স্মৃতির কাপ, বিশ্বকাপ

প্যাভিলিয়ন আয়োজিত স্পোর্টস ফিচার লেখা প্রতিযোগিতা 'খেলার লেখা, লেখার খেলা -২' এর দশজন বিজয়ীর লেখা ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে! আজ থাকছে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী দুর্জয় বৈদ্য-এর লেখা 'স্মৃতির কাপ, বিশ্বকাপ'।
--রোমারিওকে তো নিল না, এবার না জিতলে যে ওর কি অবস্থা করা হবে সেটা হবে দেখতে থাক।
-- আমি যদি ব্রাজিলে যেতে পারতাম, তাহলে গিয়েই ওকে একটা মাইর দিয়ে আসতাম।
স্পষ্ট মনে আছে আমার কথাগুলো এখনো। আমি আর আমার বন্ধু পাভেল স্কুলের পিছনের দিকের একটা দেয়ালে চড়ে পা ঘুলিয়ে দিয়ে রাগ ঝাড়ছিলাম লুই ফেলিপ স্কলারির উপর। তিনি ছিলেন ২০০২ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলের কোচ। সমস্ত গণমাধ্যম জুড়ে তখন “রোমারিও বনাম স্কলারি” যুদ্ধ ফলাওভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল। আরো অনেকের মতো আমার আর আমার বন্ধু পাভেলের এগারো বছরের মনটাও চাইছিল রোমারিও যাতে দলে থাকে। কিন্তু স্কলারি তাকে ছাড়াই গড়ে ফেললেন দল। তাই হাফপ্যান্ট পরিহিত দুই স্কুল বালকের এই রাগের আস্ফালন।
ফুটবল বিশ্বকাপ! পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উন্মাদনার আয়োজন! এটা নিয়ে লিখতে বসে ভাবলাম ইন্টারনেট থেকে বিবিধ ঘটনা, তথ্য টুকে একটা বেশ ভালো রকমের লেখা লিখি। পরক্ষণেই মনে পড়ল লিখতে হবে বিশ্বকাপের স্মৃতি নিয়ে। আর যেটা অন্তর্জালে আছে, সেটা তো আসলে আমার স্মৃতি নয়। আমার স্মৃতি তো আমার মনেই গাঁথা। তাই স্মৃতি হাতড়েই লিখছি।
১৯৯৪ বিশ্বকাপের সময় আমি নেহায়েতই শিশু। সেই বিশ্বকাপের কথা বলতে কিছুই মনে নেই। এটুকু মনে আছে কেবল, তখন আমরা যে পাড়ায় থাকতাম সেখানে বিশাল একটা পতাকা ঝুলানো হয়েছিল ঠিক আমাদের ঘরের সামনেই। হলুদ রঙের পতাকা। লোকে ওটার নীচে জড়ো হয়ে টিভিতে ব্যাটারি লাগিয়ে খেলা দেখতো। প্রায়শই তাদের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যেতো রাতে। পুরো বিশ্বকাপ থেকে একটা শব্দই শিখেছিলাম সেবার – “ব্লাজিল”। সেই ‘ব্লাজিল’ পরবর্তীতে ব্রাজিল হয়ে গেলো অচিরেই আর ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলাম ফুটবলের রঙ হলুদ।
১৯৯৮ বিশ্বকাপের সময় সবেমাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছি। টিফিন ব্রেকে বন্ধুরা মিলে নিয়মিত ‘বিশ্বকাপ’ খেলি। কিন্তু সমস্যা হল পায়ে “ট্রিকোলোরে”-এর বদলে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া কাঠবাদাম। আমাদের বিশ্বকাপে কেবল দুটো দলেরই খেলা হতো—ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা। ফি দিন এই দুই দলেরই খেলা হতো এবং মারামারি লাগতো। এমনটা প্রায়ই হয়েছে ক্লাসের যে ছেলেটার সাথে কখনো ভালো করে কথাই বলিনি, সে আমার অনেক কাছের বন্ধু হয়ে গিয়েছে কাঠবাদামের সেই বিশ্বকাপে একই দলে খেলার কারণে। খেলা শেষে যেই দল জিততো তারা অপর দলকে শুনিয়ে শুনিয়ে গায়তো—“গোল! গোল! ওলে, ওলে, ওলে”। সে বছর ব্রাজিল খেলছিল স্বপ্নের মতোই। রোনালদো, রবার্তো কার্লোসরা কাঁপিয়ে দিচ্ছিল পুরো বিশ্বকে। কিন্তু বিধিবাম! ফাইনালে ধাক্কা খায় তারা। জিনেদিন জিদান একাই হারিয়ে দেয় ব্রাজিলকে। