• " />

     

    অশ্রুতে জন্ম যে ভালোবাসার...

    অশ্রুতে জন্ম যে ভালোবাসার...    

    প্যাভিলিয়ন আয়োজিত স্পোর্টস ফিচার লেখা প্রতিযোগিতা 'খেলার লেখা, লেখার খেলা -২' এর দশজন বিজয়ীর লেখা ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে! আজ থাকছে প্রথম স্থান অধিকারী সাইফুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা 'অশ্রুতে জন্ম যে ভালোবাসার...'

     

     

    তখন আমার বয়স কত হবে? ৮ কিংবা বড় জোর ৯ বছর। আমি তখন গ্রামে থাকতাম। ডাকাতিয়ার পাড়ে। ডাকাতিয়ার তখন এত রুগ্ন অবস্থা ছিল না। বর্ষা কালে চারপাশ ভাসিয়ে দিত। তখনকার সময়ের গ্রামের ৮-৯ বছরের একটা ছেলে শহরের বর্তমান যুগের ৮-৯ বছরের একটা ছেলে মোটেই সমান ছিল না। এখনকার টেকি ছেলেমেয়েরা যতটা তথ্য প্রযুক্তির দিক দিয়ে অগ্রসর আমরা অতটা ছিলাম না। সারাদিন কাটত দুরন্তপনা করে। আর বিকেল বেলা খেলার মাঠে। এমন কোন খেলা ছিল না যেটা খেলা হত না। কানামাছি থেকে গোল্লাছুট কোনটাই বাদ যেত না। ফুটবল-ক্রিকেট মাঠ সাধারণত পাড়ার বড় ভাইদের দখলে থাকত। কখনও যদি দয়া করে খেলায় নিত তাতেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেতাম। যদিও বেশির ভাগ সময়েই ক্রিকেট বল কুড়িয়ে আনা মানে ফিল্ডিং-ই ছিল আমাদের কাজ। সেই দিক থেকে আমি একটু ভাগ্যবান। আমাকে ভরসা করে মাঝে মাঝে বড় ভাইরা গোলকিপার হিসেবে দলে জায়গা দিত। তা নিয়ে আমার গর্বের কোন কমতি ছিল না।

     

     

    গ্রামের ছেলে বলে টেলিভিশনে খেলা দেখাটা ছিল সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমরা খেলা দেখা বলতে বিভিন্ন পাড়ার মাঠে মাঠে গিয়ে খেলা দেখা বুঝতাম। আমাদের নিজের কোন টেলিভিশন ছিল না। আমার বড় চাচার বাসায় একটা সাদাকালো টেলিভিশন ছিল। সেখানে বিটিভিতে শুক্রবারে বাংলা সিনেমা দেখতাম, রাতে আলিফ লায়লা, হারকিউলিক্স, সিনবাদ, সাপ্তাহিক নাটক দেখতাম। আর যখন মাঝে মাঝে বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ দেখাতো তখন দেখতাম। কিন্তু ফুটবল দেখাটা হত না তেমন। আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলাই কখনও দেখি নি সেখানে লীগের খেলাতো দূরের ব্যাপার।

     

     

    ২০০২ সালে যখন বিশ্বকাপ আসল তখন বড় ভাইরা এর ওর খুব সুনাম করত। একজন আরেকজনের সাথে তুমুল তর্ক করত। আর চুলচেরা বিশ্লেষণ। আমি ছোট মানুষ। অতকিছু বুঝতাম না। তাও আগ্রহ নিয়ে তাদের কথা শুনতাম। হা করে সব গিলতাম। অনেক খেলোয়াড়ের নামও বড় ভাইদের মুখ থেকে শুনে শুনে মুখস্ত করে বন্ধু মহলে গিয়ে তাদের কথা বলে বেশ বোদ্ধার মত একটা ভাব নিতাম। আমার এখনও মনে আছে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে অনেক প্লেয়ারের ভিউ কার্ড কিনেছিলাম। ওদের খেলা কখনও দেখি নি। শুধু বড় ভাইদের মুখে নাম শুনেছি। জিদান, ওরি, ওর্‌তেগা, বাতিস্তুতা আরো কত কি...

     

     

    ভাইদের মুখে খেলার কথা শুনে খুব হিংসা লাগত। কিন্তু দেখতে পারতাম না। কারণ খেলাগুলা হত রাতে। আর যেহেতু আমি ছোট সেহেতু অনেক ইচ্ছাই অপূর্ণ রাখতে হত। টিভি দেখব? আজকে তো আলিফ লায়লা নাই। কিসের টিভি? পড়। আমি খেলা দেখব... সারাদিন খেলিস তাতে হয় না? আবার রাত জেগে খেলা দেখবে উনি। দিব এক থাপ্পড়। থাপ্পড়ের ভয়ে আর কথা বাড়াতাম না। লক্ষ্মী ছেলের মত খেয়ে দেয়ে চাপা অভিমান বুকে নিয়ে শুয়ে পড়তাম।

     

     

