• " />

     

    ব্রাজিলের স্বপ্নভঙ্গঃ ফ্রান্স ১৯৯৮

    ব্রাজিলের স্বপ্নভঙ্গঃ ফ্রান্স ১৯৯৮    

    প্যাভিলিয়ন আয়োজিত স্পোর্টস ফিচার লেখা প্রতিযোগিতা 'খেলার লেখা, লেখার খেলা -২' এর দশজন বিজয়ীর লেখা ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে! আজ থাকছে ষষ্ঠ স্থান অধিকারী ধ্রুব আলম-এর লেখা 'ব্রাজিলের স্বপ্নভঙ্গঃ ফ্রান্স ১৯৯৮'


     

    সালটা ১৯৯৮, ষোড়শ বিশ্বকাপের আসর বসেছে ফিফার জন্মভূমি ফ্রান্সে। পড়ি ক্লাস সিক্সে, ১৯৯৪-এর খেলা দেখে আর পেলের গল্প শুনে, সমর্থন দেই ব্রাজিল। বড় হয়েছি পুরনো ঢাকায়, একান্নবর্তী পরিবার, বাবা-চাচা সব মিলে, রাত জেগে খেলা দেখি। এক একজনের এক এক দল পছন্দ। সব খেলাই প্রায় দেখা হয়, ব্রাজিলের সমর্থক হয়েও ভক্ত হয়ে গেলাম জিদানের। তার উপরে বাবা-চাচা অ্যাঁলিয়াস ফঁসেতে ফ্রেঞ্চ শিখে প্যারিস ঘুরে আসা পাড় সমর্থক। আরেকজন জার্মান শিখে মিউনিখ বাস করে আসা ঘোর জার্মানভক্ত।

    এর মধ্যে চাচার অ্যাঁলিয়াস ফঁসেতে চাকুরির সুবাদে জানলাম, ন্যাশনাল স্পোর্টস কাউন্সিলের জিমনেসিয়ামে বড় পর্দায় ফ্রান্সের সব খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করেছে, ফ্রেঞ্চ অ্যাম্বেসি ও অ্যাঁলিয়াস ফঁসে। টিকিট ছিলো কি ছিলো না, মনে নেই, শুরু হলো মাঝরাতে দল বেঁধে খেলা দেখতে যাওয়া (জার্মান চাচা বাদে, ফ্রান্স নিয়ে এই আদেখলামি তার মোটেই পছন্দ না!)। যোগাড় হলো পতাকা, জার্সি। এত রাতে নতুন গাড়ি চালাতে শেখা, এলাকার এক ঘনিষ্ঠ বড় ভাই, কাঁপা কাঁপা হাতে আমাদের নিয়ে যেত, আবার কখনো রিকশায় যেতাম।

    প্যারাগুয়ের সাথে বিচ্ছিরি খেলে ২য় পর্ব কোনমতে পার করলো ফ্রান্স, টান টান উত্তেজনার এক ম্যাচ (কোয়ার্টার ফাইনাল) জিতলো ইতালির সাথে পেনাল্টিতে। আসলো সেমি-ফাইনাল, ততদিনে বড় পর্দায় খেলা দেখা আর স্টেডিয়ামের আমেজের লোভে, জিদানের জাদুতে মুগ্ধ, বাঙালি ‘ছবির দেশে, কবিতার দেশে’র প্রেমে পড়ে গেছে। ক্রোয়েশিয়ার সাথে খেলার রাতে দেখলাম পতাকা হাতে আমরা আর অল্প ক’জন একা নই, আরো অনেক মানুষে জিমনিসেয়াম ভরে গেলো। সবার মনে হচ্ছে, ফ্রান্স আজ জিতবেই!

