একটি গোল ও একজন যাদুকরের আগমনধ্বনি

প্যাভিলিয়ন আয়োজিত স্পোর্টস ফিচার লেখা প্রতিযোগিতা 'খেলার লেখা, লেখার খেলা -২' এর দশজন বিজয়ীর লেখা ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে! আজ থাকছে অষ্টম স্থান অধিকারী মিশু কাজী-এর লেখা 'একটি গোল ও একজন যাদুকরের আগমনধ্বনি'।
ফুটবলের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ দিয়ে, যেটার ফাইনালে প্রিয় দল ব্রাজিলের অভাবনীয় পরাজয়ে শোকস্তব্ধ হয়ে যাওয়ার স্মৃতি এখনো নাড়া দেয়। এর পরে গত এক যুগেরও বেশি সময়ে আরও তিনটি ফুটবল বিশ্বকাপের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচই টেলিভিশনের পর্দায় চাক্ষুষ করার সুযোগ হয়েছে। তবে একটা ম্যাচ নানা কারণে এর মধ্যে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে মানসপটে। আজ সেটাই খানিক রোমন্থনের চেষ্টা করছি।
প্রেক্ষাপট বিশ্বকাপ ২০০২ কোয়ার্টার ফাইনাল। জাপানের শিজুকা স্টেডিয়ামে সেমিফাইনালের টিকিট পেতে মুখোমুখি তৎকালীন (এবং এখনকারও) দুই ফুটবল পরাশক্তি ব্রাজিল ও ইংল্যান্ড। যতদূর মনে পড়ে, দিনটা ছিলো শুক্রবার আর খেলাটা দুপুরে কোন এক সময়ে শুরু হয়েছিলো- জুম্মার নামাজ পড়ে এসেই ছুট দিয়েছিলাম টিভির সামনে! নীল জার্সিতে ব্রাজিল দলকে একটু অন্যরকম ঠেকলেও জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় রোনালদো, কাফু, রবার্তো কার্লোসদের প্রত্যয়ী মুখগুলো ভরসাই দিচ্ছিলো। অন্যদিকে বেকহ্যাম, স্কোলস, ওয়েনদের নিয়ে গড়া ‘থ্রি লায়নস’ প্রস্তুত নিজেদের দ্বিতীয় শিরোপার পথে আরেক ধাপ অগ্রসর হতে। জম্পেশ একটা আবহে আব্বুর সাথে দুপুরের খাবার খেতে খেতে খেলা দেখা শুরু করলাম।
[বর্ণনার সুবিধার্থে লেখার পরবর্তী অংশটুকু বর্তমান কালে লিখছি]
সুইডিশ ম্যানেজার সভেন গোরান এরিকসন ইংল্যান্ডের প্রথাগত ৪-৪-২ ফর্মেশনে একাদশ সাজিয়েছেন। গোলবারে সিম্যান; রক্ষণে মিলস, ফার্দিনান্দ, ক্যাম্পবেল, কোল; মাঝমাঠে অধিনায়ক বেকহ্যাম, বাট, কোল, সিনক্লেয়ার; আর আক্রমণভাগে রয়েছেন ওয়েন ও হেসকি। অন্যদিকে ব্রাজিলিয়ান ম্যানেজার ‘বিগ ফিল’ লুই ফিলিপ স্কলারি ব্রাজিলের ছক কষেছেন একটু অন্যভাবেঃ ৫-৪-১ ফর্মেশনে, যেটাকে বিস্তৃত করলে (৩-২)-(২-২)-১ এ দাঁড়ায়। কিপিং এর দায়িত্বে মার্কোস; সেন্ট্রাল ডিফেন্সে রয়েছেন লুসিও, এডমিলসন, রক জুনিয়র; উইং ব্যাকে অধিনায়ক কাফু ও রবার্তো কার্লোস; সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে ক্লেবারসন ও জিলবার্তো সিলভা; অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে রোনালদিনহো ও রিভালদো এং সেন্ট্রাল ফরোয়ার্ডে খেলছেন রোনালদো দ্যা লিমা। দুই একাদশ দেখে যা বোঝা গেল তা হলো মূলতঃ ব্রাজিলের মাঝমাঠ দিয়ে আক্রমণের জবাব ইংল্যান্ডের উইং ভিত্তিক প্রতিআক্রমণ দ্বারা দিতে চেয়েছে।
