বিশ্বকাপ ছোঁয়ার আগে যেদিন বিশ্বজয় করেছিলেন রিভালদো
“আমি ক্যারিয়ারে দারুণ কিছু ম্যাচ খেলেছি। গুরুত্বপূর্ণ অনেক গোলও করেছি- গোল করেছি বিশ্বকাপেও। কিন্তু এই ম্যাচটার গুরুত্ব আলাদা। শুধুমাত্র আমার ওভারহেড কিকের জন্য না।“- ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে ২০০১ সালে দারুণ এক হ্যাটট্রিকের ১৮ বছর পর ওই ম্যাচের কথা বলছিলেন রিভালদো।
রিভালদোর ক্যারিয়ারের অপূর্ণতা নেই। চ্যাম্পিয়নস লিগ, কোপা আমেরিকা, বিশ্বকাপ, ব্যালন ডি অর- কিছু বাদ যায়নি তার স্পর্শ থেকে। এরপরও ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে ওই ম্যাচের মাহাত্ম্য রিভালদোর কাছে আলাদা। ডিয়েগো ম্যারাডোনার ক্যারিয়ারের সংজ্ঞা লিখতে গেলে যেমন ছিয়াশির কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচ দরকার হয়, রিভালদোর খুঁটি-নাটি নাড়াতে ওই এক ম্যাচই যথেষ্ট। ২০০১ সালে ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে বার্সেলোনার ম্যাচ।
লা লিগার ৩৮তম গেমউইকের আগে সেবার বার্সেলোনার ছিল পয়েন্ট টেবিলের ৫ নম্বরে। চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা করে নেওয়া বার্সার মতো ক্লাবের জন্মগত অধিকার। সেটাই খর্ব হওয়ার পথে। লুই ফন গাল আগের মৌসুম শেষে চাকরি ছেড়েছেন। তার জায়গায় আসা নতুন কোচ লোরেঞ্জো সেরা ফেরেরও ফিরে গেছেন মৌসুমের মাঝপথে। সহকারি কার্ল রেশাখ যখন দলের দায়িত্ব নিয়েছেন তখন লিগে বাকি আর ৭ ম্যাচ।
বার্সার ২০০০-০১ মৌসুমের শুরুটাই হয়েছিল বড় এক ধাক্কা দিয়ে। লুইস ফিগো রিয়াল মাদ্রিদে পাড়ি জমানোর পর টালমাটাল অবস্থা ব্লউগ্রানাদের। এরপর ‘প্যানিক বাই’ এ মার্ক ওভারমার্স, এমানুয়েল পেটিটদের দলে ভিড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টাও করেছিল বার্সা। কিন্তু সেই পরিস্থিতি কী আর এতো সহজে ঠান্ডা হয়! নতুনদের কেউই আর সেভাবে থিতু হতে পারেননি। মৌসুমের শেষদিকে বড় পরীক্ষার আগে তাদের ওপর অন্তত ভরসা করা চলে না।
ভ্যালেন্সিয়া ন্যু ক্যাম্পে এসেছিল টানা দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে হেরে। বার্সার চেয়ে তখনও পুরো ৩ পয়েন্টে এগিয়ে তারা। লিগে অবস্থান চারে। ম্যাচ ন্যু ক্যাম্পে হলেও তাই পরিস্কার ফেভারিট ছিল ভ্যালেন্সিয়াই। তবে তখনও বার্সার অবস্থা ছিল অনেকটা এখনকার মতোই। এখন যেমন মেসি নির্ভর, তখন ছিল রিভালদো নির্ভর। এই যা পার্থক্য।
রোনালদো বার্সেলোনা ছাড়ার পর তার জায়গায় রিভালদো এসেছিলেন ১৯৯৭-৯৮ মৌসুমে। এর পর টানা দুই মৌসুম দলকে লা লিগা জিতিয়েছেন। এর ভেতর নিজে কোপা আমেরিকা জিতেছেন, একবার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছেন, ফিফার বর্ষসেরাও হয়েছেন রিভালদো। তার মাপের খেলোয়াড়, বার্সেলোনার মতো ক্লাব মৌসুমের শেষদিনেও ধুঁকছে চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা করতে।
বার্সার রিভালদো তো ছিলই, আর ছিল একটাই সমীরকণ। জিততেই হবে। জিতলেই হেড টু হেডে এগিয়ে থেকে ভ্যালেন্সিয়াকে টপকে চার নম্বর জায়গাটা হয়ে যাবে বার্সার। সেই ম্যাচ শেষ পর্যন্ত বার্সা জিতল ৩-২ গোলে। রিভালদো করলেন হ্যাটট্রিক। জয়সূচক গোল আসলো ৮৭ মিনিটে। সেই গোল ভ্যালেন্সিয়ার জন্য যতোখানি মর্মান্তিক হতে পারত, হলো তার চেয়েও বেশি। আর বার্সা সমর্থকদের জন্য যতোখানি নাটকীয় হতে পারত, হলো তার চেয়েও নাটকীয়। এসব গল্প এমন না হলে এতো বছর পর কেনই বা সেসব আওড়ানো!
