• " />

     

    পোয়েটিক জাস্টিস কিংবা এক মহারণের গল্প

    পোয়েটিক জাস্টিস কিংবা এক মহারণের গল্প    

    প্যাভিলিয়ন আয়োজিত স্পোর্টস ফিচার লেখা প্রতিযোগিতা 'খেলার লেখা, লেখার খেলা -২' এর দশজন বিজয়ীর লেখার ধারাবাহিক প্রকাশনা শুরু হল! আজ থাকছে দশম স্থান অধিকারী নাসিফ আহমেদ-এর লেখা 'পোয়েটিক জাস্টিস কিংবা এক মহারণের গল্প'।

     

     

    ২০০০ সালের ৭ জুলাই সুইজারল্যান্ডের জুরিখে মাত্র এক ভোটের ব্যাবধানে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের গুরুদায়িত্ব পায় জার্মানি।১৯৮ টি দেশের মাঝে তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলার লড়াই অর্থাৎ বাছাই পর্ব।আয়োজক দেশ জার্মানি সরাসরি বিশ্বকাপে অংশগ্রহনের সুযোগ পায়। অবশিষ্ট ৩১টি স্থান মহাদেশীয় কনফেডারেশনগুলোর মধ্যে নির্দিষ্ট সংখ্যায় ভাগ করে দেওয়া হয়। উয়েফা (ইউরোপ) দলগুলোর জন্য ১৩টি স্থান, সিএএফ (আফ্রিকা) এর দলগুলোর জন্য ৫টি স্থান, কনমেবল (দক্ষিণ আমেরিকা) দলগুলোর জন্য ৪টি স্থান, এএফসি (এশিয়া) এর দলগুলোর জন্য ৪টি স্থান এবং কনকাকাফের (উত্তর ও মধ্য আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান) দলগুলোর জন্য ৩টি স্থান বরাদ্দ করা হয়। অবশিষ্ট ২টি স্থান নির্ধারিত হয় এএফসি ও কনকাকাফ এবং কনমেবল ও ওএফসি (ওসেনিয়া) এর মধ্যকার প্লে-অফের মাধ্যমে।

     


    ১৮ তম বিশ্বকাপ আসরের প্রারম্ভিকা হয় জার্মানিতে ৯ জুন আর তার পরিসমাপ্তি টানার তারিখ ঘোষণা হয় ৯ জুলাই।আয়োজক জার্মানি বনাম কোস্টারিকার ম্যাচ দিয়ে পর্দা ওঠে “গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ” এর।রাউন্ড রবিন পদ্ধতিতে আটটি গ্রুপের খেলা এগিয়ে যেতে থাকে।প্রতিযোগিতার প্রথম দিকে অস্ট্রেলিয়া,ইকুয়েডর,ঘানার মতো দলগুলো সাফল্য পেয়ে চমকে দিতে থাকলেও পরবর্তীতে নক-আউট পর্বে ক্ষমতাশালী দলগুলোই আধিপত্য দেখায়।পর্তুগাল ও নেদারল্যান্ডসের খেলাটি সেসময় বিশ্বকাপকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়।রুশ রেফারি ভ্যালেন্টিন ইভানোভ ঐ ম্যাচেই কেবল ২০টি কার্ড দেখিয়েছেন (১৬ টি হলুদ ও ৪ টি লাল)।ঐ ম্যাচটি ‘ব্যাটেল অফ নুরেমবার্গ’ নামে পরিচিত।কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগাল ও ইউক্রেন বাদে বাকি ৬ টি দলই ছিল সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন।তাই কোয়ার্টার ফাইনালের লড়াই যে জমজমাট হবে তা বোঝাই যাচ্ছিল।কিন্তু দুই ফুটবল পরাশক্তি ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিলে অনেকেই ধারণা করেছিলেন যে বিশ্বকাপের রঙ কিছুটা ফিকে হয়ে যাবে।কিন্তু সব ধারণা ভুল প্রমাণ করে অসাধারণ ফুটবল খেলে “অল ইউরোপিয়ান সেমিফাইনাল” এ উঠে এলো ফ্রান্স,জার্মানি,ইতালি ও পর্তুগাল।এর আগে এমনটা হয়েছিল ১৯৩৪,১৯৬৬ ও ১৯৮২ এর বিশ্বকাপে।

     