খেলা আরম্ভ হলো। শুরু থেকেই একের পর এক আক্রমণে ইংল্যান্ডের রক্ষণ দুর্গ কাঁপিয়ে দিতে লাগলো ব্রাজিলের আক্রমণভাগ। ক্ল্রেবারসন ও সিলভার সাথে রোনালদিনহোর ত্রয়ী মাঝমাঠে প্রায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য এনে দিচ্ছিলো সেলেকাওদের। কিন্তু ক্যাম্পবেল, ফার্দিনান্দদের দৃঢ়তা আর ঐ দিন রোনালদোর কিছুটা নিষ্প্রভ পারফরম্যান্সের কারণে কিছুতেই ফাইনাল টাচ দিতে পারছিলোনা তারা। উল্টো ২৩ মিনিটের মাথায় সেন্টারের কিছু সামনে থেকে হেসকির বাড়ানো বল লুসিওর ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ হন। সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে ভুল করেননি তখনকার ব্যালন ডি অর জয়ী স্ট্রাইকার মাইকেল ওয়েন। ঠাণ্ডা মাথার ফিনিশিং এ স্রোতের বিপরীতে ইংল্যান্ডে এনে দেন ০-১ গোলের লিড। তখন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ার অবস্থা আমার। আরেকবার বিশ্বকাপ থেকে প্রিয় দলের খালি হাতে ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা পেয়ে বসলো, তবে এও বিশ্বাস ছিলো যে ব্রাজিল ঠিকই ফিরে আসার সক্ষমতা রাখে।
গোল খেয়ে ব্রাজিলের খেলার গতি যেন আরও বেড়ে গেলো। কিন্ত কাজের কাজটা কিছুতেই হচ্ছে না। রিভালদোর তীব্র শট ফিরে ঠেকিয়ে দেন ইংলিশ গোলরক্ষক, কার্লোসের দূরপাল্লার শট সাইড বারে লেগে প্রতিহত হয়। সময় গড়াচ্ছে, প্রথম ৪৫ মিনিটের প্রায় শেষে এসে গেছে খেলা, ঠিক তখনই হলো এ খেলাকে নিয়ে আমার প্রথম স্মরণীয় মুহূর্তের অবতারণা।
রক জুনিয়রের ক্লিয়ার করা বলের দখল নেন রোনালদিনহো। অতঃপর নিজেদের অর্ধের শেষ ভাগ থেকে পেয়ে একে একে তিন ইংলিশ খেলোয়াড়কে মোহনীয় সলো রান ও ড্রিবলের মাধ্যমে ছিটকে ফেলে একদম ডি বক্সে পৌঁছে ডান পাশে ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা রিভালদোকে পাস দেন তিনি। সামনের একমাত্র বাধা গোলরক্ষককে পরাস্ত করতে ভুল করেননি ১১ নং জার্সিধারী তৎকালীন সময়ের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার। গোল! ইংল্যান্ড ১-১ ব্রাজিল। ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এলো!
এর মধ্যে বিরতির বাঁশি বাজিয়ে দিলেন রেফারী। টিভি পর্দায় ইংল্যান্ড দলকে কিছুটা হতাশ দেখাচ্ছে লিড ধরে রাখতে পারার ব্যর্থতায়, আর উল্টো চিত্র ব্রাজিলিয়ান ডাগআউটে।
অনেকটাই স্বস্তি নিয়ে শেষ ৪৫ মিনিটের খেলা দেখা শুরু করলাম। ৪৯ মিনিটের মাথায় স্কোলস ক্লেবারসনকে ফাউল করায় গোললাইন থেকে ৩৫ মিটার দূরে ফ্রি-কিক পায় ব্রাজিল। মোটামুটি প্রস্তুত ছিলাম সর্বকালের অন্যতম সেরা ফ্রি-কিক স্পেশালিষ্ট রবার্তো কার্লোসকে কিক নিতে দেখার। কিন্তু এই ম্যাচ তো আরেকজন ‘স্পেশাল’ এর আগমনী বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে! তাই যখন রোনালদিনহোকে ফ্রি-কিকটা নিতে এগিয়ে আসতে দেখি তখন একটু অবাকই হলাম, হয়তো অবাক হয়েছিলো ইংলিশ ডিফেন্সও। তারপরই এলো সেই যাদুকরী ক্ষণ!