রিভালদো প্রথম গোল করলেন ম্যাচের ৩ মিনিটে। ৩০ গজ দূর থেকে ফ্রি-কিকে। বাম পায়ের বাঁকানো কিক সাইডপোস্ট ঘেঁষে সরাসরি ক্যানিজারেসের জালে। ন্যু ক্যাম্পের স্বস্তি অবশ্য উবে গেল প্রথমার্ধের মাঝপথেই। ভ্যালেন্সিয়া সমতায় ফিরল। তবে রিভালদোর আরেক ক্ল্যাসিক মুহুর্তে বার্সা বিরতিতে গেল এগিয়ে থেকেই। ৪৫ মিনিটে প্রথম গোলের মতো প্রায় একইরকম জায়গা থেকে বল পেলেন। কাট করে খানিকটা মাঝ বরাবর গেলেন, এক ঝটকায় ভ্যালেন্সিয়ার দুই ডিফেন্ডার ততোক্ষণে দর্শক বনে গেছেন। এরপর আবার বাম পায়ের শট। এবার আরও নিচু। ক্যানিজারেসের কাছে যেতে যেতে সেই শট বাঁক বদলালো। ক্যানিজারেস যতক্ষণে বোকা বনেছেন, তার আগেই ন্যু ক্যাম্পে উল্লাস শুরু হয়ে গেছে রিভালদোদের। যদিও বিরতির পর আবারও সমতায় ফেরে ভ্যালেন্সিয়া। বার্সেলোনার গোলবারের ভেতরে ঢুকে সেই গোলের উদযাপন করেছিলেন রুবেন বারাহা, পাবলো আইমাররা। ওই গোল শেষ পর্যন্ত রিভালদোর রাতের মর্যাদাটাই বাড়িয়েছে কেবল।
রিভালদোর বাম পা জাদু জানে। সেটা জানে ন্যু ক্যাম্প। জানে পুরো বিশ্বও। ততদিনে নিজেকে প্রমাণ করা হয়েছে রিভালদোর। বার্সায় যোগ দেওয়ার পর থেকে প্রতি মৌসুমে তার গোল সংখ্যা বেড়েছে সমান্তর ধারা মেনে। অথচ রিভালদো ওই মৌসুমের আগ পর্যন্ত বেশিরভাগ সময়ই খেলতেন সেকেন্ড স্ট্রাইকারের ভূমিকায়। ওয়াইড অ্যাঙ্গেল থেকে ভেতরে ঢুকে এরপর ছিড়ে-কুড়ে প্রতিপক্ষকে বিলীন করতেন। বো-লেগড বলে তার তুলনা হত সক্রেটিসের সঙ্গে। ডান পায়ে তেমন একটা জোর নেই, প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডাররাও হাঁপ ছাড়তেন তখন। কিন্তু ওই সীমাবদ্ধতাকে শক্তিতে রুপান্তর করেছিলেন রিভালদো। ততার বাম পায়ে বল মানে রেহাই নেই আর কারও। সেটা ৩০ গজ দূরে হোক, ৪০ গজ দূরে হোক আর বক্সের বাইরে ঈশান কোন হোক।
কিন্তু বক্সের মাথায় আপনার কাছে উলটোদিক থেকে বল উড়ে এলে কী করবেন? মাঝমাঠ থেকে ফ্রাঙ্ক ডি বোয়েরের লব পাস যখন উড়ে এলো, রিভালদো প্রথমে বুক দিয়ে সেই বল নামালেন। এতোক্ষণ রিভালদো ছিলেন বক্সের ভেতর, এবার বল রিসিভ করতে বেরিয়েই যেতে হলো তাকে। ভ্যালেন্সিয়ার দুই আর্জেন্টাইন সেন্টারব্যাক রবার্তো আয়ালা আর মাউরিসিও পেলেগ্রিনোরা ওই ক্ষুদ্রতি ক্ষুদ্র মুহুর্তে স্বস্তিই পেয়েছিলেন বোধ হয়।
ডি বোয়ের পাস থেকে অবশ্য আয়ালার কোনো সুখস্মৃতি নেই। ৩ বছর আগে বিশ্বকাপে ডেনিস বার্গক্যাম্প আয়ালাদের মাঠের ভেতর স্ট্যাচু বানিয়ে করেছিলেন অদ্ভুত সুন্দর এক গোল। সেই গোলেও ফ্রাঙ্ক ডি বোয়েরই পাস দিয়েছিলেন। বার্গক্যাম্পকে অবশ্য সবমিলিয়ে ৩ বার বলে টাচ করতে হয়েছিল। রিভালদোর দরকার হলো আর ১ টাচ।
হাওয়ায় শরীর ভাসিয়ে দিয়ে ডান পায় উঁচিয়ে ব্যালেন্স ধরলেন, বাম পায়ে এরপর ওভারহেড কিক। এমন কিক বটম কর্নারে জড়াতে যতোখানি নিখুঁত আর যতো নির্ভুল হতে হয়- সব হলো। আপনি ফুটবল ভালোবাসুন আর নাই বাসুন, আপনার মনে দাগ কাটুক আর নাই কাটুক- এমন কিছু দেখার পর আপনার গায়ে কাটা দেবেই। আপনি রিভালদোর প্রেমে পড়বেনই।
আদর্শিক হ্যাটট্রিক কাকে বলে? পুঁথিগত বিদ্যা অনুসারে ডান পা, বাম পা এরপর হেডে- শরীরের সম্ভাব্য এই ৩ অংশ দিয়ে গোল করলে সেটাকে সুষম হ্যাটট্রিক বলা যেতে পারে। কিন্তু জাদুঘরে সাজিয়ে রাখার জন্য সেসব যথেষ্ট নয়। বিশ্বকাপ জেতা যে কোনো ফুটবলারের আজন্ম লালন করা স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন আবার সবাই দেখার সাহসও পাননা। রিভালদো বিশ্বকাপ তো জিতেছিলেন এই ম্যাচের ঠিক এক বছর পর। এতো বছর পরও বিশ্বকাপের সঙ্গে এই ম্যাচের গল্পটাও আলাদা করে বলেন রিভালদো। বিশ্বকাপ জেতানো পারফরম্যান্স টেক্কা দিতে হলে এমন অলৌকিক রাতেরই দরকার হয়। যে রাত কালেভদ্রে আসে খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ারে।