ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা একাদশ

প্যাভিলিয়ন-কিউট আয়োজিত স্পোর্টস ফিচার লেখা প্রতিযোগিতা 'খেলার লেখা, লেখার খেলা -১' এর দশজন বিজয়ীর লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে! আজ থাকছে নবম স্থান অধিকারী নিয়াজ মোরশেদ-এর লেখা 'ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা একাদশ'।
আমাদের ওয়ানডে ক্রিকেটের সর্বকালের শুরুটা হয় ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ শ্রীলঙ্কার মোরাতুয়ার টায়রন ফার্নান্ডো স্টেডিয়ামে, সেটি ছিল ৩৭৫তম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ। সেখান থেকে শুরু করে গত ২৮ বছরে, হালের বাংলাদেশ-শ্রীলংকা সিরিজের আগ পর্যন্ত আমরা ১৭টি ভিন্ন দেশের বিপক্ষে খেলে ফেলেছি ২৭৬টি ওয়ানডে ম্যাচ, জিতেছি ৮০টিতে! এই ২৭৬ ম্যাচের আলোকে নির্বাচন করা হয়েছে “ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা একাদশ!”।
১। তামিম ইকবালঃ ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের ধ্রুবতারা হয়ে আবির্ভাব ঘটে এই ওপেনারের, ২০০৭ বিশ্বকাপের ভারতকে হারানোর সে ম্যাচে জহীর খানকে মারা তামিমের ছক্কাগুলো আজও গেঁথে আছে বাঙ্গালী ক্রিকেট-প্রেমীদের মনে। ১২৪ ম্যাচে ৩০ গড়ে ৩৭০২ রানের মালিক তামিম এই একাদশের এক রকমের “অটোমেটিক পিক”ই বলা যায়! ওয়ানডে ক্রিকেটে দেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী তামিম।
২। জাভেদ ওমর বেলিমঃ তামিমের সাথে দ্বিতীয় ওপেনারকে বেছে নিতে যথেষ্ট কষ্ট হয়েছে! রান বা গড়ের দিক থেকে হিসেব করলে জায়গাটা শাহরিয়ার নাফিস কিংবা ইমরুলের প্রাপ্য। কিন্তু তামিমের সাথে এমন কাউকে দরকার যে নিজের উইকেট বিলিয়ে দেবে না! জানি এটা টেস্ট একাদশ নয়, তবে সব ধরনের ক্রিকেটেই যেকোনো বিপর্যয় ঠেকাতে উইকেটে মাটি-কামড়ে থাকার মত কাউকে চাই, আর সাথে বাড়তি পাওনা রাইট হ্যান্ড-লেফট হ্যান্ড ওপেনিং কম্বিনেশন! ৫৯ ম্যাচে প্রায় ২৪ গড়ে ১৩১২ রান করা বেলিম তাই আমার সেরা একাদশের ওপেনার। গুল্লু প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিলেন ১৯৯৫ সালে।
৩। মোহাম্মদ আশরাফুলঃ বিপিএল এর ঘটনা নিয়ে অনেকের মনে জমে থাকতে পারে এই মানুষটার জন্য অনেক রাগ, ক্ষোভ। কিন্তু বাংলাদেশের যেকোনো ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা একাদশে আশরাফুল না থাকলে সেটা পুরাই বৃথা! ২০০১ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসা আশরাফুল দেশের প্রথম ক্রিকেট-সুপারস্টার, বেশ লম্বা একটা সময় ছিল সে আউট হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যাটিং দেখতো সাধারণ মানুষ! ২০০৫ এ কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়াকে মাটিতে নামিয়ে আনার ম্যাচে তার সেই অবিশ্বাস্য সেঞ্চুরির কথা মনে পড়লে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়! ১৭৫ ম্যাচে ২২.৩৭ গড়ে ৩৪৬৮ রান করা আশরাফুল দলের ওয়ান ডাউন ব্যাটসম্যান।
