রুটের 'অন্যরকম' ২০২১
২০২১। বছরটা জো রুটের কেমন কাটলো?
নিজের রানের থেকে অন্যদের রানের চিন্তায়ই তাঁর সময় কেটেছে বেশি- এক লাইনে বর্ণনা করতে গেলে বলতে হয় এমনটাই।
অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে হারের পর ইংলিশ কাপ্তান বলেছিলেন, ব্যাক্তিগতভাবে বছরটা তাঁর জন্যে উপভোগ্য ছিল, তবে জয়ের সাথে কোন কিছুরই তুলনা হয় না। পরের টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসটা ছিল রুটের ২০২১ সালের শেষ ইনিংস। সেখানে এক পঞ্জিকাবর্ষে সাদা পোশাকে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডের মালিক হতে হলে তাঁর প্রয়োজন ছিল ১০৯ রানের। ২৮ রানেই সে ইনিংস থামার সঙ্গে তাঁর ‘সোনালী’ বছরের সমাপ্তিও ঘটে যায়। ভিভ রিচার্ডস এক বছরে ১৭১০ রান করেছিলেন, মোহাম্মদ ইউসুফ তা ছাড়িয়ে যান ২০০৬ সালে ১৭৮৮ রান করে। তাদের দুজনকেই ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ হারিয়ে রুট থামেন ১৭০৮ রানেই। তবে সেই রান দিয়েই ইংল্যান্ডের হয়ে এক বছরে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডটা তাঁরই করে নিয়েছেন তিনি।
কিন্ত সেই সাথে ইংল্যান্ড দল যে রেকর্ডটা করেছে, সেটি কোন ইংলিশ সমর্থকই চাইবেন না নিজের করে নিতে। ২০২১ সালে ইংল্যান্ড দল হেরেছে নয়টি টেস্ট, যা তাদের ইতিহাসে এক পঞ্জিকাবর্ষে সবচেয়ে বেশি হারের রেকর্ডও বটে। আর সেই দলের দলপতির নামটা যে জো রুটই।
বছরটা তাই বলা যায় রুটের কেটেছে ‘অন্যরকম’ই! রুট বাদে ফ্যাব ফোরের বাকি তিনজনের কেউই ছিলেন না এ বছরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের সেরা দশের তালিকায়। স্মিথ ও উইলিয়ামসন যদিও পাঁচ ম্যাচের বেশি খেলেননি বছরটায়। স্মিথ ৫৩.৭৫ গড়ে করেছেন ৪৩০ রান, উইলিয়ামসন চার ম্যাচ খেলেই করে ফেলেছেন ৩৯৫ রান, ব্যাটিং গড় ছিল ৬৫.৮৩। অন্যদিকে সাদা পোশাকে কোহলির দুঃসময় চলেছে বছর জুড়েই, ১১ ম্যাচে ২৮.২১ গড়ে রান করেছেন ৫৩৬। ব্যাট হাতে আসলে রুট কতটা দুর্দান্ত ছিলেন সেটা আসলে এই তুলনা বলতে সক্ষম নয় কোনভাবেই!
