• " />

     

    সুন্দর ফুটবলের জয়

    সুন্দর ফুটবলের জয়    

    প্যাভিলিয়ন আয়োজিত স্পোর্টস ফিচার লেখা প্রতিযোগিতা 'খেলার লেখা, লেখার খেলা -' এর দশজন বিজয়ীর লেখা ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে! আজ থাকছে নবম স্থান অধিকারী রজত দাশগুপ্ত-এর লেখা 'সুন্দর ফুটবলের জয়'।



    যতদূর স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে ১৯৯৮ সালেই প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল দেখেছিলাম। তখন ক্লাস থ্রিতে পড়তাম। ১৯৯৪ সালের কথা মনে নেই। তখন থেকেই ব্রাজিলের সমর্থক। আসলে শৈল্পিক ফুটবল দেখেই ব্রাজিলকে ভালোবাসি। ১৯৯৮ সালের মিশন শেষ হয় ফাইনালের ট্র্যাজেডিতে। ফ্রান্সের কাছে হারার পর তখন এমন আচরণ করেছিলাম বাসার সবাই বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমার বাবা অনেক রাগী। আমাকে অনেক মেরেছিলেন সেদিন

    যাই হোক চার বছর পর এল ২০০২ এর বিশ্বকাপ। বাছাই পর্বে ব্রাজিল এক কথায় জঘন্য খেললো। চিলির কাছে - গোলে হেরেছিল। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে তৃতীয় হয়ে চূড়ান্ত পর্বে স্থান করে নিল ব্রাজিল। বরং সেই পর্বে আর্জেন্টিনা ভালো খেলেছিল। তারাই ছিল ফেভারিট।

    ৩১ মে,২০০২। মাঠে গড়ালো এশিয়ার মাটিতে অনুষ্ঠিত প্রথম ফিফা বিশ্বকাপ। অভিষেকেই নবাগত সেনেগালের চমকে ধরাশায়ী হল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। আর্জেন্টিনা বিদায় নিল মৃত্যু উপত্যকা থেকে প্রথম পর্বেই। ব্রাজিল গ্রুপ পর্বে দাপটের সাথে খেলেই দ্বিতীয় পর্বে উঠলো। একে একে বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড এবং তুরস্ককে হারিয়ে ফাইনালে উঠলো ব্রাজিল। প্রতিপক্ষ ইউরোপের গতির ফুটবলের রাজা জার্মানি। অলিভার কানকে এমনিতেই ভয় পেতাম। গোলবারের সামনে দাঁড়ানো এক অতন্দ্র প্রহরী।

    অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ৩০ জুন,২০০২। জাপানের ইয়োকোহামা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইতে নামলো ব্রাজিল এবং জার্মানি। সেদিন ঢাকাতে বৃষ্টি নেমেছিল আকাশ ভেঙ্গে। স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়েছিল। বৃষ্টিতে ভিজে, কাদাপানি পেড়িয়ে বাসায় এসেছিলাম শুধু খেলা দেখব বলে। বাসায় চিপস আর সূপের ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছিলেন মা খেলা উপলক্ষে। সেইগুলো নিয়ে বসলাম টেলিভিশনের সামনে।

    টেকোমাথার রেফারি কলিনার বাঁশির মাধ্যমে শুরু হল খেলা। মনে পড়ে জার্মানি -- এবং ব্রাজিল -- ছকে খেলেছিল।  শুরুতেই কর্ণার পেয়ে গিয়েছিল ব্রাজিল। কিন্তু কাজে লাগাতে পারেনি। প্রথম অর্ধ গোলশূন্যই থাকে খেলা। মাঝে উত্তেজনাকর কিছু মুহূর্ত যায়। যেমন একবার অলিভার কানকে একা পেয়েও ব্যর্থ হন রোনালডো। অলিভার কান কিছু অমানুষিক সেইভ করেন। ক্লেভারসন এক অসাধারণ সুযোগ পোস্টের পাশ দিয়ে বাইরে পাঠান। আরেকবার দুর্ভাগ্যজনকভাবে উপরের বারে লেগে বল ফিরে আসে। বলের দখল কিন্তু জার্মানদের পায়েই বেশি থাকে। কিন্তু তারা তেমন কোন সুযোগ তৈরি করতে পারে নি।

    বিরতির সময় ভাবলাম কি হবে পরের অর্ধে। ব্রাজিল কি পঞ্চম শিরোপার স্বাদ পাবে নাকি জার্মানরা চতুর্থ শিরোপা ঘরে তুলবে? বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। আশ্চর্য নীরবতা। কিন্তু মনের ভিতর টেনশন। রক্তে বয়ে চলেছে অ্যাড্রেনালিনের স্রোত। বয়স তখন কম। আর্জেন্টিনার সমর্থকদের তো পচিয়েছি। আজ ব্রাজিল হারলে তাদের জ্বালায় আগামী সাতদিন ক্লাসে যেতে পারব না। ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য হলেও ব্রাজিলকে জিততে হবে।

    এই যখন ভাবছি দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু হল এবং শুরুতেই জার্মানি সুযোগ পেল। কিন্তু জেরেমিসের হেড কি অদ্ভুত কারণে গতি হারিয়ে ফেলল। কিছুক্ষণ পরেই নয়ভিলের ৩০/৩৫ গজ দূরের ফ্রি কিক শট বারে লেগে ফিরে এল। জার্মানরা যেন ব্রাজিলের পোস্টের নিশানা খুঁজে পাচ্ছিল ধীরে ধীরে। কি ঘটতে চলেছে তাহলে? দুঃস্বপ্ন কি সত্য হয়ে আসবে?

