• " />

     

    ফিল হিউজকে মনে পড়ে...

    ফিল হিউজকে মনে পড়ে...    

    “ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের
    নক্ষত্রের রাতে;
    তখনো যৌবন প্রাণে লেগে আছে হয়তো বা
    -আমার তরুণ দিন”
    জীবনানন্দ দাশ
     

    ****
    রাত যায়, ভোর আসে। সূর্য ডোবে, আবার উঠে। এ এক অদ্ভুত চক্র। নিত্যদিনই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, তবুও পূর্ব দিগন্তে সেই একই সূর্যের পুনরুত্থান যেন নতুনত্বের কোন আবাহনই শুনিয়ে যায়। গোধূলী বেলায় সূর্যাস্তের লালিমা রেখা যেন জানিয়ে দিতে চায়, নতুন দিনে নতুন রঙে সে আবার ফিরে আসবে। আঁধারে আচ্ছন্ন পৃথিবীকে সাজিয়ে তুলবে নুতন আলোকে। ততক্ষণের জন্য চাঁদ পায়, ধরণীকে স্নিগ্ধ দীপ্তিতে সাজানোর দায়িত্ব।
    সূর্য-চন্দ্রের এই পালাবদলের চক্র চলতে চলতে কবে যে সময় গড়িয়ে যায়, দিন-সপ্তাহ-মাস পেরিয়ে কবে যে বছরও পেরিয়ে যায়, টেরই পাওয়া যায় না! এই যে টগবগে-প্রাণোচ্ছল তরুণ ফিলিপ হিউজের ইহলোক ত্যাগের দুই বছর হয়ে গেল, আপনি কি ঠিক টের পেয়েছেন? কী জানি, হয়তো পেয়েছেন হয়তো পাননি!
    মাত্র তিনটি দিন পরই তাঁর ২৬ পেরোনোর কথা ছিল। কিন্তু সুনীলের ‘কেউ কথা রাখেনি’র মতো তিনিও কথা রাখতে পারেননি। চিরকেলে ঘুমে চলে গেছেন সব ছেড়ে-ছুঁড়ে কোন সুদূর অজানা গন্তব্যে।

    ***
     
    “রাজাসনে বসি হওনি ক’ রাজা,
    রাজা হলে বসি হৃদয়ে,
    তাই আমাদের চেয়ে তুমি বেশী
    ব্যথা পেলে তব বিদায়ে।
    আমাদের শত ব্যথিত হৃদয়ে
    জাগিয়া রহিবে তুমি ব্যথা হয়ে”
    -
    কাজী নজরুল ইসলাম
     ***
     
    অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেট-অবকাঠামো জগৎসেরা। সেখান থেকে বাছাই করে যে জাতীয় দল গঠন করা হয়, সে তো সেরা হতে বাধ্য। জেমি সিডন্স, স্টুয়ার্ট ল’র মতো খেলোয়াড়েরা ঠিকমতো জায়গা পাননি, ওদের জাতীয় দলে। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেই দিনাতিপাত করেছেন। মাইক হাসির মতো প্রতিভাবানরা জায়গা পেয়েছেন, ত্রিশের কোটায় পৌছে। কেউ একটু ভালো খেললেই তাকে নামিয়ে দাও- নীতিতে বিশ্বাসী নয় ওদের ক্রিকেটের অভিভাবক ‘ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া’। বরং যাছাই-বাছাই করে, ভালোমতো ক্রিকেট-সামর্থ্য বিচার বিশ্লেষণ করে, তবেই ওরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাঠায় ওদের খেলোয়াড়দের।
    তবে অসম্ভব প্রতিভাধর হলে নিয়ম শিথিল যোগ্য বটে! সেসব ক্রিকেট-জহর বাছাইয়ের জন্য আছে ওদের পাকা জহুরীরা। যারা রিকি পন্টিংদের তুলে আনেন, বিশ্বমঞ্চে নামিয়ে দেন অল্প বয়সেই। অসম্ভব প্রতিভাধরদের স্থান তো বিশ্বের বৃহত্তর আঙিনায়। ওরা কেন ঘরোয়া ক্রিকেটের গলি-ঘুপচিতে মাথা ঠুকরে মরবে?
    ঠিক সেজন্যেই ফিলিপ হিউজকেও কুড়ি বছর বয়সেই নামিয়ে দেয়া হয়েছিল, বিশ্ব ক্রিকেটের রুক্ষ উঠোনে। তিনি যে রিকি পন্টিংয়ের পর ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সেরা আবিস্কার। তাকে কি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে মাথা খুঁড়ে পড়ে থাকা মানায়?
    জীবনের প্রথম পরীক্ষাতেই দক্ষিন আফ্রিকা সফরে, উত্তীর্ণ হয়েছিলেন অসাধারণ প্রতিভার প্রমাণ দিয়ে। জয় করে নিয়েছিলেন ক্রিকেট-পিয়াসীদের আত্না, আসন গ্রহন করেছিলেন তাদের হৃদয়-সিংহাসনে।