    কদিন পর নানুর বাড়ি গেলাম। নানুর বাড়িতে রঙিন টেলিভিশন আছে। সেখানে কেউ আমাকে থাপ্পড়ের ভয় দেখানোর নেই। ভাবতেই খুশিতে হাতে স্বর্গ পেলাম যেন! মামার বাড়িতে বিশ্বকাপ উপলক্ষে সেই রকম আয়োজন! বাড়িতে বেশ অনেকগুলা হলুদ সবুজ পতাকা উঠেছে। ভিউ কার্ডের রোনাল্ডোর ছবি থেকে জেনেছি এটা ব্রাজিলের পতাকা। আমার মামারা সবাই ব্রাজিলের সাপোরটার। ব্রাজিল নাকি ভালো ফর্মে আছে এই জন্য মামাদের মাঝে স্পষ্ট ফুর্তির ভাব দেখলাম। সন্ধ্যার পর খেলা শুরু হবে। আর্জেন্টিনা আর সুইডেনের খেলা। আমি উত্তেজিত। কারণ এটা আমার দেখা বিশ্বকাপের প্রথম খেলা। আমার মামারাও উত্তেজিত। কারণ এই ম্যাচ যদি হারে তাহলে নাকি আর্জেন্টিনা নাকি বাদ পড়বে। তাদের কাছ থেকে জানলাম আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল পরস্পর শত্রু দেশ। তাই শত্রুর পরাজয়ে তারা খুশি হবে। আমি এইসব শুত্রুমিত্র নিয়ে চিন্তিত না। আমি খেলা দেখতে পাবো এটা নিয়েই উত্তেজিত।

     

     

    আমার ছোট মামা ভালো ছবি আঁকতে পারতেন। খেলা শুরুর আগে উনি আমার গালে ব্রাজিলের পতাকা এঁকে দিলেন। আমি ব্রাজিলের পতাকা গালে নিয়ে আর্জেন্টিনার খেলা দেখতে বসলাম।

     

     

    খেলা চলছে। প্রাণ দিয়ে খেলছে আর্জেন্টিনা। প্রতিটা আক্রমণ ফিরে আসে আর আমার মামারা উল্লাসে ফেটে পড়ে। হটাৎ করে সুইডেন একটা ফ্রি কিক পেয়ে গেল। সেই ফ্রি কিক থেকে গোল। আর আমার মামারা যেন খুশিতে পাগল হয়ে যাবে। এরপর খেলা চলতে লাগল আক্রমণ পাল্টা আক্রমনে। খেলার শেষের দিকে আর্জেন্টিনা একটা প্যানাল্টি পায়। গোলকিপার যদিও প্যানাল্টি ঠেকিয়ে দেয় কিন্ত ফিরতি শটে ক্রেসপো ঠিকই গোল করে। কিন্তু তাতে কি? আর্জেন্টিনার যে আরো একটা গোল লাগবে। তাদের ওই ম্যাচ জিততেই হত। কিন্তু তারা পারে নি। ড্র করে। ফলে গোল ডিফারেন্সে বাদ পড়ে প্রথম রাউন্ড থেকেই।

     

     

    এই পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। বিপত্তিটা লাগে ম্যাচের শেষে। আমার এখনও মনে আছে কিভাবে বাতিস্তুতা, ক্রেসপোরা সেদিন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। আমি ওদের কান্না দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আরে এটা তো একটা খেলাই! নাকি? একটা খেলার জন্য কেউ এভাবে কাঁদে!

     

     

    ওদের কান্না সেদিন আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। প্রচন্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল। খেলার জন্য এতটা আবেগ কারো থাকতে পারে আমার জানা ছিল না। আমার মনে আছে আমার মামারা যখন আর্জেন্টিনার বিদায়ের আনন্দে মেতে উঠেছিল তখন আমার চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে নিয়েছিলাম। সেই রাতে আর খাওয়া দাওয়াও করি নাই। খেতে ইচ্ছে করে নি।

     

     

    সেই থেকে শুরু। সাতসাগর তের নদী ওপাড়ের ফুটবল দলটাকে সেদিনই আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। সে ভালোবাসা কোন ট্রফি দেখে জন্ম নেয় নি। সে ভালোবাসা চোখের জল দেখে জন্ম নিয়েছিল। এরপর কত কিছুই হল, কত পরিবর্তন আসল। সেই ডাকাতিয়া আজ প্রায় মৃত। ডাকাতিয়ায় এখন আর বাণ ডাকে না। গ্রামের সেই দুরন্ত আমি শহরে চলে আসলাম। উন্মুক্ত খেলার মাঠ থেকে এসে ইট-পাথরের খুপড়ি বন্ধী হলাম। বিশুদ্ধ অক্সিজেনের বদলে শিশাযুক্ত বাতাসে ফুসফুস ভরাট করলাম। কিন্তু ছোট্ট বেলায় জন্ম নেয়া সেই সেই ভালোবাসা? সেই ভালোবাসা আজো আছে। বরং আগের চাইতে পরিমাণে বেশ বেশিই আছে। সেই দেশ সম্পর্কে যত জেনেছি তত মুগ্ধ হয়েছি। মুগ্ধ হয়েছি তাদের খেলা দেখে। খেলা নিয়ে তাদের অফুরন্ত আবেগ দেখে। আজো সেই দেশের মানুষ গুলোকে আমার পাশের পাড়ার লোক মনে হয়। খুব ইচ্ছে আমার, মৃত্যুর আগে একবার সেই দেশটা ঘুরে আসার...