    খেলা কিন্তু মোটেই একপেশে হলো না, উল্টো মনে হলো, ক্রোয়েশিয়া তাদের স্বপ্নের মত বিশ্বকাপের ফাইনালে গিয়েই ছাড়বে। ডেভর সুকার গোলও দিয়ে ফেললো একটা, অবশ্য প্রায় সাথে সাথেই জীবনের ১ম গোল দিয়ে সমতা আনলো লিলিয়ান থুরাম। আরো প্রায় ২০ মিনিট পর সেই থুরাম আরেকটা গোল দিয়ে দিল। আমার মনে হলো, আমি যেন স্টেডিয়ামেই বসে আছি! আমাদের সাথে বাংলাদেশে বসবাসকারী ফ্রেঞ্চরাও খেলা দেখতো, তারা পাগলের মত লাফাচ্ছে, ‘ভিভা লা ফঁসে’ বলে চেঁচাচ্ছে, কেউবা জামা খুলে মাথার উপরে ঘুরাচ্ছে! আমার চাচা কারো থেকে একটা ফ্রান্সের পতাকা মেরে দিয়ে দৌড়াচ্ছে, বাপ লাফাচ্ছে! ফ্রান্স যেন বিশ্বকাপ জিতেই গেলো, এখনই!

    কিন্তু, আমি ব্রাজিলের সমর্থক হয়েও এতক্ষণ তো তাদের নিয়ে কিছুই লিখলাম না! লেখার কি আছে? ব্রাজিল তো বিশ্বকাপ জিতেই আছে, আবারো জিতবেই। ২১ বছরেই বিশ্বের সেরা হয়ে যাওয়া রোনাল্ডো আছে তাদের, কোচ মারিও জাগালো, আরেক সবচেয়ে দামী খেলোয়াড় ডেনিলসনের দলে জায়গা হয়না, বদলী হিসেবে নামে, রোমারিওকে তারা দেশে ফেলে আসতে পারে। রিভালদো, রবার্তো কার্লোস, বেবেতো, দুঙ্গা, কাফু, লিওনার্দো, কাকে ছেড়ে কাকে রাখি!

    একেবারে হেলেদুলে, হাসতে হাসতে বা হেলায় সবাইকে হারিয়ে ব্রাজিল অবশ্য ফাইনালে উঠেনি। নরওয়ের কাছে হেরে গেল গ্রুপ পর্বেই, ২য় পর্বে চিলিকে উড়িয়ে দিলেও, ডেনমার্ক আর হল্যান্ডকে হারাতে ভালই বেগ পেতে হলো। কিন্তু, এই ব্রাজিল যেন নিজের রক্ষণভাগকে সামলাতে মোটেই আগ্রহী না। যেন ভাবছে, কি দরকার? বিশ্বের সব সেরা মিডফিল্ডার আর স্ট্রাইকার তাদেরই, গোল ২টা খেলে, ৫টা দিয়ে দিবে। রক্ষণে তাকানোর সময় কই?

    ওদিকে আমরা অবাক হয়েই দেখলাম, নতুন প্রিয় হয়ে ওঠা ফ্রান্স আর জিদানই ফাইনালে ব্রাজিল আর রোনাল্ডোর প্রতিপক্ষ। ফাইনালের দিন সকাল থেকে প্রতীক্ষা, কখন রাত হবে। সন্ধ্যা হতেই পতাকা নিয়ে, গালে এঁকে প্রস্তুত সবাই। চাচাতো, ফুফাতো, পাড়াতো সব ভাইয়েরা দল বেঁধে দিলাম রওনা, পথে অনেকের সাথেই দেখা হয়ে যাচ্ছে, সবারই এমন ভাব, কাপটা তো জিতেই গেছি, তাও সমর্থন না দিলে খারাপ দেখায়, সেজন্যে যাচ্ছি আরকি! আমার বাপ আর সেই চাচা একখান ফ্রান্সের পতাকা নিয়ে যাচ্ছে আমাদের সাথে আর বলছে, খেলা এখনো শুরু হয়নি, দেখ কি হয়, ফ্রান্স জিতেও যেতে পারে। আমাদের সে নিয়ে কি হাসাহাসি, তারা হাড়ির মত মুখ করে রাখলো! কিছু করার নেই, দুর্বল দল সমর্থন দিলে, দু-একটা কথা শুনতেই হয়!

    জিমনেসিয়ামে গিয়ে দেখি রিকি মার্টিনের ‘কাপ অফ লাইফ’ বাজছে, নির্ঘাত খান পঞ্চাশেক ব্রাজিলের পতাকা উড়ছে, সবাই লাফাচ্ছে, গান গাইছে, সাথে নাচছে। বেচারা ফ্রেঞ্চরা এক কোনে বসে বিমর্ষ মুখে দেখছে আর মনে হয় ভাবছে, দুদিন আগেই না এরা ফ্রান্স সমর্থন দিচ্ছিলো? 

