• " />

     

    বাংলাদেশ, শুনতে কি পাও?

    বাংলাদেশ, শুনতে কি পাও?    

    প্রিয় বাংলাদেশ,

    দেখতে দেখতে ১৬ বছর কেটে গেল, তাই না? আমার তো মনে হচ্ছে এই সেদিনের কথা। তুমি তখন ঠিকমতো কথাও বলতে শেখনি, হাঁটতে গিয়ে কতবার হোঁচট খেয়েছ। তোমার মনে আছে, লোকজন তখন কত কান ভারি করেছিল আমার? এই ছেলে কখনো ঠিকঠাক হাঁটতে পারবে না, কথা বলতেই নাকি ওর অনেক দিন লেগে যাবে! এখন আমি বলি, ওরা এসে দেখে যাক তোমাকে। তুমি তো এখন আর ছোট্টটি নেই, ১৬ বছর হয়ে গেছে তোমার। কত বড় হয়েছ, একটু একটু করে নিজের পায়ে দাঁড়াতেও শিখে গেছ। এই তো, কদিন আগেই বড় ছেলেটাকে তুমি পাঞ্জা খেলায় হারিয়ে দিলে। অথচ ওরা বলেছিল, তোমার দৌড়াতেই নাকি আরও অনেকদিন লেগে যাবে।

    তোমার জন্ম নেওয়ার সেই দিনটা তো এখনও মনে আছে আমার। এখন যে মিরপুরে তুমি থাক, সেখানে তখন তোমার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। মতিঝিলের পাশে, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামই তো ছিল তোমার আঁতুড়ঘর। তোমাকে হয়তো অনেকেই বলে থাকবে, আমি নাকি তোমাকে ওই সময় চাইনি। অনেকেই বলেছিল, তোমাকে বড্ড তাড়াতাড়ি কোলে এনে ফেলেছি আমি। কিন্তু সেদিন এসবের কিছুই আমার মনে ছিল না। তোমার জন্মোৎসবে পুরো বাংলাদেশ কেমন অমরাবতী হয়ে উঠেছিল, কেমন উৎসবের বাদ্যি বেজেছিল কার্তিকের মিঠে রোদে- সে কথা ভুলতে পারি বল?

     

    তুমি মনে হয় জান না, তোমার জন্মের দিনকয়েক আগেও আমার মনটা ঠিক ভালো ছিল না। যা কিছু মন্দ, যা কিছু অশুভ- আমার সাদা পোশাকে কখনো সেসবের আঁচ লাগতে দেইনি। কিন্তু ওই বছরটা মনে হচ্ছিল কেউ সাদা পোশাকটা লেপ্টে দিয়েছে কুৎসিত সব দাগে। ক্রনিয়ের মতো ছেলে নাকি ইচ্ছা করে ম্যাচ হেরে গিয়েছিল। বল এও কী ভাবা যায়? তোমার জন্মের দিন আগে তো আরেক বিস্ফোরণ। লারা, ডি সিলভা, রানাতুঙ্গারাও নাকি টাকার বিনিময়ে বিকিয়ে দিয়েছে নিজেদের। ভাগ্যিস, পরে সেসব ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু বড় মন খারাপ করেই আমি ঢাকাতে এসেছিলাম।

    তবে তোমার জন্মের ওই মুহুর্ত সব কিছু ভুলিয়ে দিয়েছিল। সেই যে, নাঈমুর নামের ছেলেটা টস করতে নামল, পুরো মাঠ জাদুমন্ত্রের মতো কেমন একসাথে গমগম করে উঠল। কত লোক ব্যানার নিয়ে এসেছিল, “টেস্ট খেলতে পেরে আমরা গর্বিত”। আমার বুকের ভেতরটা তখন কেমন করে উঠল, তুমি যদি জানতে! সংসারে নতুন অতিথি কে না চায় বলো? আর তার জন্য যদি মাঠের ৪০ হাজার লোকের শুভাশিস সঙ্গী হয়, তাহলে কি আর অনুভূতিটা বলে বোঝানো যায়?

