• বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    ফ্র্যাঞ্চাইজি বিভ্রাট, মাঠের বাইরের গোলমাল : কতটা বদলেছে বিপিএল?

    ফ্র্যাঞ্চাইজি বিভ্রাট, মাঠের বাইরের গোলমাল : কতটা বদলেছে বিপিএল?    

    বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ, দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট। নবম আসরের পর্দা উঠবে কাল। সাত ফ্র্যাঞ্চাইজির অধীনে সাত দল নিয়ে ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রাম তিন ভেন্যুতে এবারের বিপিএলে হবে মোট ৪৬ ম্যাচ। তবুও যেন বিপিএল নিয়ে অনাগ্রহ কাজ করছে দেশের ক্রিকেটপ্রেমী জনতার মধ্যে। ‘হাইপ’ বলতে যা বোঝায় সেটার অস্ত্বিত যা আছে, সেটা কেবল  ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর ফেসবুক পেজেই। বিসিবি বা বিপিএলের গভর্নিং কাউন্সিল থেকেও নেই প্রচারণামুলক কিছু। 

    এর সাথে প্রতি মৌসুমে প্লেয়ার্স ড্রাফট থেকে শুরু করে দলগুলোর মালিকানা নির্ধারণ, মাঠের বাইরের কান্ড, ম্যাচ গড়াপেটা, খেলোয়াড়দের বকেয়া পাওনা, স্লো উইকেট, টিভি ব্রডকাস্টের মান নিয়ে নানান তর্ক-বিতর্কের মধ্যে দিয়ে গেছে বিপিএল। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, ক্রিকেটের বিশ্বায়নের এই যুগে কেন এই বেহাল দশা দশ বছর বয়সী একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের? এতদিনেও কি কোনো ব্র্যান্ডভ্যালু গড়ে ওঠেনি? 

    গতকাল এমন প্রশ্নেরই চাঁছাছোলা একটা উত্তর দিয়েছেন বাংলাদেশের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টির অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। ‘আমাকে যদি প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব দেয়া হয় বিপিএলের, আমার বেশিদিন লাগবে না। আমার ধারণা ১ থেকে দুই মাস লাগবে সর্বোচ্চ সবকিছু ঠিক করতে, খুব বেশি হলে। দুই মাসও লাগার কথা না, দুই মাস অনেক দূরের কথা বলছি’, সাকিবের এই কথাতেই যেন ফুটে উঠেছে বিপিএলের অব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনাহীনতার এক বাস্তব চিত্র। কেমন ছিল বিপিএলের গত আট আসরের ছবি? নবম মৌসুমে এসে আদৌতে কতটা বদলেছে বিপিএল? 


    ফ্র্যাঞ্চাইজি বিভ্রাট

    নয় মৌসুমে এখন পর্যন্ত আলাদা ২৭টি ফ্র্যাঞ্চাইজি দেখা গেছে বিপিএলে। সিলেট দলের কথাই ধরা যাক। এখন পর্যন্ত আলাদা ছয়টি ফ্র্যাঞ্চাইজির অধীনে খেলেছে দলটি। ২০১২ সালের প্রথম আসরে সিলেট রয়েলস নামে শুরু করে ২০১৫ সালের সেটা বদলে যায় সিলেট সুপারস্টার্সে। এক মৌসুম পর সিলেট সিক্সার্স। ২০১৯ বিপিএলে সিলেটের দল খেলেছে সিলেট থান্ডার নামে। গেল আসরের সিলেট সানরাইজার্স এবার মাঠে নামছে নতুন মালিকানায় সিলেট স্ট্রাইকার্স হয়ে। 

    ঢাকার চিত্রটাও ভিন্ন নয়। এখন পর্যন্ত আলাদা আলাদা ৫টি নামে দেখা গেছে রাজধানীর দলটিকে। ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স, ঢাকা ডায়নামাইটস, ঢাকা প্লাটুন, মিনিস্টার গ্রুপ ঢাকা এবং সর্বশেষ ঢাকা ডমিনেটরস। 

