• " />

     

    'এল ফেনমেনন'-এর বিশ্বকাপ অভিযান

    'এল ফেনমেনন'-এর বিশ্বকাপ অভিযান    

    প্যাভিলিয়ন আয়োজিত স্পোর্টস ফিচার লেখা প্রতিযোগিতা 'খেলার লেখা, লেখার খেলা -২' এর দশজন বিজয়ীর লেখা ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে! আজ থাকছে চতুর্থ স্থান অধিকারী নওশাদ জামান-এর লেখা 'এল ফেনমেনন-এর বিশ্বকাপ অভিযান'

     

    [লেখাটি গত ফুটবল বিশ্বকাপের আগে লিখিত বিধায় শেষাংশে সে আসরের সম্ভাবনার কথা উঠে এসেছে।]

     

    বিশ্বকাপ নিয়ে লিখতে বসলে কিছুটা জট পাকিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। এতো এতো স্মৃতি! কোন ম্যাচ ছেড়ে কোনটাকে সেরা বলবো? এতো খেলোয়াড়ের ভীড়ে কাকে সেরা মানবো? অসাধারণ সব গোলের মাঝে কোনটাকে নিয়ে লিখবো? প্রিয় দল ব্রাজিল হবার কারণে একবার মনে হল ব্রাজিলের পেন্টা জয়ের পথে ইংল্যান্ডের সাথে ম্যাচ নিয়ে লিখি। পরে মনে হল, নাহ! লিখবোই যখন আমার সবচেয়ে প্রিয় ফুটবলারকে নিয়ে লিখবো। কে সেই প্লেয়ার?

     

     

    তিনি আর কেউ নন, তিনি বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা, রোনালদো লুইস নাজারিও দা লিমা, “দ্যা ফেনোমেনোন”।

     

     

    ১৯৯৪ বিশ্বকাপ। ব্রাজিল কোচ পাহেইরা দলে ১৭বছরের এক স্ট্রাইকার ডাকলেন। নাম রোনালদো। তবে জার্সির পিছনে রোনালদো লিখতে পারলেননা। কারণ তখন ব্রাজিল দলে রোনালদো রদ্রিগেজ নামে আরেকজন খেলেন। তাই লেখা হল রোনালদিনহো বা ছোটো রোনালদো। তবে মাঠে নামা হয়নি একটি ম্যাচেও। পরে কোচ পাহেইরা বলেছিলেন মূলত অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যেই তাকে দলে রেখেছিলেন সেবার।

     

     

    এতটুকুন বয়সে যে বিশ্বকাপের মূল দলে সুযোগ পায় তার ভিতরে প্রতিভা আছেই। পরের বিশ্বকাপের দলে তিনি থাকবেন সেটাও স্বাভাবিক। এবার নিজের আসল নাম লেখার সুযোগ মিললো জার্সিতে। কারণ ততদিনে তিনি হয়ে গেছেন ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নের মূল সারথি। পরপর দুইবার ফিফা প্লেয়ার অব দ্যা ইয়ার বিজয়ী।

     

     

    ৯৮ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই স্কটল্যান্ডের সাথে নিজের প্রতিভা দেখিয়ে দিলেন। গোল না পেলেও চোখজুড়ানো ড্রিবলিং আর গতিতে প্রতিপক্ষ ডিফেন্সের ঘাম ছুটিয়ে ছাড়লেন। পরের ম্যাচে মরক্কোর সাথে পেলেন বিশ্বকাপে নিজের প্রথম গোল। রিভালদোর লব-থ্রু থেকে পাওয়া বল মরক্কোর জালে জড়িয়ে দিতেই ভাষ্যকারের উল্লসিত কন্ঠ, ”The best player in the world scores for Brazil.” মাত্র একুশ বছরেই এমন সম্ভাষণ এর আগে পেলে ছাড়া আর কেউ মনে হয় পাননি। পরের ম্যাচ বাদ দিয়ে সেকেন্ড রাউন্ডে চিলির সাথে দুই গোল। একটি নিজের আদায় করা পেনাল্টি আরেকটি রিভালদোর থ্রু থেকে ওয়ান-টু-ওয়ানে কীপারকে বীট করে। কোয়ার্টার বাদ দিয়ে সেমিতে নেদারল্যান্ডের সাথে পেলেন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গোল। এটাও রিভালদোর অ্যাসিস্ট। পরে টাইব্রেকারেও নিলেন সফল পেনাল্টি কিক।

     

     