    ৬৭ মিনিটে ব্রাজিলিয়ান সমন্বিত আক্রমণ জার্মান রক্ষণ ভেদ করে ঢুকে পড়ে।  রোনালডোর কাছ থেকে রিভালডো পাস পেয়ে ২৫ গজ থেকে এক শট মারেন জার্মান গোলমুখ অভিমুখে। অলিভার কান সেটাকে রুখতে পারেন কিন্তু বল ধরে রাখতে পারলেন না। হাত থেকে বল ছুটে গেল। এদিকে বিদ্যুৎবেগে জার্মান ডি বক্সে ঢুকে পড়েন রোনালডো।

    সময় যেন থমকে গিয়েছে। অলিভার কান পুরো বিশ্বকাপে দৃষ্টিনন্দন সেভ করেছিলেন। কিন্তু দি ফেনোমেননকে ঠেকানোর সামর্থ্য তার ছিল না। সারা বিশ্বের শত কোটি দর্শক দেখল জার্মান জালে ব্রাজিলের প্রথম গোল।

     


    সারা স্টেডিয়াম এবং টেলিভিশন পর্দার সামনে বসে থাকা কোটি কোটি মানুষ আনন্দে ফেটে পড়ে। ব্রাজিল জার্মানি ০। গল্পের শেষ এখানে নয়।

    ১২ মিনিট পর কাফুর পায়ে বল। এই কাফু পরপর তিন বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলার বিরল অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত। ব্রাজিলিয়ান অধিনায়ক বল দিলেন ক্লেভারসনকে। ক্লেভারসন জার্মান ডি বক্সের সামনে রিভালডোকে বল পাস দিলেন। কিন্তু একি!! রিভালডোর ডামিতে ফাঁদে পড়ল জার্মান রক্ষণ। বল চলে গেল দি ফেনোমেননের পায়েকামানের গোলার মত শট-অলিভার কান ভূপাতিত-গো গো গো  !!!!!!!!!!!!!!
    ব্রাজিল জার্মানি ০। এর পর এগারো মিনিট পার হলেই হয়। তাহলে পেন্টার স্বপ্ন পূর্ণ হবে। বাবা বললেন, “এখনও শেষ হয়ে যায় নি সব। এটা জার্মানি।

     

    বাবা একবার বলেছিলেন ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের সেমি ফাইনাল। পশ্চিম জার্মানি বনাম ফ্রান্সের সেই সেভিলের রাতের কথা। তখন আমার জন্মও হয় নাই। লিটবারস্কির গোলে ১৭ মিনিটে এগিয়ে যায় পশ্চিম জার্মানি। ১০ মিনিটের ভিতর প্লাতিনির পেনাল্টিতে সমতায় ফিরে ফ্রান্স। নির্ধারিত সময়ে অনেক নাটকের পর অমীমাংসিত থাকে খেলার ফলাফল।  অতিরিক্ত সময়ের মিনিটের মাথায় ফ্রান্স এগিয়ে যায় ট্রেসরের গোলে। মিনিট পরে গিরেসের গোলে - গোলে এগিয়ে যায় ফ্রান্স। অতিরিক্ত সময়ের ১২ মিনিটে রুম্মেনিজ্ঞের গোলে - করে ফেলে পশ্চিম জার্মানি। অতিরিক্ত সময়ের ১৮ মিনিটে ফিস্কারের গোলে - সমতা হয়। খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে - গোলে জিতে ফাইনালে চলে যায় পশ্চিম জার্মানি।


    এই জার্মানি অনেক কিছুই করতে পারে। মাঝে বিয়েরহফের শট মার্কোস অসাধারণভাবে বাঁচিয়ে দিলেন।

    নিজের হৃদযন্ত্রের আওয়াজ নিজেই শুনতে পাচ্ছি।

    ৯০ মিনিট চলে যাওয়ার পর বলছিলাম রেফারি বাঁশি বাজায় না কেন?

    মিনিট

    মিনিট

    মিনিট

    আহ কি মধুর বাঁশির আওয়াজ।

    এবং এটা বাস্তব। ব্রাজিল পেন্টা জিতেছে। আমাকে আর পায় কে? নিচে নেমে গেলাম এলাকার বন্ধু বান্ধবদের সাথে। বছর আগের সেই দুঃস্বপ্নকে চাপা দিয়ে রোনালডোর পুনর্জন্ম দেখল বিশ্ববাসী দেখল সুন্দর ফুটবলের জয়।

    কাফুর হাতে বিশ্বকাপ সাথে পুস্পবৃষ্টি। মনে হল দেবতারা যেন স্বর্গ থেকে আশীর্বাদ করছেন জোগো বনিতোর শিল্পীদের। আজ অবসরে সেই দিনগুলোর কথা ভাবি। এই স্মৃতিগুলোই দেয় চলার পথের প্রেরণা।