• " />

     

    একটি স্বপ্নভঙ্গ অথবা নতুন পথচলার গল্প...

    একটি স্বপ্নভঙ্গ অথবা নতুন পথচলার গল্প...    

    প্যাভিলিয়ন-কিউট আয়োজিত স্পোর্টস ফিচার লেখা প্রতিযোগিতা 'খেলার লেখা, লেখার খেলা -১' এর দশজন বিজয়ীর লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হল প্যাভিলিয়নের ওয়েবসাইটে। প্রথম স্থান অধিকারী মেহেদী হাসান মুন-এর লেখা 'একটি স্বপ্নভঙ্গ অথবা নতুন পথচলার গল্প...' দিয়েই আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হচ্ছে আমাদের এই ধারাবাহিক।

     

     

    ২২ মার্চ,২০১২...
     

    ওয়ানডে ইতিহাসের ৩২৬৭ তম ম্যাচ, এশিয়া কাপের ফাইনাল সেদিন। বাংলাদেশের কাছে সেদিন কেবল পরিসংখ্যানের কোন ম্যাচ নয়, সেদিন স্বপ্নপূরণের ম্যাচ।যে স্বপ্ন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বাঙালিকে দেখতে শিখিয়েছে সেই এশিয়া কাপের প্রথম ম্যাচ থেকেই। প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ২১ রানের হারের পর পরের ম্যাচে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারতের বিপক্ষে জয়ের জন্যই মাঠে নেমেছিল টাইগাররা। ভারতের চ্যাম্পিয়ন তকমাকে মুহূর্তেই ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ যখন ৪ বল বাকি থাকতে পাঁচ উইকেটের জয় তুলে নেয় তখন পুরো ক্রিকেট বিশ্বই যেন অবাক তাকিয়ে ছিল। পুরো ম্যাচে ডমিনেন্স ক্রিকেট খেলে সদ্য ওয়ার্ল্ডকাপ ঘরে তোলা ভারতকে মাটিতে নামিয়ে এনেছিল টাইগার বাহিনী। তার সাথে পরের ম্যাচ শ্রীলংকার সাথে জয়ের আশার পালে দমকা হাওয়ার জোরও লেগেছিল বটে। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে শ্রীলংকার দেয়া ২৩২ রানের টার্গেট ডি/এল পদ্ধতির অদ্ভুতুড়ে নিয়মের কারণে হয়ে যায় ৪০ ওভারে ২১২।কিন্তু বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা তখন স্বপ্নজয়ের নেশায় বিভোর; সেই কঠিন টার্গেট তাড়া করেও বাংলাদেশ জিতে যায় ৫ উইকেট হাতে রেখেই। ক্রিকেট বিশ্বে তখন তোলপাড় কারণ বাংলাদেশের জয়কে তখন আর “ফ্লুক” বলার জো নেই। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দলকে অবলীলায় হারিয়ে বাংলাদেশ উঠে যায় এশিয়া কাপের ফাইনালে। এই প্রথম কোন বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের ফাইনাল বাংলাদেশ। স্বপ্নের সময় যেন শুরু হয়ে গেছে তখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের; এত বছরের হারের লজ্জা; মাঝে-সাঁঝের জয়গুলোকে অঘটন বলে চালিয়ে দেয়া; বুর্জোয়া ক্রিকেট বিশ্বের প্রতি আবেগীয় প্রতিশোধই নিচ্ছিল যেন বাংলাদেশ।

     

    ফাইনালের দিন পুরো বাংলাদেশ যেন আছড়ে পড়ে মিরপুর শের-এ-বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের হোম অফ ক্রিকেটে। সবাই এসেছে ইতিহাসের সাক্ষী হতে; সবার চোখে একটাই স্বপ্ন এশিয়া সেরা হওয়া। মাঠে-ঘাটে, চায়ের দোকান কিংবা টিভি সেটের সামনে সবাই এসে বসেছে বাংলাদেশের জয় দেখার জন্য। স্বাধীনতার ৪১ বছর পূরণের ক্রান্তিলগ্নে আবার একটি যুদ্ধজয়ের সামনে দাঁড়িয়ে যেন বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ সেই পাকিস্তান আর সময়টাও সেই উত্তাল মার্চ। বাঙালী স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে আশা করছিল দ্বিতীয় যুদ্ধজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা হতে।