৪। হাবিবুল বাশার সুমনঃ টু ডাউনে সুমনের আগে অন্য কারো কথা মাথায় আসেওনি! ১৯৯৫ সালে অভিষিক্ত, অনেকটা সময় জাতীয় দলের অধিনায়ক থাকা সুমনের ব্যাটিং টেকনিক হয়তো দুর্দান্ত না, কিন্তু ক্রিকেটীয় ভাষায় বললে “হ্যান্ড-আই” কোঅর্ডিনেশনের চমৎকার উদাহরণ এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান। ১১১ ম্যাচে প্রায় ২২ গড়ে হাবিবুল করেছেন ২১৬৮ রান।
৫। মুশফিকুর রহিম (অধিনায়ক): উইকেট-কিপার নয় ব্যাটসম্যান হিসাবেই দলে নিলাম বাংলাদেশের বর্তমান অধিনায়ককে, কিপিং গ্লাভসগুলো আরেকজনের জন্য তুলে রাখা! এবং আমার এই দলের অধিনায়কও সে, আমার মতে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা অধিনায়ক মুশফিকই (তার অধিনায়কত্বে খেলা ওয়ানডে ম্যাচগুলোর ৪৮ শতাংশ জিতেছি আমরা)! পরিস্থিতি অনুযায়ী মাথা ঠাণ্ডা রেখে সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দেয়ার গুণটাই আমাকে খুব মুগ্ধ করে। ছোটখাটো দেখতে মুশির ব্যাটিংটাও দারুণ, টেকনিকের দিক থেকে অনায়াসে দেশের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখা মুশফিক ১২২ ম্যাচে ২৬.৩৩ গড়ে করেছে ২৪৪৯ রান।
৬। সাকিব আল হাসানঃ কোন চিন্তাভাবনা ছাড়াই বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়টির নাম সাকিব আল হাসান! এই একাদশে তার নাম সবার আগে লিখে তারপরে বাকি দশজনকে নিয়েছি! একটা সময় বাইরের বিশ্ব আমাদের ক্রিকেটকে চিনতো আশরাফুলের নামে, এখন চেনে সাকিবের নামে! ২০০৯ সালের জানুয়ারীতে, প্রথম বাঙ্গালী হিসাবে আইসিসি ওয়ানডে অলরাউন্ডার র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর অলরাউন্ডার হয়েছিল সাকিব, এবং টানা ২০১১ এর এপ্রিল পর্যন্ত ধরে রেখেছিল সেই স্থান। বর্তমানে সে দুই নম্বর স্থানে আছে। দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশী ম্যান অব দ্যা ম্যাচ (১৩) পুরষ্কার জেতা সাকিব প্রথম দলে আসে ২০০৬ সালে। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ভারতের ঘরোয়া লীগে নিয়মিত বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে সাকিব। ১২৯ ম্যাচে ৩৫ গড়ে সাকিবের রান ৩৬৮৮ (দেশের ২য় সর্বোচ্চ) এবং ৪.৩১ ইকোনমিতে ২৯ গড়ে তার উইকেট ১৬১ (দেশের ৩য় সর্বোচ্চ)। বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশী শতক (৫) এবং অর্ধশতক (২৫) সাকিবের!
৭। খালেদ মাসুদ পাইলটঃ একটা সময় ছিল যখন এই উপমহাদেশের সেরা উইকেট-কিপার বলা হত আমাদের পাইলটকে। ক্যারিয়ারের শেষের দিকে ব্যাট হাতে খুব বেশী অবদান রাখতে না পারলেও উইকেটের পিছনে কখনই হতাশ করেননি খালেদ মাসুদ। ক্যারিয়ারের এক পর্যায়ে এসে মুশফিকের কাছে জায়গা হারালেও এই দলের কিপিং গ্লাভস তার জন্যই তুলে রেখেছিলাম! ১২৬ ম্যাচে ১২৬ ডিসমিসাল (৯১ ক্যাচ, ৩৫ স্ট্যাম্পিং) নিয়ে পাইলটই বাংলাদেশের সফলতম উইকেট-কিপার (মুশফিক ১২৩ ডিসমিসাল নিয়ে ২য়)। ব্যাট হাতে ২২ গড়ে ১৮১৮ রান করেছেন ১৯৯৫ সালে অভিষিক্ত পাইলট।