    সেমিফাইনালে পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে অসাধারণ খেলা জার্মানিকে মাটিতে নামিয়ে আনে ইটালীয় ফুটবল সৈনিকরা।৯০ মিনিট পর্যন্ত খেলা গোলশূন্য অমীমাংসিত থাকায় অতিরিক্ত সময় দেয়া হয়।আর সেই অতিরিক্ত সময়ের একদম শেষভাগে গ্রোসো ও দেল পিয়েরো দুটি গোল করে জয় ছিনিয়ে আনে।অন্যদিকে অভিজ্ঞ সেনানী জিনেদিন জিদানের পেনাল্টি থেকে দেয়া গোলে পর্তুগালকে হারিয়ে ১৯৯৮ এর পর আবার ফাইনালে ওঠে ফুটবল পরাশক্তি ফ্রান্স।বাছাইপর্বে যে দলকে একসময় ধুঁকতে হয়েছিল,যে দলকে বিশ্বকাপে নেয়ার জন্য অবসর ভেঙ্গে বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখিয়েছেন জিদান সেই দলই অবশেষে চলে গেল ২০০৬ বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে।

     


    পোয়েটিক জাস্টিস?

     


    মঞ্চ প্রস্তুত,প্রস্তুত বিধাতার হাতে লেখা নাটকীয় স্ক্রিপ্ট।অবসর ভেঙ্গে ফিরে আসা জিনেদিন জিদানকে বিদায় জানানোর জন্য বিশ্বকাপও কি প্রস্তুত নয়?পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলা ইতালির ডিফেন্স কি পারবে জিনেদিন জিদানকে রুখে দিতে?ফুটবল বিশেষজ্ঞরা তখন চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যস্ত।সবার চোখেই ফ্রান্স ফাইনালের হট ফেভারিট।

     


    ৯ জুলাই,২০০৬; ওলিম্পিয়াস্তাদিয়নে ৬৯,০০০ এর বেশি দর্শক উপস্থিত তখন ফাইনালের মহারণ দেখার আশায়।আর টিভি স্ক্রিনের সামনেও সেদিন বসে আছে রেকর্ড ৭১৫.১ মিলিয়ন দর্শক।আর্জেন্টিনার ওরাসিও এলিজান্দোর বাঁশি বাজার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় ফ্রান্স বনাম ইতালির ধ্রুপদী লড়াই।খেলা শুরুর ৭ মিনিটের মাথায়ই আবার এলিজান্দোর বাঁশি।কারণ কি?বিতর্কিত একটি পেনাল্টির ঘোষণা।ইতালির ফুটবলাররা তখন স্তব্ধ।জিনেদিন জিদান এগিয়ে আসলেন পেনাল্টি নেয়ার জন্য।নার্ভাস শট ক্রসবারে লেগেও সে বিশ্বকাপের সেরা গোলকিপার বুফনকে ফাঁকি দিয়ে বল জালে জড়িয়ে যায়।ফ্রান্স ১-ইতালি ০।জিদানের স্বপ্নালু চোখে তখন যেন সোনায় মোড়ানো বিশ্বকাপ ট্রফিই ভাসছে।মরিয়া হয়ে ওঠে ইতালি গোল পরিশোধের জন্য।সুযোগ পেয়েও যায় তারা ১৯ মিনিটেই।তরুণ মিডফিল্ডার আন্দ্রেই পিরলোর নেয়া কর্নার থেকে মার্কো মাতেরাজ্জি গোলপোস্টের ৬ ফুট দূর থেকে লাফিয়ে হেড করে বল পাঠিয়ে দেয় ফ্রান্সের জালে।খেলায় সমতা ফিরে আসলো,উত্তেজনায় কাঁপছে গোটা বিশ্ব।এরপর আক্রমণ,প্রতি-আক্রমণে খেলা জমে ওঠে।ইতালির লুকা টনির শট একবার গোলবারে লেগে ফিরে আসে তো পেনাল্টি বক্সের মধ্যে ফ্রান্সের মালুদাকে ট্যাকেল করা সত্ত্বেও পেনাল্টি বঞ্চিত হয় ফ্রান্স।নির্ধারিত সময়ের খেলা তখন শেষের পথে।ইতালির জমাট ডিফেন্সে বারবার বাঁধা পড়ে যাচ্ছিল মালুদা,অরি,জিদানরা।অবশেষে নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ হয়ে যায় এবং খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।সবার মাঝেই চাপা উৎকণ্ঠা,কি হবে আজ?কে জিতবে?অতিরিক্ত সময়ের খেলা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ফ্রান্স অ্যাটাকিং খেলা শুরু করে দেয়,জিদানের একটি দুর্দান্ত হেড আলতো টোকায় গোলবারের বাইরে পাঠিয়ে দেন ইতালির অতন্দ্র প্রহরী জিয়ানলুইজি বুফন।পোয়েটিক জাস্টিস করার দায়িত্ব যেন জিদান নিজের কাঁধেই নিয়েছেন,তাকে সামলাতে বেগ পেতে হচ্ছিল ইতালির ডিফেন্ডারদের।সবাই প্রায় নিশ্চিত জিদান আজ জিতিয়েই ছাড়বেন ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ।কিন্তু এরপর যা হল তা যেন হলিউডের থ্রিলিং মুভিকেও হার মানায়।ফুটবল বিধাতা অন্য কিছু ভেবে রেখেছিলেন হয়তো।



