• " />

     

    ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা একাদশ

    ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা একাদশ    

    প্যাভিলিয়ন-কিউট আয়োজিত স্পোর্টস ফিচার লেখা প্রতিযোগিতা 'খেলার লেখা, লেখার খেলা -১' এর দশজন বিজয়ীর লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে! আজ থাকছে তৃতীয় স্থান অধিকারী ধ্রুব আলম-এর লেখা 'ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা একাদশ'।


     

    ওয়ানডে ক্রিকেটের বয়স বেশি না, আর বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেটের তো আরো কম। এইতো সেদিন ১৯৮৫-১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলা শুরু, ওয়ানডে ক্রিকেটের মাধ্যমেই। অনেক খেলোয়াড় ইতোমধ্যে দেশের জার্সি গায়ে দিয়ে ফেলেছেন, কেউ কেউ আমাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন তাদের পুরো ক্যারিয়ার দিয়ে, কেউ একটা ইনিংস বা বোলিং স্পেল দিয়ে, কেউ হয়তো একটা দুর্দান্ত শট বা বল দিয়েই।

    কিন্তু সর্বকালের সেরা একাদশ করতে  হতে হয় নিস্পৃহ, আবেগহীন, পরিসংখ্যানবিদ এবং অনেকক্ষেত্রেই নির্মম। মানতে হয় বাস্তবতাও। তবে বাংলাদেশ এখনো সব দলের জন্যে ঘরে-বাইরে কঠিন প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি, তবে ৩০ বছর এবং মাত্র দুইশ’র মত ম্যাচ কখনোই উপযুক্ত প্রতিপক্ষ হয়ে উঠবার জন্য যথেষ্ট নয়।

    ধরে নিচ্ছি, খেলাটা দেশেই, একটু স্পিন-সহায়ক পিচেই হবে। আমাদের মূল শক্তি ধরব ব্যাটিং; বোলিং-এ চালিকাশক্তি স্পিন। দলে থাকবে ২ পেসার, ২ স্পিনার, ১ উইকেটকিপার, ৬ ব্যাটসম্যান, তাদের মাঝে অলরাউন্ডার ২ জন।

     

    ব্যাটসম্যানঃ প্রথমেই দরকার ওপেনার, চোখ বুজে একজনের নাম বলা যায়, তামিম ইকবাল; প্রায় ৪,০০০ রান, ত্রিশোর্ধ গড়, প্রায় ৮০ স্ট্রাইকরেট, ২৫ হাফ-সেঞ্চুরি, ৪ সেঞ্চুরি, জিম্বাবুয়ের সাথে ১৫৪। মাঠের শরীরী ভাষা থেকে শুরু করে সংবাদ সম্মেলন, তামিমের মাঝে ফুটে বের হয়, ‘বাংলাদেশ বদলে গেছে, আমরা আর অংশগ্রহনের জন্যে খেলি না, জেতার জন্য খেলি।’

     

    তামিমের ওপাশে কে দাঁড়াবেন? একজন আবেগী কিন্তু ঠান্ডামাথার মানুষ চাই, আমার কাছে উনি আতাহার আলি খান। যিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের ঊষালগ্নে প্রায় অবাস্তব গড় (প্রায় ৩০) ও ইডেন গার্ডেন্সে একটি ইনিংস নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ১৯৮৮-৯৮; এই সময়ে ১৯ ম্যাচ, ৩ ফিফটি, মাত্র হাটিহাটি পা করা একটা ক্রিকেট টিমের ওপেনারের জন্য আমার কাছে উনিই সেরা। নিকটতম প্রতিদ্বন্দী, জাভেদ ওমর, আমাদের আনসাং হিরো। পরিসংখ্যান বলছে, উনারা ভয়াবহভাবে একইধাচের, দুইজনের কেনিয়া, জিম্বাবুয়ের সাথে প্রায় ২৫% মত ম্যাচ, বড় দলগুলোর বিপক্ষেও তারা প্রায় একইরকম পারফর্মার। তারপরেও, জাভেদের তুলনায়, আমার মতে আতাহার এগিয়ে, পরিসংখ্যান ছাড়াও ৯৭-পূর্ব যুগের খেলোয়াড় বলে।

     