    মালিকানা না বদলে বিপিএলে টিকে আছে কেবল কুমিল্লার ভিক্টোরিয়ান্স। একই মালিকানায় ২০১৫ সাল থেকে খেলছে বিপিএলের তিনবারের শিরোপাজয়ী দলটি। এর মধ্যে কেবল এক আসরে অংশগ্রহণ করেনি। এদিকে  ২০১৯ সালের পর বিপিএলের পর রাজশাহীর দল কিনতে আগ্রহ দেখায়নি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজিই। চট্টগ্রাম কিংবা খুলনা দলকেও একটি নির্দিষ্ট বিরতির পর দেখা গেছে নতুন নামে, নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজির অধীনে। এক কিংবা দুই মৌসুম পর পর ফ্র্যাঞ্চাইজির নাম বদলে যাওয়া; ওই এলাকার ভক্তদের জন্যও তা যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর। কোন ক্রিকেটার কোন ফ্র্যাঞ্চাইজির এমনকি কোন বিভাগের দলের কী নাম সেটাও পাঁড় ক্রিকেট সমর্থকরা চট করে বলতে পারবেন না। কদিন আগেই একটি বেসরকারি টেলিভিশনের এক রিপোর্টার বিপিএলে আম্পায়ারিং করতে যাওয়া কজনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোন দলের কী নাম? তারাও সেটা জানেন না। কাঠামোগত দিক দিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাবেরই বহিঃপ্রকাশ সেটা। এভাবেই বারবার বদলেছে ফ্র্যাঞ্চাইজি, সেই অর্থে কোনো ব্র্যান্ড ভ্যালুও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। 

    গত বিপিএলে দরপত্র আহবান করেও ঢাকার জন্য শুরুর দিকে কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি পায়নি বিপিএলের গভর্নিং বডি। শেষ পর্যন্ত প্লেয়ার্স ড্রাফট থেকে খোদ বিসিবি দল গড়েছে ঢাকার। সেটার মালিকানা নিয়েছিল মিনিস্টার গ্রুপ। এবার অবশ্য প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজি তিন বছরের জন্য তুলে নিয়েছে দলগুলোর দায়িত্ব। ফ্র্যাঞ্চাইজিদের কাঠামোগত এই পরিবর্তনটা এনেছে বিসিবি। 

    অফ দ্য ফিল্ডের গোলমাল

    মাঠের বাইরে ক্রিকেটারদের সাথে ফ্র্যাঞ্চাইজি কর্তৃপক্ষের নানান ঘটনা তো প্রতি আসরেই দেখা জায়। গত বিপিএলে মেহেদী হাসান মিরাজকে অধিনায়ক করে যাত্রা শুরু করেছিল চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স। কিন্তু টুর্নামেন্টের মাঝপথেই তাকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। সেই জেরে টিম হোটেল ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন মিরাজ। এবার কী নাটক অপেক্ষা করছে? 

     

    প্রচারেই প্রসার!

    আইপিএল, পিএসএল কিংবা নব্য চালু হতে যাওয়া আইএল টি-টোয়েন্টি; ছোট প্রোমো ভিডিও, কিংবা নজরকাড়া কাউন্টডাউনে ডিজিটাল মাধ্যমে চলে তাদের দারুণ সব প্রচারণা। ভক্ত-সমর্থক ছাপিয়ে গোটা বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীরাই ওয়াকিবহাল তা নিয়ে। সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে প্রচারের এই অবারিত সুযোগ থাকার পরেও এখানে যোজন যোজন পিছিয়ে বিপিএল। বিপিএলের অফিসিয়াল পেজ বছরজুড়ে প্রায় ফাঁকা ই পড়ে থাকে। ব্যস্ততা যেটুকু কেবল বছরের শেষ কিংবা শুরুতে বিপিএলের সময়টুকুতেই। বিপিএলের টুকটাক খোঁজখবর যারা রাখেন, তাদের ভরসা দলগুলোর ফেসবুক পেজ। 

     