    রোনালদোর দূর্দান্ত ফর্মের কারণে ফাইনালের আগে সবার কাছে ব্রাজিল তখন চ্যাম্পিয়ন। শুধু গোল করছেন তা নয়, করাচ্ছেনও বটে। ড্রিবলিং স্কিল, চমৎকার গতি, পজিশন সেন্স, ক্লিনিক্যাল ফিনিশিং সব মিলিয়ে রোনালদোকে আটকাবে কে? আটকালেন ফুটবল বিধাতা। ফাইনালের আগে রহস্যজনকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কোচ জাগালো তাকে রাখতেই চাচ্ছিলেননা একাদশে। অনেকটা জোর করেই নামলেন আর দলের ৩-০ গোলের পরাজয় দেখলেন। তবে সেরা খেলোয়াড়ের “গোল্ডেন বল” নিয়ে ফিরলেন ফ্রান্স থেকে। যদিও কেউ কেউ মনে করেন শুধুমাত্র ফাইনালের পারফম্যান্সের কারণেই জিদানের এই পুরষ্কার প্রাপ্য, তবে পুরো টুর্নামেন্ট হিসেব করলে রোনালদোর যোগ্য কেউ ছিলোনা।

     

     

    পরের বিশ্বকাপের আগে তাকে নিয়ে আবার আলোচনা। কারণ অনেকদিন পর আবার ফুটবলে ফিরেছেন। মাঝের তিন বছরে ইনজুরির করাল থাবায় সাকুল্যে খেলেছিলেন ২৬টি ম্যাচ। পূর্ববর্তী বিশ্বকাপ কোচ জাগালো তো বলেই ফেললেন রোনালদো আর কখনো আগের ফর্মে ফিরতে পারবেননা। তবে তৎকালীন কোচ স্কলারী আস্থা রাখলেন তার উপরে। এমনিতেই দুর্দান্ত ফর্মের রোমারিওকে না নেওয়াতে কোচের মুন্ডুপাত চলছে তখন ব্রাজিলে। তার উপরে আগের সিজনে ক্লাবের হয়ে একটা ম্যাচও না খেলতে পারা ইনজুরি জর্জরিত একজন প্লেয়ার দলে। ব্রাজিলের পেন্টা জয়ের আশা বুঝি শেষ।

     

     

    তবে কোচের আস্থার প্রতিদান প্রথম ম্যাচ থেকেই দিলেন রোনালদো। পিছিয়ে থাকা অবস্থায় তুরষ্কের সাথে অসাধারণ এক গোল করে সমতায় ফেরান দলকে। বলা বাহুল্য, গোলের যোগানদাতা ছিলেন রিভালদো। ভাষ্যকারের এবারের স্তুতি, “4years of anguish since that dreadful night in Paris, now he is back doing what he does best. Scoring goals.” চীনের বিপক্ষে পরের ম্যাচেও গোল করলেন, কাফুর পাস থেকে। কোস্টারিকার সাথে করলেন দুটি। একটির উৎস এডিলসনের পাস, আরেকটির রিভালদোর কর্নার। সেকেন্ড রাউন্ডে ব্রাজিলিয়ানদের সর্বোচ্চ পরীক্ষাই নিয়েছিলো বেলজিয়াম। তবে খেলার ৯০ মিনিটে ক্লেবারসনের পাস থেকে দলের দ্বিতীয় গোল করে নিশ্চিত করলেন জয়।

     

     

    কোয়ার্টার ফাইনাল কাটলো গোলহীন। সেমিতে তুর্কিদের সাথে ম্যাচের আগে নিলেন অদ্ভুত এক চুলের কাট। সব চুল ফেলে দিয়ে শুধু মাথার সামনে ত্রিভুজ শেপের একটুখানি চুল। সেই কাট তখন অনেক জনপ্রিয় হয়েছিলো। এখনো অনেকে পাঁড় ব্রাজিলিয়ান সমর্থক বড় কোনো টুর্নামেন্টের আগে এই কাট দিয়ে থাকেন। সেমিতে চারজনের মাঝখান থেকে বুটের মাথা দিয়ে শুট নিয়ে যেভাবে দলের একমাত্র গোলটি করেছিলেন তা নিশ্চিতভাবেই সব ফুটবলপ্রেমীদেরই মনে থাকবে অনেকদিন। ভাষ্যকারের স্তুতি, ”Every world cup leads a hero, and Ronaldo is one here.”

