• " />

     

    বাংলাদেশের লঙ্কা বধ

    বাংলাদেশের লঙ্কা বধ    

    প্যাভিলিয়ন-কিউট আয়োজিত স্পোর্টস ফিচার লেখা প্রতিযোগিতা 'খেলার লেখা, লেখার খেলা -১' এর দশজন বিজয়ীর লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে! আজ থাকছে দশম স্থান অধিকারী মোঃ নাজমুস সাকিব-এর লেখা 'বাংলাদেশের লঙ্কা বধ'।

     

    ১৪ই জানুয়ারী, ২০০৯। ত্রি-দেশীয় ওয়ানডে সিরিজের জীবন-মরণ লড়াইয়ে শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি বাংলাদেশ। রাউন্ড রবিন লিগ পদ্ধতির এই সিরিজে জিম্বাবুয়ের কাছে ৩৮ রানে হেরে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ফাইনাল খেলা অনিশ্চিত। অন্যদিকে জিম্বাবুয়েকে ১৩০ রানের বিশাল ব্যাবধানে হারিয়ে ফাইনাল খেলা ইতোমধ্যে নিশ্চিত করে ফেলেছে শ্রীলঙ্কা। ফাইনাল খেলতে হলে তাই বাংলাদেশকে শুধু জিতলেই হবে না, জিততে হবে বোনাস পয়েন্টসহ।

     

     

    জিম্বাবুয়ের কাছে হেরে যাওয়ায় সারা দেশে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রতি বিষোদগার যেন ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলেছে। “জিম্বাবুয়ের সাথেই যারা পারে না তারা শ্রীলঙ্কাকে কি হারাবে?” “বাংলাদেশ হারুক সমস্যা নাই কিন্তু যাতে খেইল্লা হারে।” “আরে! ওরা জিতলেই কি আর হারলেই কি, ট্যাকা তো ঠিকই পায়।”- এমনি আরও গুরুগম্ভীর সমালোচনা যেন চায়ের কাপে নিয়তই ঝড় তুলছে।

     

     

    শ্রীলঙ্কার সাথে আগের ২৪ সাক্ষাতে ২৩টিতেই হার, সর্বশেষ দুটি ওয়ানডে সিরিজে হার, সর্বশেষ ম্যাচে জিম্বাবুয়ের কাছে হার- এমন আরও নানা রকমের নেতিবাচক পরিসংখ্যানের বোঝা মাথায় নিয়ে মিরপুরের শের-ই-বাংলা ন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামে গেলাম বাংলাদেশ বনাম শ্রীলঙ্কার খেলা দেখতে। খেলা সকাল ৯টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কুয়াশার কারণে খেলা শুরু হল নির্ধারিত সময়ের থেকে বেশকিছু সময় পর, দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে। যে কারণে ৫০ ওভারের খেলার দৈর্ঘ্য কমে দাঁড়ালো ৩১ ওভারে। মহাগুরুত্বপূর্ণ টস জিতে প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খেলা একাদশ থেকে দুটো পরিবর্তন নিয়ে মাঠে নামলো বাংলাদেশ দল। অন্যদিকে ফাইনাল নিশ্চিত করেও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খেলা একাদশ থেকে কোন পরিবর্তন না নিয়ে শক্তিশালী দলকেই মাঠে নামালো টুর্নামেন্টের ফেভারিট শ্রীলঙ্কা।

     

     

    একাদশ নিয়ে মাঠে যখন আঁটসাঁট বিশ্লেষণ চলছে তখন তুমুল করতালিতে বাংলাদেশ দল অধিনায়কের নেতৃত্বে মাঠে নামলো। করতালির শব্দে গায়ের লোম শিউরে উঠল! বুঝতে পারলাম, চারপাশে যতই আলোচনা-সমালোচনা হোক, বাংলাদেশ দল মাঠে নামলেই যেন সবাই সব ভুলে যায়! মনে থাকে শুধু দলটা আমাদের সবার। “বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!” তুমুল স্লোগানে মুখরিত ২৫,০০০ আসনের পুরো স্টেডিয়াম অঞ্চল।

     

     