    মধ্য আকাশের সূর্যকে ঢেকে কয়েন উড়ছে টসের জন্য।টস জয়ী মুশফিকুর রহিম নির্দ্বিধায় বোলিং এর সিদ্ধান্ত নেন। টস জয়ও যেন আশা দেখাচ্ছিল বাংলাদেশকে ম্যাচ জয়ের জন্য। মাশরাফি বল হাতে যখন প্রথম বল করার জন্য ছুটছিল তখন স্টেডিয়ামে আসা দর্শকদের গগনবিদারী চিৎকারই যেন পাকিস্তানের শিরদাঁড়ায় ভয়ের অনুভূতি জাগিয়ে দিয়েছিল। সাকিব, রাজ্জাক, মাশরাফিরা তাদের নিয়ন্ত্রিত বোলিং দিয়ে পাকিস্তানকে ২০০ রানও যেন না করতে দেয়ার পণ করেছিল। কিন্তু সরফরাজ ও আফ্রিদির ব্যাটে ভর করে এবং শাহাদাতের শেষের একটি বাজে ওভারে পাকিস্তান লড়াই করার মতো একটি পুঁজি পায়। ৫০ ওভার শেষে পাকিস্তানের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৯ উইকেটে ২৩৬। বাংলাদেশের এশিয়া কাপের ট্রফি জয় ও ১৬ কোটি বাঙালীর স্বপ্নপূরণের জন্য দরকার ছিল ২৩৭ রানের।
     

     

    তামিম ইকবাল আর নাজিমুদ্দিন বাংলাদেশ দলের কাণ্ডারি হয়ে যখন নামলো মাঠে তখন দেশের কোটি কোটি মানুষের চোখ যেন তাদের দিকে। একটি সুন্দর প্রারম্ভিকা সহজ করে দিতে পারে বাংলাদেশের জয়ের পথ। টুর্নামেন্টজুড়ে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা তামিম আর নাজিমুদ্দিন ধীর তবে একটি সুন্দর শুরু এনে দিলো বাংলাদেশকে। কিন্তু ২৩ ওভারের মধ্যে নাজিম,জহুরুল ও তামিম বিদায় নিলে ভয় গ্রাস করে ফেলে যেন প্রতিটি বাংলাদেশিকে। এর মাঝে মুশফিকুর রহিম খেললেন একটি চাতুর্যপূর্ণ চাল। নাসিরকে এনে নামিয়ে দিলেন ৪ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে। নাসিরের সাথে দলের বিপর্যয় থেকে উদ্ধারে হাত মেলালেন সেই টুর্নামেন্টে ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত খেলা সাকিব আল হাসান। দুজন মিলে ৮৯ রানের একটি অমূল্য পার্টনারশিপের মাধ্যমে দলকে পৌঁছে দিলেন ১৭০ রানে,কিন্তু নাসির স্বভাববিরুদ্ধ ধীর খেলার জন্যই হয়তো চাপে পড়ে আউট হয়ে যান দলকে বিপদে ফেলে। এরপর একে একে সাকিব, মুশফিক ও মাশরাফি বিদায় নিলে জয়ের আশা ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করে। একপ্রান্ত আগলে মাহমুদুল্লাহ রয়ে যান শেষ ওভার পর্যন্ত। স্ট্রাইকিং এন্ডে মাহমুদুল্লাহ আর নন-স্ট্রাইকিং এ রাজ্জাক। শেষ ওভারে প্রয়োজন ৯ রান, হাতে কেবল দুই উইকেট। পুরো বাংলাদেশ যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে স্বপ্নপূরণের আশায়। প্রথম ৪ বলে ৫ রান নিয়ে বাংলাদেশ যেন জয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিয়েছে,শেষ দুই বলে প্রয়োজন ৪ রান কিন্তু শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান মাহমুদুল্লাহ তখন নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তে। আইজাজ চিমার স্লোয়ারে যখন রাজ্জাকের স্ট্যাম্প ভেঙ্গে যায় বাংলাদেশের জয়ের স্বপ্নেও যেন বড় একটা আঁচড় পড়ে যায়। গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডের দু’ পাশে বসা প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর মুখেও চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট। কে না জানে ক্রিকেটই কেবল পারে দেশের সব মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করাতে। কোটি কোটি বাঙালী তখন দাঁড়িয়ে গেছে তাদের বসার জায়গা থেকে। শেষ বলে ৪ রান নিতে হবে শাহাদাত হোসেইনকে, তাহলেই স্বপ্নজয়ের আনন্দে মাততে পারবে পুরো বাংলাদেশ। এতদিন ধরে সহ্য করা বঞ্চনা-লাঞ্ছনার জবাব দিতে পারবে তারা, ক্রিকেট বিশ্বে “minnows” তকমাটা সবসময়ের জন্য ঝেরে ফেলতে পারবে।


    আইজাজ চিমার শেষ বল...শাহাদাত হোসেইন স্ট্রাইকিং এন্ডে। সাকিব, মুশফিক ড্রেসিং রুমে স্বপ্নালু চোখে তাকিয়ে আছে, তাকিয়ে আছে তাদের দিকে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ। বিশ্ব ক্রিকেটে নতুন পথচলা কি তবে শুরু হবে আজ থেকেই? আজই কি বাংলাদেশ পারবে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের পর সবচেয়ে বড় ক্রিকেট উৎসবে মাতোয়ারা হতে? বাংলাদেশ কি পারবে ক্রিকেট ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে?