    পারিশ্রমিক 

    বিপিএলের গত আসরে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক ৭০ লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন ‘এ’ ক্যাটাগরিতে থাকা ছয় ক্রিকেটার। মার্কিন মুদ্রায় সেটা প্রায় এক লক্ষ ডলার। বিশ্বজুড়ে চলা টি-টোয়েন্টি লিগগুলোর মধ্যে যা সর্বনিম্ন। অথচ মাত্র দুই আসর পুরনো একশো বলের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ‘দ্য হান্ড্রেড’ এর পারিশ্রমিকও প্রায় বিপিএলের চেয়ে প্রায় ৬৪ হাজার মার্কিন ডলার বেশি। এবার এ ক্যাটাগরিতে থাকা সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাবেন ৮০ লাখ টাকা। যা এক লক্ষ মার্কিন ডলারের চেয়ে কিছু বেশি। 

    মজার ব্যাপার হচ্ছে মাঠে গড়ানোর আগেই দ্বিতীয় আকর্ষনীয় টি-টোয়েন্টি লিগের তকমা পেয়েছে আরব আমিরাতের আইএল টি-টোয়েন্টি। আগামী ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হতে যাওয়া এই টুর্নামেন্টে তারকা ক্রিকেটাররা আয় করবেন সাড়ে চার লক্ষ মার্কিন ডলার। তারকা বিদেশি ক্রিকেটারদের ভেড়াতে পারিশ্রমিকও একটা বড় অন্তরায় বিপিএলে। 

     

    প্লেয়ার্স ড্রাফট, টিভি ব্রডকাস্টিং ও অন্যান্য

    ‘নায়ক’ সিনেমা দেখেছেন না? একদিনেও অনেক কিছু করা সম্ভব। যে করতে পারে সে সব করতে পারে। এই পুরো সবকিছু বাদ দিয়ে আবার ড্রাফট হবে, অকশন হবে, ফ্রি টাইমে বিপিএল হবে, সব আধুনিক টেকনোলজি থাকবে। ব্রডকাস্ট ভালো থাকবে। হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভেন্যু থাকবে।’

    দায়িত্ব পেলে বিপিএলে কী কী পরিবর্তন করতেন প্রশ্নের উত্তরে কথাগুলো বলেছিলেন সাকিব আল হাসান। তার এই কথাতেই অন্যান্য টি-টোয়েন্টি লিগের পার্থক্যটা স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল। বিপিএলের টিভি সম্প্রচারের মান নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনার অন্ত নেই। এইচডি পিকচার কোয়ালিটির যুগে বছর তিন-চারেক আগেও ঘোলা স্ক্রিনেই দেখতে হয়েছে বিপিএল। সাথে ম্যাচ চলাকালীন অদ্ভুতুড়ে সব গ্রাফিক্স-মোশনের কাজ তো ছিলই। স্কোরকার্ডের সাথে ক্রিকেটারদের নাম বিভ্রাটের দেখাও মিলেছে টিভির স্কোর স্ক্রলে। দ্বিপাক্ষিক সিরিজেও এখন ডিআরএস থাকে। অথচ এবারের বিপিএলেও নেই প্রযুক্তিগত এই সুবিধা। অন্তত প্লে-অফের আগে কাজ চালাতে হবে ডিআরএস ছাড়াই। 

    দেশের ক্রিকেটের এখন স্বীকৃত ভেন্যু তিনটি। মিরপুর, চট্টগ্রাম ও সিলেট। বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয় মিরপুরেই,হাতে গোনা কটা ম্যাচ জুটে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামে। কালেভদ্রে সিলেটে পা পড়ে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের। বিপিএল এলেই কেবল মিরপুর ছাড়া ক্রিকেটারদের পদচারণায় মুখরিত হয় সিলেট-চট্টগ্রাম। এজন্যই আইপিএলের মতো বিপিএলে নেই হোম ও অ্যাওয়ে ম্যাচের প্রচলন। যার মূল কারণ ভেন্যু সংকট। প্রায় এক যূগ হতে চলল বিপিএলের বয়স। এখনও এই রীতির পথে হাঁটতে পারেনি লিগটি।