• আইসিসি টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৬
  • " />

     

    বেলাশেষের গান...

    বেলাশেষের গান...    

    সময়ের সমুদ্রে ডুবে থাকা মানুষেরই যে সময় থাকে না, রবি ঠাকুর তো সেটা একশ বছর আগেই বলে গিয়েছেন। মানুষ তারুণ্যের পূজারী, শক্তি-শৌর্য মানুষকে চিরটাকাল আকর্ষণ করেছে। রূপকথার পায়রাগুলো তাই পেখম মেলে কোনো তরুণের হাত থেকেই, কল্পলোকে সৌন্দর্যের সুধায় অবগাহন করতে হয় কোনো তরুণীরই পল্লবিত স্মিতহাস্যে। নতুন প্রাণের উচ্ছ্বাসই কেবল কাব্যে গতি আনে, জীবনে প্রাণবন্ততা আনে। রঙের ছোপ কেবল তারুণ্যে লাগে- বয়স ফুরোনোর পর জীবনটা বন্দী হয় সাদাকালো সেলুলয়েডে! বার্ধক্যের জায়গা নেই এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে, অজস্র ছাপ রাখার পরও একজন বুড়োকে তাই সবকিছু ছেড়ে আসতে হয়, জায়গা করে দিতে হয় ‘নতুন’দের জন্য। জীবনটাই যেখানে এমন, ক্রিকেটই বা তাঁর বাইরে কেন থাকবে? জীবনের ছাপ যদি কোনো খেলায় সবচেয়ে বেশী থেকে থাকে, সেটা তো ক্রিকেটই। পথ হারিয়ে ফেরা ক্লান্ত পথিক যখন হন্যে হয়ে দিশা খুঁজে ফেরেন, একজন ফর্মহীন ব্যাটসম্যানের অবস্থাটা তো তাঁর চেয়ে খুব বেশি ব্যতিক্রম নয়!

     

    ক্রিকেট আর জীবন বড় বেশি হাত ধরাধরি করে চলে, সময়ের পরিক্রমায় আড়ালে চলে যাওয়া তারকারাও তাই এখানে অগোচরে যেতে সময় নেন না! তারুণ্য হারাবার বুলির তোড়ে কখনো বয়স হবার আগেই কাউকে কাউকে ‘অপাংক্তেয়’ খেতাব নিয়ে বিদায় বলতে হয়! জীবনভর পাওয়া তাই মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, কখনো না কখনো তাকে যে খোয়াতেই হয়!

     

    তবুও কেউ কেউ থাকেন, আপাতদৃষ্টিতে হয়তো যোদ্ধা নয়। তবে তাঁরা লড়ে যান, প্রাণপণ। ভাগ্যের হাতে সবকিছু সঁপে দিতে তাঁদের বড্ড অনীহা! ‘অপাংক্তেয়’ না হয়ে অকুতোভয় বীরের মত তুলে রাখেন শাণিত তলোয়ার।

    তবে শুধু ক্রিকেটে নয়, যেকোনো খেলাতেই এটা খুব ক্লিশে একটা নিয়মের গল্প- বয়সের অজুহাতে কাউকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়া। সাধারণ কেউ ওখানেই হার মানেন, আর বয়সকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অকুতোভয়রা সেখান থেকেই হয়ে উঠেন অসাধারণ! কালোত্তীর্ণ খেতাব দেয়া হয় তাঁদেরকেই, উন্নীত হন শিখরে, মহাকাল বিজয় তিলক পড়ায় এদের কপালেই! তবে সেটা হয় শেষে, তার আগের সময়টা কিভাবেই বা পেরিয়ে আসেন তাঁরা!