    তবে মজার ব্যাপার কী জান, এই মাঠের সঙ্গে আমার পরিচয় কিন্তু আজকের নয়। সে তোমার আরও অনেক অনেক বছর আগের। তখনও তোমার প্রতিবেশী বড় দুই ভাইয়ের জন্য আমাকে অনেকবারই আসতে হয়েছে এই মাঠে। এখানেই তো সেই ষাটের দশকে হানিফ মোহাম্মদ জোড়া সেঞ্চুরি করেছিল। আবার খান মোহাম্মদ, ফজল মোহাম্মদরাও তোপ ঝরিয়েছিল এখানে।

    তবে ১৬ বছর আগের ওই দিনের সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। এমনিতেও তো ১০ নভেম্বর তারিখটা আমার জন্য একটু অন্যরকম, সেটা বোধ হয় তুমি জান না। সেই গল্প তোমার জন্মেরও নয় বছর আগের। এই দিনেই তো তোমাদের আরেক অগ্রজের নতুন করে জন্ম হয়েছিল। আমার ওই ছেলেকে বলতে গেলে একরকম দ্বীপান্তরেই পাঠিয়ে দিতে হয়েছিল, ২১ বছর ধরে আমি ওর খোঁজ পাইনি। সেদিন আবার ওকে নতুন করে পেলাম ইডেন গার্ডেনে। সেটা ১৯৯১ সাল, তোমার জানার কথাও নয়। বর্ণবাদের নিষেধাজ্ঞায় তো তোমার আফ্রিকাতুতো ভাই কতদিন ওই ২২ গজ থেকে দূরে ছিল! কত রাত ওকে স্বপ্নে দেখে আমার ঘুম ভেঙে গেছে, সেটা তুমি বড় ভাইদের কাছ থেকে শুনে থাকবে। তোমার জন্মদিনেই ও আবার ফিরেছিল ক্রিকেটে। আমার খালি কোলটাও তো আবার ভরিয়েছিল তুলেছিল।

    তোমার জন্মের সময় অবশ্য সেই ভাই ছিল না। তবে এই দুই বিশেষ দিনের দুইজন কিন্তু ঠিকই সাক্ষী ছিল। শচীন টেন্ডুলকার আর জাভাগাল শ্রীনাথ দেখেছে, সন্তান জন্ম নেওয়ার আর ফিরে পাওয়ার আনন্দ কতখানি। ঢাকা আর ইডেন গার্ডেনের সেই ইতিহাস তো এই দুজনের কখনোই ভোলার কথা নয়। ওদেরকে জিজ্ঞেস করো, ঠিক জানতে পারবে!

    আচ্ছা, কীসব পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটছি। বলছিলাম তোমার ওই জন্মদিনের কথা। প্রথম দুই দিনে মনে হচ্ছিল, তুমি বোধ হয় অল্প কদিনের মধ্যেই হামাগুড়ি দেওয়া শিখে যাবে। ওই যে, একটু খাটো করে মিষ্টি চেহারার বুলবুল নামের ছেলেটা। কী ব্যাটিংই না করলো ও! সঙ্গে সুমন নামের ওই ছেলের কথাও তো মনে আছে। অথচ শুনেছিলাম, ওকে নাকি শুরুতে দলেই নেওয়া হয়নি। আমার না তখন সেটা বিশ্বাসই হতে চাইছিল না। ওই দুজন যখন ব্যাট করছিল, মনে হচ্ছিল তোমার জন্মটাই হবে সবচেয়ে ডাকাবুকোভাবে।