    আর্জেন্টাইন রেফারি ওরাসিও এলোজান্দো দেখলেন ইতালির মার্কো মাতেরাজ্জি বুকে হাত দিয়ে মাটিতে পড়ে আছে আর কিছুদূরেই জিনেদিন জিদান দাঁড়িয়ে।তিনি বুঝতে পারলেন না কি হলো হঠাৎ?বার্লিনের  ওলিম্পিয়াস্তাদিয়ন স্টেডিয়াম তখন গগনবিদারী চিৎকারে ফেটে পড়ছে।হতবিহ্বল এলোজান্দোর ওপর তখন পর্বতসম চাপ।তিনি দেখলেন ইতালির খেলোয়াড়রা তার দিকে ধেয়ে আসছে।তারা ন্যায়বিচার চায় কিন্তু তিনি তো ঠিকমতো ঘটনাটি দেখতেই পারেন নি।কি করেছেন জিনেদিন জিদান?এলোজান্দো বারবার হেডসেটে চতুর্থ অফিশিয়াল লুইস মেদিনা কান্তালেহোর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন ।২০০৬ সালের ৯ জুলাই,এক্সট্রা টাইমের ২০ মিনিটের খেলা চলছে তখন,ইতালি বনাম ফ্রান্স বিশ্বকাপ ফুটবল ফাইনালের।

     


    কান্তালেহোর কাছ থেকে এলোজান্দো জানতে পারলেন যে সময়ের সেরা ফুটবলার এবং নিপাট একজন ভদ্রলোক জিনেদিন জিদান ইতালির ডিফেন্ডার মার্কো মাতেরাজ্জির বুকে মাথা দিয়ে ‘ঢুস’ মেরেছেন।এলোজান্দো যেন তার কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।অতিরিক্ত সময়ের মাত্র ১০ মিনিট বাকি,তিনি জানতেন তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটি আজ নিতে হবে তাকে।তিনি জিদানের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং বুকপকেট থেকে লাল কার্ড বের করে দেখালেন।

     

     

    পুরো স্টেডিয়াম,টিভিসেটের সামনে বসা মানুষ সবাই তখন স্তব্ধ।কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না যে নিজের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচে জিদান লাল কার্ড দেখে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন।মাঠ থেকে যাওয়ার সময় কয়েক হাত দূরত্বেই ছিল বিশ্বকাপের সেই ট্রফিটি,কিন্তু জিদান চোখ তুলে তাকাতেও পারলেন না যেন।ফুটবলের এই গুণী শিল্পিকে মাথা নিচু করেই বিদায় নিতে হল আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে।

     

     

     


    জিদান লাল কার্ড দেখার পর বাকি ১০ মিনিটে আর কোন গোল হলো না তাই খেলা গড়ালো পেনাল্টি শুটআউটে।সেখানে ইতালির পিরলো,মাতেরাজ্জি,ডি রসি,দেল পিয়েরো এবং গ্রোসো ৫ টি শটের ৫ টি তেই গোল করতে সমর্থ হন কিন্তু ফ্রান্সের ত্রেজেগে দ্বিতীয় পেনাল্টি শুটটি মিস করায় ৫-৩ গোলে বিশ্বকাপ জিতে নেয় ইতালি।অসাধারণ ডিফেন্স এবং কার্যকরী অ্যাটাক নিয়ে সাজানো ইতালি জয় করে নেয় ২০০৬ ফুটবল বিশ্বকাপ।আর সেদিনই পরিসমাপ্তি ঘটে এক মহানায়কের ফুটবলীয় উত্থান অধ্যায়ের।এটা কেউই বলতে পারবে না যে ২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনাল জিদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে নাকি ইতালির পুনঃউত্থানের জন্য।তবে ২০০৬ ফুটবল বিশ্বকাপ যে সব ফুটবলপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে চিরভাস্মর হয়ে আছে এবং থাকবে তা বিনা দ্বিধায়ই বলে দেয়া যায়।