৮। মাশরাফি বিন মুর্তজাঃ সন্দেহাতীতভাবেই বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলারের নাম মাশরাফি বিন মুর্তজা, সব দিক থেকে বাকিদের থেকে সে এতটাই এগিয়ে যে তালিকা করলে তাকে ১ এ রেখে ২-৩-৪-৫ হয়তো খালি রেখে পরবর্তী জনের নাম লিখতে হবে! ওয়ানডেতে ভারতকে হারানোর প্রতিটি ম্যাচেই মাশরাফির বোলিং পারফরম্যান্স স্মরণীয় হয়ে আছে! ২০০৭ বিশ্বকাপের সেই ম্যাচে শেওয়াগকে করা বলটা এখনো চোখে ভাসে! ১২৯ ম্যাচে ৩০.৫৯ গড়ে ১৬৪ উইকেট নিয়ে দেশের ইতিহাসের ২য় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী ম্যাশ প্রথম ওয়ানডে খেলেন ২০০১ সালে। ব্যাটসম্যান মাশরাফিকে নিয়ে বেশী কিছু বলবো না, শুধু একটা মজার তথ্য, অনেকেই হয়তো জানেন না যে বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসে সকল ব্যাটসম্যানের মধ্যে মাশরাফির স্ট্রাইক রেট (৮৭.৪৪!) সবচেয়ে বেশী, ২য় স্থানে আফতাব (৮৩.০৪)।
৯। আবদুর রাজ্জাকঃ বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে ২০০ উইকেট নেয়া একমাত্র বোলার আবদুর রাজ্জাক, স্বাভাবিকভাবেই ওয়ানডেতে দেশের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীও তিনি! বাংলাদেশ বাঁহাতি স্পিনারদের স্বর্গ রাজ্য, তারপরও ২০০৪ থেকে রাজ্জাক ওয়ানডে দলের নিয়মিত সদস্য। ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ৪ বার (দেশের সর্বোচ্চ)! ১৪৭ ম্যাচে ২৮ গড়ে রাজ্জাকের উইকেট ২০৪টি। ব্যাটসম্যান রাজ্জাককে নিয়ে এক লাইন না লিখলেই নয়, ওয়ানডেতে বাংলাদেশের দ্রুততম অর্ধশতকের (২২ বলে ৫৩ রান) মালিক কিন্তু রাজ্জাক!
১০। মোহাম্মদ রফিকঃ রফিককে ছাড়া আমাদের এই দল অসম্পূর্ণ! একদলে ৩জন বাঁহাতি স্পিনার দেখে অনেকের ভ্রু কুঁচকে যেতে পারে কিন্তু ১৯৯৫ সালে ওয়ানডেতে অভিষিক্ত মোহাম্মদ রফিকই ক্রিকেট বিশ্বকে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের বাঁহাতি স্পিনারদের জাত চিনিয়েছেন! ইনিংসে ১ বার ৫ উইকেট নেয়া রফিক ১২৫ ম্যাচে প্রায় ৩৮ গড়ে নিয়েছেন ১২৫ উইকেট।
১১। রুবেল হোসেনঃ ফাস্ট বোলারের আকাল এই দেশে, এটা সবারই জানা! এই দলের ২য় ফাস্ট বোলার বেছে নেয়াটা ছিল বেশ কঠিন। অনেক চিন্তার পর রুবেলকে বেছে নেয়ার পিছনে যে, গত বছর ২য় বারের মত নিউজিল্যান্ডকে বাংলাওয়াশ দেয়া সিরিজের ১ম ম্যাচে হ্যাট্রিকসহ রুবেলের ৬-উইকেট কীর্তির একটা বড়সড় ভূমিকা ছিল, এটা অস্বীকার করবো না! পরিসংখ্যান বিবেচনায় রাসেল, শফিউল, তাপস কিংবা খালেদ মাহমুদ এই জায়গার দাবিদার, কিন্তু সত্যিকারের ফাস্ট বোলার আমাদের কেউ থাকলে সেটা রুবেলই। বাংলার কোন ফাস্ট বোলার “একক নৈপুণ্যে ওয়ানডে জেতাতে পারে” এটা অনেকটাই দিবাস্বপ্ন হয়ে ছিল। ২৯ অক্টোবর ২০১৩ রাতে, মিরপুরে রুবেলের ৩.৫ ওভারের সেই স্পেলটা যারা লাইভ দেখেছিলেন তারা জানেন ওটা আর দিবাস্বপ্ন নয়! ১০ রানে হ্যাট্রিকসহ ৫ উইকেট নিয়ে একাই দলকে জিতিয়েছিলেন রুবেল। ৫.৫-০-২৬-৬, আমাদের ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা বোলিং (কম বলে ৬ উইকেট নেয়া বিবেচনায়) ফিগারটা তার! ২০০৯ সালে অভিষিক্ত রুবেল ৪৩ ম্যাচে পেয়েছে ৫৬ উইকেট।
দ্বাদশ খেলোয়াড়ঃ নাসির হোসেন।