     


    চিমা দৌড়ে এসে শেষ বলটি করলো শাহাদাত হোসেইনের লেগসাইড ঘেঁষে, শাহাদাতের ব্যাট বলে না লাগলেও পায়ে লেগে বল গড়াতে থাকে। মাহমুদুল্লাহ পড়িমরি করে দৌড়ে কেবল একটি রানই নিতে পারে। কেউই বুঝতে পারছে না কি হলো! পাকিস্তান দল উৎসব শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যেই। এশিয়া কাপ ছিনিয়ে নিয়ে গেল পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছ থেকে।

     

     

    পুরো বাংলাদেশে তখন পিনপতন নীরবতা, আমার বাসাতেও, কেবল হালকা ফোঁপানির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। ভাবছিলাম আমিই কাঁদছি কিন্তু টিভি সেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মুশফিক কাঁদছে, সাকিব ফোঁপাচ্ছে, নাসির-আনামুল সবার চোখে পানি। আমাদের বাসার পাশে থাকা পাগলা রহিম চাচা ‘হাইরা গেছে’ ‘হাইরা গেছে’ বলে চিৎকার করে কাঁদছে। স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট কেমন সেটা হয়তো প্রতিটি বাঙালিই বুঝতে পেরেছিল। এত কাছ থেকে হেরে যাওয়ার কষ্ট হয়তো বাংলাদেশ কখনো পায় নি আর পাবেও না।

     


     

    কিন্তু এই স্বপ্নভঙ্গ কি নতুন পথচলার শুরু নয়? ”পিপল’স চ্যাম্পিয়ন” বলে একটা শব্দ আছে ইংরেজিতে, যার বাংলা ভাবার্থ করলে দাঁড়ায় “মনন-জয়ী”। এশিয়া কাপের ট্রফি, প্রাইজমানি সবই হয়তো পাকিস্তানের কাছে গিয়েছে কিন্তু বিশ্বজুড়ে ক্রিকেটপ্রেমী দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছে বাংলাদেশ।

     

     

    বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের চোখের পানি প্রতিটি ক্রিকেটপ্রেমীকে কাঁদিয়েছিল সেদিন। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের ক্রিকেট নিয়ে ভালবাসা সেদিন দেখেছিল সমগ্র বিশ্ব। সেবার এশিয়া কাপ বিজয়ী হলে হয়তো পৃথিবীব্যাপী মানুষ দেখতে পেতো না এই আবেগ,এই ভালবাসা। এরকম কতো কাপ সামনে জিতবে বাংলাদেশ কিন্তু পৃথিবীব্যাপী মানুষের আবেগে সিক্ত ভালবাসা বারবার পাওয়া যায় না।

     

     

    আমার দেখা সেরা ম্যাচ বললে হয়তো ভুলই হবে, কারণ বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান এশিয়া কাপ ফাইনাল ম্যাচটি সব ক্রিকেটপ্রেমী বাঙালীর হৃদয়েই চিরভাস্মর হয়ে থাকবে। এটা আমার অনুমান নয়, বিশ্বাস।

     

    সেরা দশের অপর নয়টি লেখাঃ

     

    ২. ওরা এগারো জন - সোয়েলেম আফনান

     

    ৩. ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা একাদশ - ধ্রুব আলম

     

    ৪. বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচ - নওশাদ জামান

     

    ৫. ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা একাদশ - মো : নাহিন মাহমুদ

     

    ৬. একদিবসি ক্রিকেটের সেরা এগার বাঘ - মিশু কাজী

     

    ৭. ৪৩৪, ৪৩৮ - চিন্ময় নাথ সাহা

     

    ৮. অপ্রতিরোধ্য এগারো - আহমাদ বিন হুসাইন

     

    ৯. ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা একাদশ - নিয়াজ মোরশেদ

     

    ১০. বাংলাদেশের লঙ্কা বধ - মোঃ নাজমুস সাকিব