    আকরাম-বুলবুল-নান্নুঃ এই তিন মহারথীর কেউ ঢুকবেন দলে? অবাক লাগলেও আমার দলে এরা কেউ থাকবেন না। কেন? নান্নুর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পরিসংখ্যান ভয়ঙ্কর; আমার অত্যন্ত প্রিয় খেলোয়াড় হলেও গড় ২০ এর কম, ২টা ফিফটি (১টি যদিও স্কটল্যান্ডের সাথে সেই ম্যাচে)। এতে বাকি ম্যাচগুলোতে তার পারফর্মেন্সের দুরবস্থা আরো বোঝা যায়, যদিও বিপদে দলের হাল ধরতে তার জুড়ি ছিল না। আকরাম-বুলবুল প্রায় একইরকম খেলোয়াড় পরিসংখ্যানগত দিকে (দুজনের গড়ই প্রায় ২৩), স্টাইলে আকরাম আক্রমনাত্মক, বুলবুল ক্লাসিক। মেধায় বুলবুল অনেক এগিয়ে, টেস্ট পরিসংখ্যান তাই বলছে, বাংলাদেশের ১ম টেস্ট ব্যাটসম্যান উনি, অন্তত বিশ্বের চোখে। কিন্তু সেসময় আরেকজন উপেক্ষিত ওয়ানডে খেলোয়াড় ছিলেন, তিনি হাবিবুল বাশার সুমন, যার গড় মাত্র ২১। টেস্টে ‘মিস্টার ফিফটি’ উপাধি পাওয়া তাঁর ওয়ানডেতে ফিফটি ১৪টি, যার অধিকাংশ এসেছে ২০০৫-০৭-এ। যার মানে, উনি টেস্ট ফর্মকে ওয়ানডেতেও রুপান্তরিত করতে পেরেছিলেন, যেটি বড় খেলোয়াড়ের গুণ।

     

    চার নম্বরে আমি কাকে চাই? একজন হেটে হেঁটে টিমে ঢূকে গেলেন, তার নাম সাকিব-আল-হাসান। তিনি তো থাকবেনই, আজ থেকে ১০০ বছর পরেও যদি একটা দল করা হয় তাতেও। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার (হয়ত সর্বকালেরই),পয়ত্রিশোর্ধ গড়, ৫ সেঞ্চুরি, ২৫ ফিফটি, ম্যাচ জেতানোর দুর্দান্ত ক্ষমতা, ইস্পাতসম স্নায়ু নিয়ে বিশ্বের যেকোন দলে ঢোকার নৈপুণ্যধারী ১ম বাংলাদেশি উনি।

     

    তারপরে আসবেন নস্টালজিক হয়ে যাওয়া মুহূর্তের জন্ম দেয়া এক বীর বঙ্গসন্তান। যিনি ৭১-এ অবলীলায় ছুড়ে ফেলেছিলেন পাকিস্তানের হয়ে টেস্ট খেলার শখ, প্রায় ১৫ বছর পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই ওয়ানডে খেলতে নেমেছিলেন, খেলেছিলেন গুটিকয়েক ম্যাচ। তার রেকর্ডের কোনকিছুই ঈর্ষণীয় নয়, কিন্তু একটা বাক্য বড় দুর্লভ, “প্রথম ও হয়তো একমাত্র বাঙ্গালি হিসেবে যিনি হতে পারতেন পাকিস্তানের টেস্ট খেলোয়াড়”। শুধু অন্ধ দেশপ্রেমের কারনেই তাকে রাখলাম দলে, তিনি রকিবুল হাসান। তিনি হয়ত সাধারণ মানের কোন পাকিস্তানের খেলোয়াড়ই হতেন, কিন্তু তিনি হননি। মাঝে মাঝে কিছু হতে না-পারাদের নিয়েও গর্ব করা যায়।

     

    লোয়ার মিডল অর্ডারে হাল ধরবেন কে? তাকে হতে হবে নির্ভীক, দুর্ধর্ষ এবং দাতে দাত চেপে লড়াই করার মানসিকতাসম্পন্ন। পুরনো দলগুলোতে সেভাবে কাউকে পাচ্ছি না, নতুনের মধ্যে আছেন, মাহমুদুল্লাহ ও নাসির। মাহমুদুল্লাহ অভিজ্ঞ (৯৪ ম্যাচ), সাথে বলও ভালোই করেন, রানের গড় ৩৩। নাসিরের রানের গড় ৪৩ (ম্যাচ মাত্র ২৮টা যদিও), ম্যাচ বের করে আনার ক্ষমতাটা বেশি, একটু আধটু বল করেন, তবে খুব বেশি ভরসা রাখার মত না। কিন্তু দুঃসাহস কার বেশি? নাসির হোসেন। সে পিচে থাকলে আশার প্রদীপটা কখনোই নেভে না। তার উপরে টেস্টেও তাকে অনেক ম্যাচিউরড মনে হয়, এই বয়সেই।

     