    প্রথম ওভারে বোলিং আক্রমণে বাংলাদেশের অভিজ্ঞ সেনানী মাশরাফি। প্রথম দুই বলেই ব্যাটসম্যান উপুল থারাঙ্গা দারুণভাবে পরাস্ত। ব্যাটসম্যান যখন পরের বল কোথায় হবে, লেংথ কেমন হবে এই নিয়ে ভাবিত ঠিক অন্যদিকে মাশরাফি প্রথম দুই বলেই ব্যাটসম্যানকে তার অভিজ্ঞ চোখে যেন পড়ে ফেলেছিলেন! ইনিংসের প্রথম বলের মতই হুবহু তৃতীয় বলেও পরাস্ত ব্যাটসম্যান! প্রথমবার স্ট্যাম্প থেকে খানিকটা উপরে বল যায় ভেবে আম্পায়ার আউট না দিলেও এবার আম্পায়ার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। আউট! প্রথম লঙ্কান উইকেটের পতন। মাশরাফির পরের  ওভারে আবারো উইকেটের পতন! এবার আউট লঙ্কানদের অন্যতম ভরসা সাঙ্গাকারা। দারুণ এক ইনসুইঙ্গারে সম্পূর্ণ পরাস্ত ব্যাটসম্যান। ফলাফল ক্লিন বোল্ড! স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছে শ্রীলঙ্কা ৪/২! গ্যালারিতে চাপা গুঞ্জন, তাহলে কি আজ আমাদের দিন? বাংলাদেশের বড় জয়গুলোর মূলে আছে বল হাতে মাশরাফির হাতে ইনিংসের শুরুর ব্রেকথ্রু- ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক আশরাফুলের কথাকে যেন সত্য প্রমাণ করতে আটঘাট বেঁধে নেমেছেন মাশরাফি। গ্যালারির উচ্ছ্বাসকে নীরব শশ্মানে পরিণত করার কাজে যখন অভিজ্ঞ লঙ্কান জুটি জয়াসুরিয়া-জয়াবর্ধনে মোটামুটি সফল ঠিক তখনি লঙ্কান শিবিরে টাইগারদের আঘাত। এবার ঘাতক নাঈম। শিকার জয়াবর্ধনে। স্কোর ৭৫/৩!

     

     

    সবাই গেলেও ওই এক জয়াসুরিয়া একাই ম্যাচ বের করে নিতে পারবে- আমার পাশে বসা এক প্রবীণ দর্শকের মন্তব্য যেন কিছুতেই মানতে পারছিল না তরুণ এক দর্শক। না আঙ্কেল! আপনার সাথে একমত হতে পারলাম না। বাংলাদেশ দল আগের থেকে এখন অনেক পরিণত। চাপের মুখে দারুণ খেলে এই বাংলাদেশ- তরুণের মন্তব্য। প্রবীণ দর্শক যেই না একটা তির্যক মন্তব্য করতে যাচ্ছেন ঠিক তখনই আউট! জয়াসুরিয়া আউট! “কি? বলেছিলাম না?” “হুম”- তরুণের উচ্ছ্বাসকে হাসিমুখে একশব্দে মেনে নিলেন প্রবীণ।

     

     

    অভিজ্ঞ নাজমুলের জায়গায় আনকোরা রুবেলের অভিষেক কেন? গ্যালারির এই প্রশ্নটা হয়তো মাঠে থেকেই শুনতে পেয়েছিলেন রুবেল হোসেন। জবাব দিতে তাই এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। শেষ চার লঙ্কান ব্যাটসম্যান পুড়লেন তার অগ্নিঝরা স্পেলের। রুবেলের বাউন্সারের কোন উত্তর দিতে না পেরে লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের প্যাভিলিয়নের পথ ধরায় শ্রীলঙ্কার স্কোর ১৪৭/১০।

     

     

    প্রথম ইনিংস শেষে সবাই বাংলাদেশের আপামর জনতা যেন স্মৃতির ভেলায় ফিরে গিয়েছিল ২০০৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারীর বগুড়ার শহিদ চান্দু স্টেডিয়ামে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একমাত্র জয়ের সুখস্মৃতি তো ওটাই! সেদিন যদি বাংলাদেশ ২১৩ রানের লক্ষ্যে জিততে পারে তবে আজ কেন নয়?