    খেলা শুরুর ৫ মিনিটের মধ্যেই কেন জানি মনে হতে লাগলো, এই ব্রাজিল সেই ব্রাজিল না। ঘটনা কি? বল থাকছে না পায়ে, রোনাল্ডো খেলায় নেই, সবাই যেন উদভ্রান্ত! আধঘন্টার মধ্যেই ব্রাজিল এক গোল খেয়ে গেলো। যে জীবনে মনে হয় হেডে গোল দেয়নি, সেই জিদান হেড করে দিয়ে দিল।

     

     

    ফ্রেঞ্চরা আর গুটিকয় ফ্রান্স সমর্থক বেশ লম্ফঝম্ফ করলো, তবে উদ্বাহু নৃত্য না, কে জানে ব্রাজিল আবার কখন ক’টা দিয়ে ফেলে। কিন্তু আমরা, ব্রাজিলের সমর্থকেরা বুঝে ফেলেছি, আর ফিরে আসা সম্ভব না, এই দলটার যেন কিছু একটা হয়েছে। ১ম হাফ শেষ হওয়ার আগেই, আরেক গোল খেলো ব্রাজিল। কে আর দিবে গোল, জিদানই আবার দিল।

    এক মুহূর্তের পিনপতন নীরবতা মনে হয়, তারপরে উল্লাসে ফেটে পড়লো ফ্রান্সের সমর্থকেরা। তারা যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না, এটা কি স্বপ্ন না সত্যি! বিরতিতে ব্রাজিলের কেউ আর নাচানাচি করলো না, বরং ফ্রেঞ্চ সমর্থকরাই পতাকা নিয়ে, আমাদের খানিকটা ভেংচি কেটেই উল্লাস করলো। প্রায় ২০ মিনিট বাকি থাকতে লাল কার্ড দেখলো মার্সেল দেশাইল, তাতেও কেউ আশার আলো দেখলো না, কারন ব্রাজিল ইতোমধ্যেই ছত্রভঙ্গ। অধিকাংশ সমর্থক আর খেলা দেখছে না, মাথা নিচু করে আছে, কাঁদছে কেউ কেউ, আমিও তাদের একজন, আমাদের মুখের রং কান্নায় ধুয়ে গেল। ৯০ মিনিটে পেতি আরেক গোল দিয়ে হারটাকে প্রায় লজ্জাজনক পর্যায়ে নিয়ে গেলো। কাঁদতে কাঁদতেই দেখলাম, আমার চাচা আবারও দৌড়াচ্ছে পতাকাহাতে!

    বাসায় ফিরেছিলাম কাঁদতে কাঁদতেই সবাই, কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই, পরদিন স্কুলে যাইনি। সেসময়ের ওইটুকু ছোট্ট জীবনে সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছিলাম সে রাতেই। ব্রাজিল পরের বিশ্বকাপ ঠিকই জিতেছিলো, রোনাল্ডো আবার তার জাদু দেখিয়েছিলো, কিন্তু সেই দুঃখ যায়নি। সেই আবেগ, উত্তেজনা বা আনন্দ ফিরে পাইনি। জিদান আর ফ্রান্সও স্বাদ পেয়েছিলো দুর্ভাগ্যজনক হারের; হয়তো অন্যায় বা অনৈতিকভাবেই ২০০৬ ফাইনালে হেরে যাওয়ার বেদনা। কিন্তু তাতে বরং আমার কষ্টই লেগেছিলো, এর মাঝে কোন প্রতিশোধ নেয়ার কিছু ছিল না। এখনো ব্রাজিল সমর্থন করি, বিশ্বকাপ আসলে সব খেলা দেখি, জিতলে খুশি হই, হারলে কষ্ট পাই, কিন্তু ১৯৯৮-এর বিশ্বকাপ আমার কাছে আলাদাভাবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে, হয়তো অবুঝ ভালবাসা আর সমর্থনের জন্যে, হয়তো আনন্দের এত কাছে এসে প্রচন্ড কষ্ট পাওয়ার জন্যে।