• " />

     

    ৪৩৪, ৪৩৮

    ৪৩৪, ৪৩৮    

    প্যাভিলিয়ন-কিউট আয়োজিত স্পোর্টস ফিচার লেখা প্রতিযোগিতা 'খেলার লেখা, লেখার খেলা -১' এর দশজন বিজয়ীর লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে! আজ থাকছে সপ্তম স্থান অধিকারী চিন্ময় নাথ সাহা-এর লেখা '৪৩৪, ৪৩৮'।

     

     

    লেখাটির শিরোনাম দেখলে অবাক হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সত্যি বলতে কি, লিখতে বসার পর   এর চেয়ে যুতসই আর কোন নাম খুঁজে পেলাম না। যেকোনো ক্রিকেট প্রেমীই এই দুটি সংখ্যা দেখলে বুঝতে পারবেন, আমি কোন অবিস্মরণীয়  রোমাঞ্চকর ম্যাচের কথা বলছি। সাধারণত একটি ক্রিকেট ম্যাচ স্মরণীয় হয় কোন ব্যাটসম্যানের অসাধারণ ইনিংস, কিংবা কোন বোলারের দুর্দান্ত নৈপুণ্য দিয়ে। বোলিং এর কথা না হয় বাদ দিলাম, এই ম্যাচে অসাধারণ ইনিংসের কোন অভাব ছিল না।কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে এই ম্যাচটির কথা মনে পড়লেই চোখে ভাসে সেই দুটি সংখ্যা।

     

     

    ১২ই মার্চ,২০০৬। স্থান  জোহানেসবার্গের নিউ ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়াম । অস্ট্রেলিয়া বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা ৫ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচ। সিরিজে তখন ২-২ সমতা।  আগের ম্যাচগুলোও  কম  রোমাঞ্চকর ছিল না।কিন্তু ক্রিকেট বিধাতা শেষ ম্যাচে যে এত নাটক, বিস্ময় জমিয়ে রাখবেন কে জানত!

     

     

     অসি অধিনায়ক রিকি পন্টিং টসে জিতে ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত  নিলেন। খেলা শুরুর আগে পুরো মাঠটা বারবার দেখাচ্ছিল, আর ধারা ভাষ্যকার বলছিলেন ,এই ছোট মাঠে অনেক রান হবার সম্ভাবনা। যাই হোক, অসি ওপেনারদ্বয় গিলক্রিস্ট আর ক্যাটিচ  ব্যাটিং এ নামলেন। শুরু থেকেই মারমুখী খেলছিলেন তারা। ১০ ওভারেই রান উঠল ৬৬।আমি ভাবলাম, এরকম হলে  ৩০০ এর কাছাকাছি একটা স্কোর হবে। কিন্তু  আমার কথা যে এতটা ভুল প্রমাণিত হবে তা  যদি জানতাম!

     

     

    ৯৬ রানের মাথায় গিলক্রিস্টের বিদায়ে ওপেনিং জুটি ভাঙল । ওয়ান ডাউনে এলেন পন্টিং।উইকেট পড়লেও রানের গতিতে কোন ছেদ পড়ল না। উল্টো পন্টিং আসার পর  রানরেট আরও বেড়ে গেল।এই ছোট মাঠে  প্রোটিয়াস বোলার আর ফিল্ডারদের  দারুণ অসহায় মনে হচ্ছিল।২৫ ওভারেই স্কোর  দাঁড়াল ১৬৪/১।আমি ছিলাম দক্ষিণ আফ্রিকার ফ্যান, তাই টিভি স্ক্রিনে যতবারই  প্রজেক্টেড স্কোর দেখছিলাম , মন  খারাপ  হয়ে যাচ্ছিল।

     

     

