ত্রণ ছিল ৯৩ শতাংশ। অবশ্য এদিন ১২০ রানের লক্ষ্য বলে চাপ ছিল না তেমন। কিন্তু লক্ষ্য ছোট বা এমন সহায়ক পরিস্থিতি হলেও তো নিজের নিয়ন্ত্রণটা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে- চট্টগ্রামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই ৯৪ রানের টেস্ট ইনিংসে উইকেট যেমন ছিল দারুণ ব্যাটিং সহায়ক। লিটন যেমন উইকেট ছুঁড়ে এসেছিলেন বড় অসময়ে।
     

    "আপনি যখন একটা জিনিস হাতে পাবেন, সেটা ফেলা দেওয়া অনেক সহজ, ধরে রাখা কঠিন।"/বিসিবি


    জিম্বাবুয়ের এবারের যে দল খেলেছে, তাদের বোলিং আক্রমণ মোটামুটি অনভিজ্ঞ, দুই মূল পেসারই ছিলেন না। দলে মূল স্পিনার বলতেও আলাদা করে তেমন কেউ নেই। তবে লিটনের মতে, বোলার আগ্রাসী হোন বা নিরীহ, তার ফোকাসটা সব বোলারের জন্য একই, “একটা ব্যাটসম্যানের জন্য তো আউট হতে একটা বলই যথেষ্ট। আজকে আপনি যদি মিচেল স্টার্ককেও ব্যাট করেন যে ফোকাসে খেলতে হবে, (ক্রিস) এমপোফুকে খেললেও একই ফোকাসে করতে হবে। কিন্তু হয়তবা বোলিংয়ের স্টেপ যেটা, উইকেট-টেকিং ডেলিভারি সেটা একটু কম হতে পারে। স্কোরিং শটের অপশন এক্ষেত্রে একটু বেশি থাকে। এই আরকি।” 

    তবে লিটন এর আগেও বলেছেন, ‘বেসিক বা টেকনিক’ দিয়ে কিছু আসবে-যাবে না, মূল বিষয় পারফরম্যান্স। আবারও বললেন সেটিই, “আপনি যখন একটা জিনিস হাতে পাবেন, সেটা ফেলা দেওয়া অনেক সহজ, ধরে রাখা কঠিন। এখন আমার জন্য চ্যালেঞ্জ যেটা হবে যে, আমি আসলে পারফরম্যান্সটা কতদিন ধরে রাখতে পারছি। প্রস্তুতি পর্যায় থেকে ম্যাচের সবই কষ্টদায়ক হবে। আমি চেষ্টা করব এই পারফরম্যান্স ধরে রাখতে। জানি না কতটুকু পারব। কিন্তু অনুশীলনে কঠোর পরিশ্রম করব।” 


    ****


    দারুণ ধারাবাহিক এক সিরিজ গেছে লিটনের। তবে টেস্ট গড়টা এখনও ২৬.০৩, ওয়ানডে গড় ২৪.৭৭ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩২.৬৯, টি-টোয়েন্টির গড়টা ১৯.১৪ থেকে বেড়ে হয়েছে ২২.৭১।  মাহমুদউল্লাহ মানেন, লিটন ‘ওয়ার্ল্ড-ক্লাস’। তবে এখনও পাড়ি দেওয়া বাকি সুদীর্ঘ পথ। হয়তো এ সিরিজ দিয়ে সে পথে নতুন করে যাত্রা শুরু হলো তার। 

    অবশ্য লিটন জানেন, ‘একটা জিনিস পাওয়ার চেয়ে সেটা ফেলে দেওয়া সহজ’। লিটন মানেন, ‘বেসিক বা টেকনিক’ কিছু নয়, পারফরম্যান্সই সব। 

    লিটন না জেনেও হয়তো তাই জানেন, আরও কিছু রি-অ্যাকশন আসা বাকি আছে এখনও- সেই পোস্টে। অথবা অন্য কোনও পোস্টে।