    উইকেটকিপার পজিসনে দুইজন প্রতিদ্বন্দীঃ মুশফিক ও খালেদ মাসুদ। উইকেটকিপিং-এ যোজন ব্যবধানে এগিয়ে পাইলট, কিন্তু চেষ্টায়, পরিশ্রমে মুশফিকুর রহিম। পাইলটের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই নিজেকে প্রমাণ করতে হয়েছে তাকে, ব্যাটিং-এও এগিয়ে তিনি। তাকে দলে এখন একজন ব্যাটসম্যান হিসেবেই নেয়া যায় (গড়ঃ ২৬, ফিফটিঃ ১২, সেঞ্চুরিঃ ১)। ডিসমিসালে দুইজনের পরিসংখ্যান একইরকমের- পাইলটঃ ১২৬ ম্যাচে ১২৬টি, মুশফিকঃ ১২২ ম্যাচে ১২৩টি। তবে, পাইলটের শিকারগুলো একটু হলেও বেশি গুরুত্ব বহন করে, কারন সে যুগে উইকেট পাওয়াই ছিলো বাংলাদেশের জন্যে বেশ কঠিন। কিন্তু মুশফিকের ম্যাচিউরিটি, চাপ সামলানোর ক্ষমতা, আগ্রাসী মনোভাব ও সর্বোপরি, নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রচন্ড ইচ্ছা, সব মিলিয়েই আমার পছন্দ সে।

     

    বোলারঃ আমাদের এখন দরকার দুই স্পিনার। এটা নিয়ে খুব বেশি ভাবনার অবকাশ নেইঃ রফিক ও রাজ্জাক। রফিক, বাংলাদেশের প্রথম লড়াকু খেলোয়াড়ের প্রতীক, যে মাঠে নামলেই দর্শক নড়েচড়ে বসতো, হোক সে বল হাতে, বা ব্যাট। তখন বাংলাদেশের অসহায় অধিনায়কের শেষ ভরসা ছিলেন মোহাম্মদ রফিক।  ১২২ ম্যাচে ১১৯ উইকেট দেখে বোঝার উপায় নেই, প্রতিটা উইকেটের পেছনে কি পরিশ্রম লুকিয়ে আছে। সে যুগে বোলিং গড় ও রানখরচের বিবেচনায়, তিনি বাকিদের থেকে অনেক এগিয়ে। আর আবদুর রাজ্জাক, ২০০ উইকেট নেয়া প্রথম বাংলাদেশি, অনেকদিনের পুরনো সৈনিক, দুই যুগের মধ্যবর্তী সেতুবন্ধন। তার বোলিং গড় (২৮), স্ট্রাইক রেট (৩৭) দুটোই এখনো সেরা।

     

    সবার শেষে আসে সবচেয়ে কঠিন বস্তুটি খোঁজা, বাংলার মাটি থেকে পেসার। এদেশের মাটি আর যা কিছুর জন্যেই উর্বর হোক না কেন, পেসারদের জন্যে নয়। এর মধ্যে উল্কাসম একজনকেই পাই, অবলীলায় তাকে টিমে নিয়ে নিতে পারিঃ মাশরাফি বিন মর্তুজা, যে হারার আগে কোনদিন হারেনা, কোন ইনজুরি যাকে থামাতে পারেনি। প্রায় প্রতিটা জয়ের সাথেই যে ছিল আমাদের সাথে, প্রথম ধাক্কাটা, জয়ের গন্ধটা সেই পাইয়ে দেয়।

     

    দ্বিতীয়জনকে কোথায় পাই? আমি এমন একজনকে চাই, যার গতি আছে, মাঝে মাঝে পিচ পেলে ৯০ মাইলের কাছাকাছি ঝড় তুলতে পারে। তিনজন থাকে লিস্টে, শফিউল, রুবেল ও নাজমুল। নাজমুল গতিতে সবচেয়ে পিছিয়ে, রুবেল সবার আগে। তারা সবাই খরুচে বোলার (ওভারপিছু ৫ এর উপরে রান দেয়); বোলিং গড় শফিউলের ৩৪, বাকি দুজনের প্রায় ৩১। স্ট্রাইক রেটে নাজমুল পিছিয়ে (৩৭), রুবেল, শফিউল প্রায় ৩৪-৩৫। রুবেল স্লগ ওভারে জঘন্য, মাশরাফিও তাই, কিন্তু ওইসময়ে কমপক্ষে একটা গতিময় পেস বোলার দরকার। স্লগ ওভারে বোলিং বিবেচনায়, নাজমুল প্রথমে আসবে, তারপরে শফিউল; পরিসংখ্যান ও গতিতে রুবেল। আইসিসি ট্রফি যুগের, অথবা তারও আগের কাউকে রাখছিনা, তাদেরকে নিয়ে নস্টালজিক হলেও, পরিসংখ্যানের বিবেচনায় তারা আসেনা। আমি ঝুঁকি নিয়েই রুবেল হোসেনকে রাখছি।

     

    দলের অধিনায়ক, সাকিব আল হাসান, তার ক্ষুরধার বুদ্ধির জন্য, সহ-অধিনায়ক মুশফিক, তার লড়াকু মনোভাবের জন্য। আশা করি, এই দলটা কারো সাথেই একেবারে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হারবে না। আর নামবে তো অবশ্যই জেতার লক্ষ্যে।