ভিভ ও ইউসুফকে ছাড়িয়ে যেতে না পারলেও অধিনায়ক হিসেবে এক পঞ্জিকাবর্ষে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডের মালিকানাটা ঠিকই নিজের দখলে নিয়েছেন রুট। এটি এমনই এক বছর, যে বছরে রুট অধিনায়ক হিসেবে স্যার অ্যালিস্টার কুকের ৪৮৪৪ রানকেও ছাড়িয়ে গেছেন। যার অর্থ, অধিনায়ক হয়ে ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ স্কোরার এখন তিনিই। কিন্ত সেই অধিনায়ক রুটের দল যে ঘোরপাক খাচ্ছেই ব্যর্থতার বৃত্তে, ব্যাটিং দিয়ে একের পর এক চূড়া অতিক্রম করলেও তাই অধিনায়ক রুটের দিকেও নিয়মিত ছুটে আসছে প্রশ্নবান।
অবশ্য ব্যাটসম্যান রুটের বছরটা এর চাইতে ভালো শুরু হতে পারতো না। গলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি, শুভসূচনা যাকে বলে! পরের টেস্টে থামলেন ডাবল সেঞ্চুরি থেকে ১৪ রান দূরে। লঙ্কা সফর শেষে পাশের দেশ ভারতে গিয়েও শুরুটা করলেন আরেকটি ডাবল সেঞ্চুরি দিয়েই। কিন্ত এরপর সময় খুব একটা ভালো কাটলো না রুটের, পেলেন না একটিও ফিফটি! চেন্নাইয়ে ২১৮ রানের ইনিংসের পরের সাত ইনিংসে সর্বোচ্চ করতে পারলেন মাত্র ৪০।
ফিফটিকে সেঞ্চুরিতে রুপান্তর করতে না পারার একটা দুর্নাম আছে রুটের। সেটি সত্যিও বটে! তবে সে বছরে রুটের ফিফটিকে সেঞ্চুরিতে রুপান্তরের হার শতভাগ! বছরের সাত মাস পেরিয়ে গেছে, তখনও কোন ফিফটি নেই রুটের। এবার ইংল্যান্ড সফরে ভারত গেলে সেখানে প্রথম ইনিংসেই পেয়ে গেলেন সেই ফিফটির দেখা! মাঝখানে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে দুই টেস্টও কেটে গেছে। চার ইনিংসের কোনটিই পঞ্চাশ পেরিয়ে যেতে পারেনি, সর্বোচ্চ ছিল ৪২। ভারতের বিপক্ষে ৬৪ রানের সেই ইনিংস দিয়ে সিরিজ শুরু করলেন, পরের ছয় ইনিংসেই হাঁকিয়ে ফেললেন আরও তিন তিনটি সেঞ্চুরি!
বছরের শেষে এলো গৌরবের অ্যাশেজ। সেখানেও রুটের রানের ফোয়ারা ছুটে চলল। তিন ম্যাচের তিনটিতেই খেললেন পঞ্চাশোর্ধ্ব তিনটি ইনিংস। সবমিলিয়ে ১৫ ম্যাচে ২৯ ইনিংসে ৬১ গড়ে ১৭০৮ রানে সমাপ্তি ঘটলো রুটের ২০২১। বছরটা তো তাহলে কি দুর্দান্তই না কাটলো রুটের! কিন্ত আসলেই কি তাই? ব্যাটসম্যান রুটের জন্য তা ছিল যেমন উজ্জ্বল, তেমনই অধিনায়ক রুটের জন্য যে ছিল বিবর্ণ। ঠিক যেমন ছিলেন বাকি ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা!
রুট যেখানে ৬১ গড়ে ব্যাট করেছেন, তাঁর দলের বাকি ব্যাটসম্যানদের মিলিত গড় ছিল ১৮.১৭। পুরো বছরে রুট তাঁর সঙ্গীদের থেকে শতকের উদযাপন দেখতে পেরেছেন মাত্রই একবার। রুটের এমন ছুটন্ত ফর্মের পরও ইংল্যান্ডের প্রতি উইকেটে তাই গড় রান ছিল ২৪.১৩। সেটি কতটুকু খারাপ? তা বুঝতে একটা পরিসংখ্যানের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। এর আগে যেসব বছরে ইংল্যান্ড কমপক্ষে দশটি টেস্ট খেলেছিল তার মধ্যে কোনটিতেই ইংল্যান্ডের প্রতি উইকেটে গড় রান এই বছরের ২৪.১৩ এর চেয়ে কম ছিল না। অর্থাৎ, ব্যাটিংয়ে তাদের ইতিহাসেরই সবচেয়ে বাজে এক বছর কাটিয়েছে ইংলিশরা।