     ৩১তম ওভারে ২য় উইকেট এর পতন। ততক্ষণে রান ২০০ পার হয়ে গেছে।এইবার ক্রিজে এলেন মাইক হাসি।কিন্তু পন্টিং এর মারমুখী ব্যাটিংএর  কোন পরিবর্তন হল না।তিনি যেন প্রোটিয়াস বোলারদের ছাতুপেটা করতেই নেমেছেন সেদিন। ৩৮ তম ওভারে সেঞ্চুরি তুলে ফেললেন তিনি(৭১ বলে)।দলের সংগ্রহ ২৭৪/২। ৪০ ওভারেই রান ৩০০ পার হয়ে গেল। স্ক্রিনে তখন দেখাচ্ছিল ওয়ানডেতে দলীয় সর্বোচ্চ রানের তালিকা।আমি  প্রোটিয়াসদের জয়ের সম্ভাবনা  ছেড়ে দিয়ে কোনমতে যেন মানসম্মান নিয়ে ম্যাচটা যেন শেষ করে, এই আশা করলাম। কিন্তু ক্রিকেট বিধাতা যেন ওইদিন অস্ট্রেলিয়াকে শুধু দিয়েই যাচ্ছিলেন। শেষ ১০ ওভারে  চার আর ছয়ের ফুলঝুরি আরও বেড়ে গেল। অবশেষে ডিপেনারের দারুণ এক ক্যাচে শেষ হয় পন্টিং এর   ১০৫ বলে ১৬৪ রানের  দুর্দান্ত ইনিংস। ইনিংসে ছিল ১৩ চার আর ৯ ছক্কার মার। তবে  পন্টিং আউট হলে কি হবে, দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষতি যা হবার, ষোলকলা পূর্ণ  হয়ে গেছে। ৪৮ তম ওভারে  ওয়ানডে ক্রিকেট  ইতিহাসে  প্রথমবারের মত ৪০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করল। শেষ পর্যন্ত স্কোর থামল ৪৩৪রানে । প্রোটিয়াস বোলারদের রান খরচের হিসাবটা আর নাইবা দিলাম।ধারাভাষ্যকার তো ঘোষণা করেই  দিলেন,এই রান  কখনই অতিক্রম করা  সম্ভব নয়।

     

     

    এই ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংস দেখা আসলেই বৃথা। আমিও তাই  খেলা  দেখা বাদ দিয়ে নিজের কাজে চলে গেলাম। তাও ঘণ্টা  দেড়েক  পর এসে  দেখলাম, স্কোর ৮ ওভারে  ৫৭/১।  দক্ষিণ আফ্রিকা এইবার বেশ ভালভাবেই  হারতে যাচ্ছে। তাই খেলা দেখার চিন্তা বাদ দিলাম।

     

     

    যাই  হোক , ঘণ্টা দেড়েক পার হতে না হতেই মনটা খচ খচ করতে লাগল। ভাবলাম, যাই স্কোরটা আবার দেখে  আসি।টিভির সামনে গিয়ে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। ২৫ ওভারে স্কোর ২২৯/২।এ তো দেখি পিটুনিতে অসিদেরও ছাড়িয়ে গেছে প্রোটিয়াসরা ।মাঝখানের  বেধড়ক মারগুলো মিস করায় আফসোস হতে লাগলো খুব।   যদিও প্রোটিয়াসদের চার আর ছক্কার ফুলঝুরি দেখে  এই আফসোস আর বেশীক্ষণ রইল না।। ক্রিজে অপরাজিত ছিলেন গিবস(১১৪ রানে) আর ভিলিয়ারস। রানের চাকা তিড়িং বিরিং  করে লাফিয়ে চলছিল।৩০ ওভার  শেষে  স্কোর  ২৭৯/২। যেখানে গিবস একাই ১৫৬ রানে অপরাজিত। শেষ ২০ ওভারে দরকার ১৫৫ রান, মোটেই অসম্ভব মনে হচ্ছিল না।এরপরই নাটকের শুরু ।পরপর ২ ওভারে গিবস আর ভিলিয়ারসের বিদায়।গিবস খেললেন ১১১ বলে ১৭৫ রানের একটি অসাধারণ ইনিংস।

     

     

    দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যানরা নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে লাগলেন। শেষ ৮ ওভারে লাগে ৮০ রান। ভন ডার ওয়াথের এক ছোট ঝড়ো ইনিংসে আস্কিং রেট কিছু কমলো । অন্য প্রান্ত আগলে ছিলেন অভিজ্ঞ উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান বাউচার।শেষ ৩ ওভারে লাগে ৩০ রান। নখ কামড়ানো উত্তেজনা। ভন ডার ওয়াথের  বিদায়ের পর হাতে আছে আর ৩ উইকেট। ৪৮ তম ওভারে  চার হল ৩ টি । ফলাফল শেষ ২ ওভারে লাগে ১৩ রান।পরের ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার অষ্টম উইকেটের পতন। ক্রিজে এলেন অ্যান্ড্রু হল। ।কোন মতে  ব্র্যাকেন এর ওভারটি পার করে দিলেন তিনি। শেষ ওভারে  জয়ের জন্য লাগে ৭ রান।বোলিং করতে এলেন গতিদানব ব্রেট লি। প্রথম বলে সিঙ্গেল , স্ট্রাইকে এলেন হল।পরের বলে মিড উইকেটের মাথার ওপর  দিয়ে চার। পুরো ওয়ান্ডারার্স আনন্দে উত্তুঙ্গ।প্রোটিয়াসরা জয়ের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু রোমাঞ্চের তখনও বাকি।পরের বলে ক্লার্কের হাতে ক্যাচ দিয়ে হল আউট।পুরো স্টেডিয়ামে পিনপতন নিরবতা।ক্রিজে এলেন শেষ  ব্যাটসম্যান   মাখায়া এনটিনি।৩ বলে ২ রান লাগে জয়ের জন্য। ৪র্থ বলে      এনটিনি সিঙ্গেলস নিয়ে স্ট্রাইক দিলেন বাউচারকে, স্কোর টাই। পুরো ওয়ান্ডারার্স তখন দাঁড়িয়ে গেছে। বাউচার আর দেরি করলেন না।পরের বলেই মিড অন দিয়ে চার।প্রোটিয়াস খেলোয়াড়দের মাঠে দৌড়ে প্রবেশ।পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে উল্লাস, আনন্দ।   দক্ষিণ আফ্রিকা ৪৩৪ রান তাড়া করে  ১ বল হাতে রেখেই ১ উইকেটে জয়ী, স্কোর ৪৩৮/৯। এক অবিশ্বাস্য  ম্যাচের সমাপ্তি।

     

     

    এই ম্যাচে যে কত রেকর্ড হয়েছে আর কত রেকর্ড ভেঙ্গেছে তার হিসাব  রাখা আসলেই মুশকিল। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল এটাই যে, অস্ট্রেলিয়ার দলীয় সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড টি টিকে ছিল মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা। এটাই বোধহয় সবচেয়ে কম সময়ে কোন রেকর্ড ভেঙ্গে যাওয়ার রেকর্ড।ম্যান অফ দা ম্যাচ হয়েছিলেন ২জন- পন্টিং আর গিবস।  দক্ষিণ আফ্রিকার এত বেধড়ক পিটুনির মধ্যেও অসি বোলার ব্র্যাকেন ১০ ওভারে  মাত্র! ৬৭ রান দিয়ে ৫টি উইকেট নিয়েছিলেন। আর আরেক বোলার মিক লুইস ১০ ওভারে ১১৩ রান দিয়ে সবচেয়ে খরুচে বোলারের রেকর্ড  গড়েন ।সেই রেকর্ড টিকে আছে আজও। আর দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেই ম্যাচটাই ছিল তার ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডে ম্যাচ।

     

     

    কিরকম বেধড়ক মার হয়েছিল সে ম্যাচে, এটা বোঝানোর জন্য এই  একটা উপাত্তই যথেষ্ট। পুরো ৯৯. ৫ ওভারে রান হয়েছিলো ৮৭২।সাথে ৮৭ টা চার আর ২৬ ছক্কা।টি  টুয়েন্টির জুগে  এই বিশ্বরেকর্ড এখনও সগর্বে বিদ্যমান।

         

     

    আজ কতদিন পার হয়ে গেছে! কিন্তু এই ম্যাচটার কথা চিন্তা করলে এখনও   গায়ের লোম  খাড়া হয়ে যায়। মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকানদের বাঁধভাঙ্গা উল্লাস,আর একই ফ্রেমে অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়দের বিস্ময়ে বিমূঢ়  বিধ্বস্ত হয়ে মাঠ ত্যাগ, এই দৃশ্যটা  আজও চোখে ভাসে।