     

    কেমন লেগেছিল যুবরাজ সিংয়ের? ২০১১ বিশ্বকাপের নায়ক তিনি, অর্জনের খেরোখাতার সীমারেখা নেই, ‘টিম ইন্ডিয়ার’ অন্যতম কুশীলব! স্মরণীয় মুহুর্তের স্রোতে ভারতীয়দের ভাসিয়েছেন অসংখ্যবার! টি-টোয়েন্টির প্রথম বিশ্বকাপেও দলকে ফাইনালে তোলার অনেকখানি কৃতিত্ব তো ‘যুবি’রই! সে তাঁর বাড়িতেই ঢিল পড়লো, ২১ বলে ১১ রানের ইনিংসটাকে দায়ী করে কুশপুতুলও পোড়ানো হলো কয়েক জায়গায়! অতিচর্চিত সেই ইতিহাস আর না কপচিয়ে হয়তো আমরা এড়িয়ে যেতে পারি; কিন্তু ক্যান্সার থেকে ফিরে আসা একজন যুবরাজ সিং কি তা ভুলতে পারবেন কখনো? হৃদপেশীর কোন না কোন অলিন্দে তো নিশ্চয়ই এখনো বেজে চলেছে সেই বিষের বাজনা। ২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ওই ফাইনালের পর তাঁর এপিটাফ আসলে লিখেননি কে? তিনি আবার ফিরে আসবেন এই বিশ্বাসটুকুও বা কয়জনের ছিল? যুবরাজ অবশ্য বলতে পারেন, আমি যে বেঁচে ফিরব এই আশাটুকুই যেখানে ছিল না সেখানে এ আর এমন কি! চাইলেই তাই যাচ্ছে না- পারা যাচ্ছে না ক্রিকেটকে শুধু খেলা হিসেবে রেখে জীবনকে বৃহৎ করে দেখতে! অন্তত যুবরাজ সিংয়ের বেলায় তো নয়ই!

    তিনি ফিরেছেন স্বমহিমায়। অসাধারণ আগে থেকেই ছিলেন, এবার হয়তো সেই অসাধারণত্বের সীমাটা কালকেও ছাড়িয়ে নিতে পারবেন। একদিন নিশ্চিতভাবেই এই যুবরাজ থাকবেন না, কিন্তু তাঁর নতুন করে ক্রিকেট জয় করার গল্পটা আরো অনেককাল মানুষকে প্রেরণা যোগাবে। তিনি শুধু ক্রিকেটই তো জয় করেননি, জয় করেছেন তাঁর নশ্বর জীবনটাও!

    যুবরাজের মত হয়তো জীবন জয়-টয় করে আসার ব্যাপার আশিস নেহরার মধ্যে নেই। ৩৬ বছরে জীবনের নতুন বাঁক খুঁজে পাওয়া এই বোলারকে নিয়ে তবুও বলার আছে অনেক। ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন সেই ১৯৯৯ সালে, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে। প্রথম স্পেলেই মারভান আতাপাত্তুকে অসাধারণ ডেলিভারিতে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। শুরুতে চাওয়া-পাওয়ার পার্থক্য ছিলনা, তবুও ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলেছেন এক যুগ আগে! তাঁর ক্যারিয়ারটাই অদ্ভুত! ছিলেন ২০০৩ বিশ্বকাপে ভারতীয় পেস ত্রিফলার অন্যতম সারথি, তখনকার দুই ফরম্যাটেই ভারতীয় দলের গুরুত্বপূর্ন সদস্য। কিন্তু চোটজর্জর হয়ে সেই যে ২০০৪ সালে দলের বাইরে গেলেন, চার বছরেও আর ফেরা হলো না! এরপর অবশ্য নিয়মিত বোলারদের চোটের সুবাদে দলে টুকটাক জায়গা পেয়েছেন, তবে নিয়মিত হতে পারেননি। ছিলেন ২০১১ বিশ্বকাপের স্কোয়াডেও। মূল একাদশে সু্যোগ পেলেন দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে, তাতে খরুচে বোলিংয়ের চূড়ান্ত প্রদর্শনী দেখিয়ে আবার বাইরে চলে গেলেন। গোটা টুর্নামেন্টের জন্যই গেলেন, অনেকেই ভেবেছিলেন এমন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে ধোনি সেমিফাইনালে অশ্বিনকে উপেক্ষা করে তাকে দলে আনলেন, আস্থার প্রতিদানও দিলেন মাত্র ৩৩ রানে দুই উইকেট নিয়ে। অপাংক্তেয় নেহরা হয়তো সেমিতে নায়ক হননি, কিন্তু পার্শ্বনায়কের ভুমিকায় অবতীর্ণ হওয়াতে ফাইনাল খেলাটা অবধারিতই ছিল প্রায়। সেটা হতে দিল না আঙ্গুলের চোট। পাকিস্তানের সঙ্গে সেই সেমিফাইনালটাই তাই নেহরার ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডে!