     

     

    ***
     
    “কোটি কোটি ছোটো ছোটো মরণেরে লয়ে
    বসুন্ধরা ছুটিছে আকাশে,
    হাসে খেলে মৃত্যু চারিপাশে।
    এ ধরণী মরণের পথ,
    এ জগৎ মৃত্যুর জগৎ।”
    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
     
    নদীর জোয়ার-ভাটার মতো জীবনে থাকে উত্থান-পতন। তাই ফিলিপ হিউজও শুরুর সে শীর্ষ-ছোঁয়া অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। জীবনের স্বাভাবিক গতির জোয়ার তাকে অবনমিত করেছিল, সেই উচ্চাসন থেকে। দূর্ভাগ্যের জোয়াল তাকে একটা সময় সুযোগ দেয়নি দলের আশে পাশে থাকারও। কিন্তু অদম্য-মনোবল তাকে পিছু হটতে দেয়নি। তিনি আবার ফিরেছেন, পরিশ্রম করেছেন, দ্বাদশ ব্যক্তি হয়ে পরমানন্দে দলের জন্য খেটেছেন, খেলেছেন দলের চাওয়া অনুযায়ীও।
    সেদিনও দলে ফেরার কঠিন অধ্যাবসায়ে নিযুক্ত ছিলেন। রাজ্য দল নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে খেলছিলেন, বুভুক্ষের মতো রান করছিলেন, নির্বাচকদের সুদৃষ্টির জন্য। ব্যাগি গ্রীন ক্যাপটি মাথায় তোলার জন্য।
    হায়, নিয়তি! তাঁর সেই অবিচল লক্ষ্যের নির্মম পরিণতি দিয়ে সমাপ্তি হলো, তাঁর দলে ফেরার দৃঢ় সংকল্পের সেই লড়াই। তাঁর আজন্ম অপরাজেয় মানসিকতা হয়তো অপরাজেয় ছিল, কিন্তু নশ্বর দেহটুকু যে মানল না। স্বীকার করে নিল পরাজয়। সতীর্থ, বন্ধু, শুভাকাংখী, স্বজন, ক্রিকেটানুরাগী, তাঁর সমর্থক... সবাইকে নোনাজলে সিক্ত করে তিনি নিশ্চল হয়ে গেলেন, সব লড়াইয়ের ইতিও বুঝি টেনে দিলেন।

    ***
     
    বার্নস-ওয়ার্নার, ওয়ার্নার-মার্শ, রজার্স-ওয়ার্নার, খাওয়াজা-রেনশ। গত দু’বছরে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট চারটি ওপেনিং জুটি দিয়ে চেষ্টা করেছে, যেন একটা নির্ভরযোগ্য উদ্বোধনী জোড়া পাওয়া যায়। এখনও জোড়া খুঁজছে, পায়নি।
    আজ যদি তিনি থাকতেন তবে কি এত খোঁজাখুঁজির দরকার পড়ত? নিউ সাউথ ওয়েলসের তিন বন্ধু ওয়ার্নার-হিউজ-স্মিথ মিলে কি অস্ট্রেলিয়ান টপ অর্ডারের অস্থিতিশীলতা কাটিয়ে দিতে পারতেন না? অজি-ক্রিকেটের আকাশে-বাতাসে কি এক অব্যক্ত আকুতি গোমরে কাঁদছে? সেখানে কি দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করে কারও জন্য হাহাকার চলছে?
    কে জানে!
     
    স্বর্ণযুগের বাংলা সিনেমার একটি গানের একটি শব্দের পরিবর্তন করে যদি বলা হয়...
    “ক্রিকেট ভুবন ভরিয়ে দেবে ভেবেছিল একটি পাখি
    হঠাৎ বুকে বিঁধল যে তীর স্বপ্ন দেখা হল ফাঁকি।”
     
    ভাল থাকুন, হিউজি!