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন। সে বছর প্রাণ জুস খেলে পাওয়া যাচ্ছিল বিভিন্ন ধরণের প্লে-কার্ড, যেখানে বিশ্বকাপের বিভিন্ন দলের আর খেলোয়াড়দের ছবি দেওয়া থাকতো। এখনো মনে আছে, ফ্রান্স আর জিনেদিন জিদানের প্লে-কার্ড দুটো আমি কাঁটা চামচ দিয়ে অবিরাম খুঁচিয়ে গিয়েছিলাম সেই ফাইনালের পর।
এরপর আসে ২০০২ বিশ্বকাপ, এশিয়ার বিশ্বকাপ। সে বছর খেলা দেখে আরাম পেয়েছিলাম বেশ, রাত জাগতেই যে হয় নি! প্রিয় দল ব্রাজিল সেবার তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে বাছাইপর্ব পেরিয়ে এসেছিল এশিয়ায়। কিন্তু বিশ্বকাপ নামক মঞ্চটাই যেন পালটে দিল তাদের, খেলল ‘জোগো বনিতো’। রিভালদোর খেলা এখনো চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে রোনালদিনহোর সেই ফ্রি-কিকের কথা মনে পড়লে এখনো রোম খাড়া হয়ে ওঠে। সেবছর খেলা দেখেছিলাম বাসার সবাই মিলে। টাকা জমিয়ে কিনে এনেছিলাম ব্রাজিলের ছোট একটা পতাকা। ব্রাজিলের খেলা হলেই সেটা নিয়ে বসে যেতাম, আর তাদের পায়ে বল এলেই সেটা উড়াতাম। দক্ষিণ কোরিয়ার খেলা দেখে সেবার একটা শিক্ষা পেয়েছিলাম জীবনের। দক্ষিণ কোরিয়ার খেলোয়াড়েরা সবাই ছিল তাদের প্রতিপক্ষের তুলনায় আকারে অনেকটাই খর্বকায়। কিন্তু তারা সেবার যখনই মাঠে নামতো তখন তাদের দৃঢ় চোয়াল দেখলে মনে হতো – লড়াইটাই আসল, জেতাটা নয়। পুরো বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে ইতালি, স্পেনের মতো দানবকে হারিয়ে তারা পৌঁছে গেলো সেমিতে। মনে প্রাণে চাইছিলাম, যাতে তারা ফাইনালে উঠে। উঠে নি, উঠতে পারে নি মাইকেল বালাকের জন্য। এই আরেকজন খেলোয়াড় যার জন্য এখনো মন খারাপ হয় যখনই ফাইনালের সেই দৃশ্যটা ভেসে উঠে চোখের সামনে – ব্রাজিলের কাছে রীতিমতো পর্যুদস্ত জার্মানি, মাঠের বাইরে থেকে সেটা কুয়াশা ভরা চোখে দেখছেন ‘ট্র্যাজিক হিরো’ মাইকেল বালাক।
২০০২ বিশ্বকাপের সবচেয়ে আরামদায়ক স্মৃতি হল সেনেগালের কাছে ফ্রান্সের হার, আর সবচেয়ে দুঃখজনক স্মৃতি হল ‘ব্রাজিল-আজেন্টিনা’ ম্যাচ খেলে নিজেদের মধ্যে মারামারির করার কারণে পুরো স্কুল ড্রিল স্যার কর্তৃক পুরো স্কুল কান ধরে ঘুরে আসা।