     

     

    ফাইনালের আগে ক্লোসার সাথে দ্বৈরথ। ক্লোসার গোল ৫, রোনালদোর ৬। কে নেবেন “গোল্ডেন বুট”? ফাইনালে কানের ভুলে একটি এবং ক্লেবারসনের পাস থেকে আরেকটি গোল করে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলেন। সর্বমোট ৮গোল করে জিতে নিলেন “গোল্ডেন বুট”। ১৯৭৪ সালের পর এই প্রথম এক আসরে কেউ ৬টার বেশী গোল দিলো। একইসাথে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয়সেরা প্লেয়ারের “সিলভার বল” দখল করলেন। ক্লোসার সাথে সেই যে তার দ্বৈরথ শুরু, তা এখনো চলছে।

     

     

    ২০০৬ বিশ্বকাপের আগে তাকে নিয়ে আবারো প্রশ্ন। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে আগের সিজনটা ভালো কাটেনি, ইনজুরিতে ছিলেন বেশ কিছুদিন। মুটিয়ে গেছেন অনেক। ফিটনেস আছে কিনা সেটা নিয়েও চললো কানাঘুষা। তবে কোচ পাহেইরা আবারো তার উপরে আস্থা রাখলেন। রোনালদো কি পারবেন আস্থার প্রতিদান দিতে? মাত্র তিনটি গোল করে গার্ড মুলারের ৩২বছরের পুরানো রেকর্ড ভেঙ্গে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড নিজের করে নিতে?

     

     

    গ্রুপের প্রথম দুই ম্যাচে পারফরম্যান্স ছিলো জঘন্য। গোল করাতো দূরে থাক, বলে পা ছোঁয়াতে পেরেছিলেন সাকূল্যে কয়েকবার। তার ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানুষদের সমালোচনার সুযোগ করে দিলেন তিনিই। দূর্দান্ত দল নিয়েও  ব্রাজিলের সাদামাটা পারফরম্যান্সের দায়ভার তার উপরেই চাপাতে লাগলো সবাই। এই অবস্থাতেও কোচ জাপানের সাথে শেষ গ্রুপ ম্যাচেও তাকে সুযোগ দিলেন। কোচের ভাষায় যেটা ছিলো রোনালদোর কনফিডেন্স ফিরে পাওয়ার শেষ সুযোগ। সুযোগটা কাজে লাগালেন দারুণভাবে! প্রথমে সিসিনহোর ক্রস থেকে হেডে দলের সমতাসূচক গোল। তার ১৫গোলের মধ্যে হেডে করা একমাত্র গোল। দ্বিতীয়ার্ধে ওভারল্যাপ করে উঠে আসা ডিফেন্ডার হুয়ানের সাথে ওয়ান-টু-ওয়ান খেলে বক্সের বাইরে থেকে দূরপাল্লার শটে গোল। মুলারকে ছুঁয়ে ফেললেন।

     

     

    দ্বিতীয় রাউন্ডে ঘানার সাথে ম্যাচের আগে সবার প্রত্যাশা এই ম্যাচে মুঠোবন্দী করবেন রেকর্ড। প্রত্যাশা পূরণে সময় নিলেননা একদম। ম্যাচের বয়স ৫মিনিট গড়াতেই কাকার থ্রু থেকে অফসাইড ট্র্যাপ ভেঙ্গে গোলকিপারকে একা পেয়ে গেলেন। এরপর ট্রেডমার্ক ড্রিবলিং এ কীপারকে একপাশে ছিটকে ফেলে টোকা দিয়ে বল পাঠালেন জালে। রেকর্ড সৃষ্টিকারী গোলটি মনে হয় এরচেয়ে ভালোভাবে হতে পারতোনা। এটাই বিশ্বকাপে রোনালদোর শেষ গোল। পরের ম্যাচেই ফ্রান্সের সাথে হেরে ব্রাজিল এবং একইসাথে এল ফেনোমেনোন বিদায় নিলো  বিশ্বকাপ থেকে।

     

     

    দুয়ারে দাঁড়িয়ে আরেকটি বিশ্বকাপ। আবার ৩২দল মেতে উঠবে গোলের খেলায়। তবে ক্লোসার দিকে আলাদা নজর থাকবে সবার। মাঝখানে একবার বলেছিলাম ক্লোসার সাথে রোনালদোর সেই দ্বৈরথ এখনো চলছে। এবার ক্লোসা ১৪গোল নিয়ে রোনালদোর ঠিক ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছেন। মাত্র দুটি গোল করলেই সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতার নাম থেকে রোনালদোর নাম মুছে দেবেন তিনি। এবার না হলেও একসময় না একসময় রেকর্ড বই থেকে হয়তো রোনালদোর নাম মুছে যাবে। তবে প্রিয় খেলোয়াড় হিসেবে রোনালদো সবসময় এক নম্বরেই থাকবেন।