     

     

    আপাত লক্ষ্য সহজ মনে হলেও ফাইনাল খেলতে বাংলাদেশের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল বোনাস পয়েন্টসহ জয়। যে কারণে ৩১ ওভার নয়, বোনাস পয়েন্টসহ জয়ের জন্য ২৪.৫ ওভারে খেলা শেষ করার লক্ষ্য দাঁড়ালো। কঠিন পথ, তবু লক্ষ্য অর্জনের আশায় বুক বাঁধল পুরো দেশ। কিন্তু ৪ ওভার শেষেই যেন সব আশার বেলুন বাতাসে উড়েই চুপসে গেল! প্রথম ৪ ওভারের মধ্যেই নেই প্রথম তিন টাইগার তামিম, জুনায়েদ ও মুশফিক। উইকেটে অধিনায়ক আশরাফুল ও তরুণ সাকিবের কাঁধে তখন পাহাড়সম প্রত্যাশার চাপ।

     

     

    দেখেশুনে খেলার ব্রত বেছে নিলেন দুই ব্যাটসম্যান। ইনিংসের ৫ম ওভার শেষে যেন সাকিব করণীয় বুঝে নিলেন। ৬ষ্ট ওভারে তুষারার শেষ দুই বলে পরপর দুটি চার মেরে সাকিব যেন সেটাই বুঝিয়ে দিলেন। ঠিক পরের ওভারে কুলাসেকারাকেও শেষ দুই বলে পরপর দুটি চার মেরে সাকিব বুঝিয়ে দিতে চাইলেন দিনটা আজ আমারই। ইনিংসের ১০ম ও অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের ১ম ওভারে ১২ রান নিয়ে সাকিব যখন আস্কিং রানরেটের সাথে পাল্লা দিচ্ছেন, মাঠে লঙ্কান অধিনায়ক জয়াবর্ধনের কপালে চিন্তার ভাঁজ তখন টিভি স্ক্রিনের মতই গ্যালারি থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

     

     

    সাকিবের ব্যাটে রানের ফোয়ারা অবিরত ছুটে চলেছে, রহস্য স্পিনার অজন্তা মেন্ডিস তখনও রহস্যের ঝাঁপি খুলে ব্যর্থতার জালে নিজেই আবদ্ধ, তখন জয়াবর্ধনের ডাক বিশ্বসেরা স্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরনের। সাকিবের ব্যাটে লাগাম পরাতে জয়াবর্ধনের কৌশল বুঝতে পারলেন টাইগার অধিনায়ক। তাই বটবৃক্ষের ছায়ার মত সাকিবকে আগলে রাখার দায়িত্ব নিলেন অধিনায়ক আশরাফুল। কোন ঝুঁকি না নিয়ে মুরালিধরনকে প্রাপ্য সম্মান দিয়ে দেখেশুনে খেলতে থাকলেন এই দুই ব্যাটসম্যান। এরই মধ্যে সাকিবের ব্যক্তিগত ৫০ রান পূরণ হয়ে গেল। ১৮ ওভার শেষে বাংলাদেশের স্কোর ১০০/৩।

     

     

    ফাইনাল খেলতে বাংলাদেশের প্রয়োজন ৪১ বলে ৪৮ রান। হাতে ৭ উইকেট। ফাইনাল নিঃশ্বাস দূরত্বে তবুও পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী খেলতে গিয়ে কুলাসেকারাকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ডিপ স্কয়ার লেগে জয়াসুরিয়ার বিশ্বস্ত হাতে বন্দি হলেন অধিনায়ক আশরাফুল। আবারও তীব্র আশংকা ফাইনাল খেলতে পারবে তো বাংলাদেশ? নাকি স্বপ্নের সলিল সমাধি এখানেই?

     

     

    কুলাসেকারাকে গ্যালারিতে আছরে ফেলে সাকিব অভয় দিলেন। কিন্তু রহস্য স্পিনার মেন্ডিস হাল ছাড়লেন না। রাকিবুল হাসানকে বোল্ড করে আবারও বাংলাদেশ শিবিরে আতঙ্ক ছড়ালেন। উইকেটে আসলেন নাঈম ইসলাম। মেন্ডিসকে সীমানা ছাড়া করে ৬ বল হাতে রেখেই নতুন এক ইতিহাস গড়লো বাংলাদেশ যার নায়ক তরুণ তুর্কি সাকিব আল হাসান। সাকিবের মুষ্টিবদ্ধ হাত বোঝাল হারের আগে না হারার মানসিকতা।

     

     

     

    ঘড়িতে সময় বিকাল ৪টা ৪৫ মিনিট। পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে পুরো আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে। গ্যালারির সব দর্শকের চোখে, স্টেডিয়াম গেইটের বাইরে অপেক্ষারত জনতা যারা বীরদের অভ্যর্থনা জানাবে তাদের চোখে জয়ের আনন্দ যেভাবে চিকচিক করছে, বুঝতে পারলাম সূর্যের লাল আভার মতই বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয় যেন পুরো বাংলাদেশকে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলেছে মুহূর্তেই।