২০০৬ বিশ্বকাপের ঠিক আগে আগে আমাদের তৎকালীন নয় বছর বয়সী চৌদ্দ ইঞ্চি টেলিভিশনটা নষ্ট হয়ে যায় । মেকানিকের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর জানা গেলো পিকচার টিউব ছাড়াও আরো কি যেন একটা যন্ত্রাংশ জ্বলে গিয়েছে। এগুলো ঠিক করতে যে পরিমাণ টাকা দরকার ছিল সেটা সে সময় আমাদের ছিল না। তাই বাবা-মা টিভি সেটটা নিয়ে ফেরত এলেন। সে বছর বিশ্বকাপ আর দেখা হচ্ছে সেটা প্রায় নিশ্চিত জেনে মেনেই ছিলাম পরিস্থিতিটা। কিন্তু মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে মন। আর সেখানে মন জিতে যায়। আমার মনমরা ভাব দেখে বাবা-মা দুদিনের মাঝেই কোথা থেকে, কিভাবে যেন আমাদের টেলিভিশন সেটটা ঠিক করিয়ে এনেছিলেন। এখন বুঝি ছেলেকে বিশ্বকাপ দেখার খুশি দেওয়ার জন্য আমার বাবা-মা পরের দুইটা মাস নিজেদের প্রয়োজনীয় অনেক খরচই বাদ দিয়েছিলেন। সেই বিশ্বকাপে কাকা কেঁদেছিল, রোনালদিনহো কেঁদেছিল, কাফু কেঁদেছিল, আমিও কেঁদেছিলাম। আমাদের সংসারের চাকাটাও কেঁদেছিল বোধহয়। ছোট ছিলাম বলে হয়তো শুনতে পাই নি।
২০০৬ বিশ্বকাপ আমাকে একটা অদ্ভুত রকমের শিক্ষা দিয়েছিল। সেটা হল – আপনি আগের দিন যত বড় কাজই করে দেখান না কেন, পরের দিনের সূর্যটা আপনার কাছ থেকে নতুন করে হিসাব চাইবে আপনার কাজের। ব্রাজিল ছিল সে বছরের হট ফেভারিট। বাছাইপর্বে খেলেছিল দুর্দান্ত, আগের মৌসুমে দলের খেলোয়াড়েরা ক্লাবের হয়ে মাঠ কাঁপিয়েছিল। কিন্তু নতুন দিনের নতুন হিসেব মিলাতে তারা ব্যর্থ হয়। আমার মতো আরো অনেক সমর্থকের হৃদয় পুড়িয়ে তার বিদায় নেয় বিশ্বকাপ থেকে। এতে এতো কষ্ট পেয়েছিলাম যে এরপর আর কোন খেলাই দেখি নি।
২০১০ বিশ্বকাপের একটা ঘটনা দিয়ে লেখাটা শেষ করি। আমি আর আমার এক বন্ধু (নামটা আর বললাম না) যথাক্রমে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার ঘোর সমর্থক। বিশ্বকাপের শুরু থেকেই একে অপরকে সেই রকমের পচানি দিচ্ছি। তো সেই বিশ্বকাপে কোয়াটার ফাইনালে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার খেলা পড়েছিল টানা দুইদিনের মধ্যে। এর মধ্যে ব্রাজিলের খেলা ছিল আগের দিন এবং হল্যান্ডের কাছে হেরে আবার তাদের বিদায়। পরদিন সকালে আমার সেই বন্ধুটি আমার জীবনকে অভিশপ্ত করে দিতে যা যা করা দরকার তার প্রায় সবটাই করেছিল। তার তীক্ষ্ণ বাঁশের কারণে বাধ্য হয়ে বিধাতাকে ধরণী দ্বি-খন্ডনের আহবান জানাতে বাধ্য হই। আমার মতো পাপীদের কথা বিধাতা শুনবেন এটা আশা করি নাই, কিন্তু তিনি শুনলেন। সেই রাতেই আর্জেন্টিনাকে নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা করে জার্মানি। আমার বন্ধুটিকে এরপর অনেকদিন খুঁজেই পাই নি। এখনো দেখা হলে কেউ খেলা নিয়ে কোন কথাই বলি না, কেবল মুচকি মুচকি হাসি।
প্যাভিলিয়নের এই আয়োজনে লিখতে গিয়ে স্মৃতিচারণার সুযোগ হয়ে গেলো বিশ্বকাপ নিয়ে। হয়তো প্যাভিলিয়নের এরকম কোন এক আয়োজনে ভবিষ্যতে আরো অনেকেই লিখবে বিশ্বকাপের স্মৃতি নিয়ে। সেই স্মৃতিতে যাতে বাংলাদেশেরও ঠাঁই মেলে এটাই প্রত্যাশা।