    তবে শুরুর মতো শেষটা আর হয়নি। প্রথম তিন দিন হাসির পর সেই যে কেঁদে উঠলে, আর থামাথামি নেই। একেবারে চতুর্থ দিনেই ম্যাচ শেষ করে তবেই নামলে কোল থেকে। বুঝতে পেরেছিলাম, একটু সময় লাগবে। তা অন্যদেরও তো লেগেছে। এক ইংল্যান্ড ছাড়া আর কেই বা জন্মের সময় হাসতে পেরেছে? দুর্মুখেরা বলে, তোমার সেই হাসির জন্য ৩৪ টেস্ট অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু তারা তো বলে না, তোমার অভিভাবকেরা কথা দিয়ে কথা রাখেনি। একেকবার যুদ্ধে নামতে তোমাকে অপেক্ষা করতে হয় বছরেরও বেশ সময়। এই ঔদাসীন্য, অবহেলা তো আমার বুকেও বড় বেদনার মতো বাজে। আর তোমার তাসমানতুতো ভাই নিউজিল্যান্ডের যে ৪২ টেস্ট লেগেছে, সেটাও তো কেউ বলে না? জন্মের সময় তোমার চেয়েও গলা ফাটিয়ে যে বড় ভাইদের অনেকেই চিৎকার করেছে, সেটাই বা জানে কয়জন?

    কিন্তু তোমার জন্মের চারদিন যে ঢাকা আমি দেখেছি, সেটা ভুলি কীভাবে? জন্মের ঠিক আগে আকাশ থেকে অন্য ভাইদের মনে করিয়ে দিয়ে নেমে এসেছিল প্যারাট্রুপাররা। গ্যালারিভর্তি লোকজন সারা দিন গলা ফাটিয়ে বেড়াচ্ছে, বাসন্তী শাড়ি পরে মেয়েরাও তো এসেছিল তোমাকে বরণ করতে। শুনেছি, তোমার জন্মের একদিন দৈনিক পত্রিকা বন্ধ ছিল। কিন্তু সাংবাদিকেরা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে আলাদা একটা সংখ্যা নাকি বের করেছিল। আর কার জন্মের সময় সেটা হয়েছে, সেটা আমি মনেও করতে পারছি না।

    বয়স তো অবশ্য আর কম হলো না। শরীরটা কঙ্কাল-মাংসের হলে কবেই প্রাণবায়ু বেরিয়ে যেত। ১৩৯ বছর বয়স তো নশ্বর মানুষের কজনই বা বেঁচেছে? অশরীরী বলেই এখনো ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছি। কিন্তু তোমাকে যেভাবে দেখে যাচ্ছি, তাতে মনে হচ্ছে আরও অনেক বছর যদি বাঁচতে পারতাম। এখন তোমার দুরন্ত যৌবন, যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়। লোকজন বলাবলি করছে, আমার ছোট ছেলেটা নাকি বেশ ডাকাবুকো হয়েছে। ওর গর্জনে বড়দেরও নাকি ঘাম ছুটে যায়। এসব শুনেও শান্তি। তবে মনে রেখো, ফলবান বৃক্ষ আর গুণবান লোক আপনা থেকেই নত হয়। তোমার সামনে আকাশ ছোঁয়ার হাতছানি, কিন্তু সেজন্য তোমাকে খাটতে হবে নিরন্তর। অনেক চাকচিক্য আর প্রলোভন উপেক্ষা করতে হবে, নিজের শক্তির জায়গাটা বুঝতে হবে। নিজের ভিতটা শক্ত করতে হবে। মনে রাখবে, তোমার অগ্রজেরা কিন্তু এ পথ আসতে অনেক কাঁটাভরা পথ পাড়ি দিয়েছে। কখনো ভেবো না, দুয়েকটা হুংকার দিয়েই তুমি তাদের সমান হয়ে গেছ। তোমার যাত্রা তো কেবল শুরু।

    বয়স তো আর কম হলো না, মরতে হয়তো একদিন হবেই। তার আগে তোমাকে দেখে যেতে পারছি, সেটাই বা কম কী? এখন মরলেও আমার খুব দুঃখ হবে না।

    তুমি ভালো থেকো, সুখে থেকো। শতায়ু হও, তোমার পরিচর্যা হোক, তুমি আরও মাথা উঁচু করে দাঁড়াও। এই তো ক'দিন আগে মিরপুরে যেমন তুমি মাথাটা উঁচু করলে! বিশ্ব অবাক হয়ে দেখল। জেনে রেখো, তোমার গর্বে গর্বিত হই আমি। আমাকে নিশ্চয় তুমি হতাশ করবে না!  

    ইতি

    টেস্ট ক্রিকেট