    এই নেহরাকে সবাই ভুলে ছিলেন। তাঁর জায়গা ছিলনা আধুনিক ‘টিম ইন্ডিয়ায়’। তবে নেহরা নুয়ে পড়েননি, বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচে জায়গা হবেনা বুঝেই হয়তো শাণিত করেছেন নিজেকে, ছোট ফরম্যাটে। আইপিএলে অসাধারণ পারফরম্যান্স করে আবার ফিরেছেন দলে। ৩৭ বছরের এই ‘বুড়ো’ নেহরাই এখন ছোট ফরম্যাটে ভারতীয় পেস আক্রমণের নেতা। অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর উপস্থিতিতেই তো তাদেরকে হোয়াইটওয়াশ করেছে ভারত!

    হরভজন সিং সেদিক থেকে অবশ্য ভাগ্যবান, যেমন ভাগ্যবান রঙ্গনা হেরাথ। হরভজন তো টানা ১১ বছর বলতে গেলে একাই স্পিন আক্রমণকে টেনেছেন। মুরালি পরবর্তী যুগে হেরাথও করেছেন তাই। তবে হেরাথের যখন নতুন করে শুরু হচ্ছে, হরভজনের তখন শেষের ঘণ্টা বাজছে। ২০১১ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালটা খেলেছিলেন হেরাথ, মুরালির চাইতে তাঁর স্পেলটাই কিন্তু নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচটায় বেশি ‘কার্যকরী’ ছিল। ফাইনালে তবুও টিম কম্বিনেশন ঠিক রাখতে সুযোগ পাননি। ভাজ্জি অবশ্য বিশ্বকাপ জিতেছেন, কিন্তু পুরো টুর্নামেন্টে ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। তেমন কোনো ম্যাজিক স্পেল আর ছিল কোথায়? বিশ্বকাপ ফাইনালের পর তাই আর ৩ ওয়ানডেতে সুযোগ পেয়েছিলেন। এরপর যখন সু্যোগ পেলেন তখন পেরিয়ে গেছে ৪ বছর! আর হেরাথ এখন শ্রীলঙ্কা দলের অপরিহার্য সদস্য, ‘ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন’দের আগত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে হেরাথ যাদু খুবই দরকার। ভাজ্জি হয়তো মূল একাদশে অতোটা সু্যোগ পাবেন না, তবে দলে তাঁর অভিজ্ঞতা যে প্রভাব রাখবে নিশ্চিতভাবেই!

     

     

    মোহাম্মদ সামির গল্পটা হেরাথ-হরভজনের চেয়ে একটু আলাদা। ইমরান খান তাঁকে বলেছিলেন আধুনিক ম্যালকম মার্শাল! টেস্ট অভিষেকেই নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে ১০৬ রান দিয়ে আট উইকেট। তৃতীয় টেস্টেই শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক! এর কয়দিন পর হ্যাটট্রিক পেলেন ওয়ানডেতেও। ওয়াসিম-ওয়াকারের বিদায়ের মুহুর্তে তাঁকেই ভাবা হচ্ছিল পাকিস্তানের পরবর্তী প্রজন্মের পেস আক্রমণের কান্ডারি। তবে সে ‘কান্ডারি’র পরের ইতিহাস রীতিমতো দুঃসহ, পাকিস্তানীদের জন্যেও কি নয়? সিরিজের পর সিরিজ দলে খেলেছেন, কিন্তু প্রভাব ফেলতে পারছেন না। ছোট বোলিং রান-আপে অস্বাভাবিক গতি সৃষ্টির ক্ষমতা, বল দুইদিকে সুইং করানোর প্রকৃতিদত্ত প্রতিভা নিয়েও আরে এগোতে পারেননি। ২০০৬ সালে দল থেকেই বাদ, তারপর থেকেছেন যাওয়া আসার মধ্যে। শুরুর অমন পারফরম্যান্সের পরও তাই তাঁর টেস্ট সংখ্যা মাত্র ৩৬, শেষ টেস্টটাও খেলেছেন চার বছর আগে। তবে এর চেয়েও দুঃসহ হচ্ছে টেস্ট বোলিং গড়, ৫২.৭৪! গত বছর অবশ্য জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ওয়ানডে খেলেছিলেন, কিন্তু সেটার পরও প্রায় বছরখানেক হয়ে গেছে। পিএসএলের পারফরম্যান্স দিয়ে এশিয়া কাপ আর বিশ্বকাপের দলে জায়গা করে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এশিয়া কাপের ম্যাচের ওই নো-বল ‘কেলেংকারি’র পর আদৌ আর মূল একাদশে জায়গা পাবেন কি! এশিয়া কাপের শেষ ম্যাচেও তো ছিলেন একাদশের বাইরেই! বয়স হয়ে গেছে ৩৬, আন্তর্জাতিক আঙিনায় সামির বিচরণের নতুন কোনো গল্প লিখতে হলে হয়তো আশ্রয় নিতে হবে সেই ফিনিক্স পাখির গল্পেরই!