সমস্যার শুরু গোড়া থেকেই। ইংলিশ টপ অর্ডারের ভোগান্তি পুরো বছর জুড়েই চলেছে। টপ অর্ডারের সাত ব্যাটসম্যানের মিলিত গড় ছিল ২১.৩৩। ২০২১ সালে আর কোন দলেরই টপ অর্ডার এর চেয়ে কম গড়ে ব্যাট করেনি। ৮৭ ইনিংসের একটিই মাত্র পেরিয়েছিল শতরান। পরিসংখ্যান ইঙ্গিত দিচ্ছে, টপ অর্ডারের এই ব্যর্থতা প্রভাব ফেলেছে ব্যাটসম্যান রুটের উপরও।
২৮ ইনিংসের ১৫ ইনিংসেই এমন হয়েছে, রুট যখন চার নাম্বারে ব্যাট করতে নামছেন, তখন ইংল্যান্ডের রান ২০ পেরোনোর আগেই দুই উইকেট নেই। এমন অবস্থায় যেসব ইনিংসে ব্যাট করতে নেমেছেন রুট, সেসবে তাঁর গড় ছিল ৪৮.১৩। আর এর চেয়ে ভালো অবস্থানে রুট ব্যাটিংয়ে নেমেছেন যখন, তখন তাঁর গড় গিয়ে পৌঁছেছে সত্তোরে। দলীয় রান বিশের নিচে থাকার সময়ে রুট ১৫ ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে দুই ফিফটির সঙ্গে করেছেন দুটি সেঞ্চুরিও। তবে বিশের উপরে রান থাকা অবস্থায় ব্যাট হাতে নেমে ১৩ ইনিংসেই করেছেন চার সেঞ্চুরি এবং দুটি হাফ সেঞ্চুরি।
সবমিলিয়ে টপ অর্ডারই শুধু ব্যর্থ হয়নি। রুট বাদে আর মাত্র এক ব্যাটসম্যানেরই ব্যাটিং গড় ত্রিশের উপরে ছিল। সেই মালানের দিকেও ঝুঁকেছিল ইংল্যান্ড ব্যর্থতায় দিশেহারা হয়েই। ৫ ম্যাচ খেলে ৯ ইনিংসে মালান ৩৪.২২ গড়ে ৩০৮ রান করেছেন। ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ গড় ছিল ক্রিস ওয়েকসের, এটিই আসলে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং দুরাবস্থার চিত্র তুলে ধরছে অনেকাংশেই। অলআউট হওয়া ২৬ ইনিংসের অর্ধেকেই ইংলিশরা দুই শ রানের কমেই সবকটি উইকেট খুইয়ে ফেলেছে।
আদতে ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ের একমাত্র ভরসাই হয়ে ছিলেন জো রুট। দলের ২৮ শতাংশ রানই তাঁর ব্যাট থেকে আসাটাই এর পক্ষে প্রমাণ দিচ্ছে। রান বন্যা ছুটিয়ে দিয়ে দুর্দান্ত এক বছরই কাটিয়েছেন তিনি। তবু রুটের আনন্দ মাটি করে দিয়েছে দলের নাস্তানাবুদ অবস্থা। ব্যাট হাতে যে বছরে রেকর্ড বুকে বারবার নিজের নাম লিপিবদ্ধ করিয়েছেন, সেই বছরেই তাঁর দলও নাম লিখিয়েছে ‘না চাওয়ার’ অনেক রেকর্ডে।
ব্যাটসম্যান রুট অধিনায়ক রুটকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়, যে উচ্চতাটুকু আবার কিছুটা নামিয়ে দিয়েছে তাঁর দলেরই ব্যাটিং। বছরটা তাই তাঁর নিজের জন্য যতটা আনন্দের, দলের জন্য ততটাই বেদনার। আর সেই দলকে সামলানোর দায়িত্ব তাঁর বলেই তাঁর আনন্দটাও কেড়ে নিয়েছে সেই বেদনা। সামনের দিনে তাই ব্যাট হাতে ২০২১ সালের মতোই বছরের আশা নিশ্চয়ই করবেন জো রুট, তবে তাঁর দলের বাকিদের রান খরা মুক্তির আশা হয়তো করবেন তার চাইতেও কিঞ্চিৎ বেশি!