দেখলাম রোনালদিনহো ডি বক্সে থাকা সতীর্থ খেলোয়াড়দের মাথার জটলায় বলটা না পাঠিয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি জোরের সাথেই কিক নিলেন গোলপোস্ট লক্ষ্য করে। ইংলিশ ক্লাব আর্সেনালের দুঁদে গোলরক্ষক ডেভিড সিম্যান হতবাক হয়ে দেখলেন, নিমেষের মধ্যে তার মাথার উপর দিয়ে বলটা উড়ে গিয়ে ক্রসবারের ভেতরের অংশে লাগলো এবং গোললাইন অতিক্রম করলো!
অবিশ্বাস্য! অভূতপূর্ব! পুরো স্টেডিয়াম বিস্ময়ের সাথে দেখলো ঝাঁকড়া চুলের সদা হাস্যময় এক তরুণ পাগলের মত ছুটে যাচ্ছে মাঠের এক কোণায়, জুড়ে দিচ্ছে উন্মাতাল নাচ- তার আনন্দে সঙ্গ দিতে ছুটে আসছে কাফু, রোনালদো, এডমিলসনরা। আমার এখনো মনে পড়ে ইংল্যান্ডের কোচের নির্বাক হয়ে কয়েক ঢোক পানি খাওয়ার দৃশ্যটা। ব্রাজিল ২-১ ইংল্যান্ড!
দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে এই গোলের মিনিট সাতেক পরে রেফারীর বিতর্কিত সিদ্ধান্তে সরাসরি লাল কার্ড দেখে মাঠের বাইরে চলে যেতে হয় ম্যাচের এই সেরা খেলোয়াড়টিকে। ১০ জনের ব্রাজিল দলকে চেপে ধরে শেষ ৩০ মিনিট গোলশোধের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে ইংল্যান্ড। কিন্তু এবার রক্ষণ দুর্গের দৃঢ়তা দেখালো কাফু এন্ড কোং। ফলে খেলা শেষের বাঁশি বাজার শেষে আরও একবার ব্যর্থ ইংল্যান্ড ফুটবল দল, আর দশম বারের মত বিশ্বকাপ ফুটবলের সেমিফাইনালে পৌঁছে যায় ব্রাজিল- যেটাকে শেষ পর্যন্ত তারা তাদের ৫ম শিরোপা সাফল্যে রূপ দিতে সমর্থ হয়েছিলো!
ফুটবলে দর্শনীয় গোলের আনন্দ, দুর্দান্ত সেভের আনন্দ, শেষ মুহূর্তের গোলে জয়ের আনন্দ আগে কমবেশি পেয়েছিলাম, কিন্তু ফুটবল দিয়ে যে সবুজ মাঠে ছবি আঁকা যায় তা প্রথম দেখলাম রোনালদিনহোর পায়ে! তৎকালীন সময়ে ফ্রেঞ্চ ক্লাব পিএসজিতে খেলা এই মিডফিল্ডার যে একসময় বিশ্বশাসন করবেন তার আগমনী বার্তা ছিলো এই ম্যাচটি। পরবর্তীতে স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনার হয়ে সমস্ত ফুটবল বিশ্বকে একটা লম্বা সময় ধরে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখা এই ব্রাজিলিয়ান যাদুকর এখন পর্যন্ত আমার দেখা শ্রেষ্ঠ ফুটবল ট্যাকটিশিয়ান। আর বিশ্বকাপের এই ম্যাচটি আমার স্মৃতিতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে তার এই কিছু অভাবনীয় মুহূর্ত সৃষ্টির কৃতিত্বের ফলে!