     

    ওপরের লেখা পড়ে মনে হতে পারে, সব ‘বুড়ো’দের আবাস বোধহয় এই গোলার্ধেই! না অবশ্যই। নিউজিল্যান্ড দলে আছেন যেমন গ্র্যান্ট এলিয়ট। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান গ্রেট গেইলের বয়সও কিন্তু বেলায় বেলায় কম হল না! ৩৩-৩৪ বয়স হয়ে গেছে এমন খেলোয়ারদের সংখ্যা সামনের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নেহায়েত কম নয়! এদের কেউ ‘কামব্যাক’ করেছেন এপিটাফের মধ্যে থেকে, কেউবা আবার ফর্মের বিচারে মাঝারি মানে থেকে যাচ্ছেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে, হয়তো শেষবারের মত!

     

    খেলাধুলার জগতটা রূপকথার রাজ্যের মত, প্রজাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা রাজার মত খেলোয়াড়েরাও এখানে থাকেন সাধারণ দর্শকদের মানসপটে। সেই মানসচিত্রটাও মুছে যায় জাদুর রংপেন্সিলে আঁকা ছবির মত, চোখের আড়াল হবার সাথে সাথে হারিয়ে যান তারকারা। অবসর ভাবনা তাই একজন খেলোয়ারের জন্য দুঃসহ, এখন মানুষের জন্যেও কি নয়? যেকোন বিদায়ে দুঃখের ছোপ থাকে, বিষাদের বিস্তৃতি থাকে। বিদায় নিতে তাই কেউ চায়না, হেরে যাওয়া অবস্থান থেকে তো নয়ই। এজন্যেই এপিটাফ লেখা হলেও টেন্ডুলকার, গাঙ্গুলি, পন্টিং, আকরামরা ফিরে আসেন। দৃপ্তকণ্ঠে আবার শুনিয়ে দেন বিজয়ের গান। এই টি-টোয়েন্টির বিশ্ব আসরেও তাই আপাত বয়সোত্তীর্ণ অনেক খেলোয়াড় খেলবেন, সে আশাতেই। হয়তো যশ কামাবেন, হয়তো ব্যর্থ হয়ে শেষবারের মতোই হারিয়ে যাবেন ইতিহাসের পাতায়।

    জীর্ণতার চাদর মিলিয়ে যাবে যাক, টি-টোয়েন্টির আগত আসরটা ‘বুড়ো’দের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিয়েই বিদায় দিক না! স্বপ্নের মতোই হোক না এঁদের শেষ!

    স্বপ্নটা হয়তো স্বপ্নই থাকবে, কিন্তু আশা করতে তো আর দোষ নেই!

     


    পাদটীকা: এই লেখাটি প্যাভিলিয়নের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বিশেষ আয়োজন "সুইচ-হিটে" পূর্বপ্রকাশিত। ম্যাগাজিনটি ডাউনলোড করে নিতে পারবেন এখানে