• " />

     

    ক্লদ ম্যাকালেলেঃ মাঝমাঠের ইঞ্জিন রুম

    ক্লদ ম্যাকালেলেঃ মাঝমাঠের ইঞ্জিন রুম    

    ধরুন, আপনি কোনো রেস্তোরাঁয় খেতে গেলেন। খাবার মুখে তুলতেই তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসলো আপনার। পরবর্তীতে রেস্তোরাঁটি সম্পর্কে আপনার মতামত হবে, “সেখানকার খাবার অসধারণ”। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছেন কি, খাবারটা যে রাঁধলো, তার সুনামই ক'জন করলো? আপনার পাতে তৃপ্তিদায়ক খাবার পরিবেশনের মূল কৃতিত্বটা যার, দিনশেষে সেই পাচকই কিন্তু থেকে যান পর্দার আড়ালে। আর বাহবার প্রায় পুরোটাই জোটে ওই রেস্তোরাঁর কপালে!

    ফুটবলে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের অবস্থাও বলতে গেলে রেস্তোরাঁর পাচকদের মতোই। না পুরোপুরি রক্ষণভাগের খেলোয়াড়; না আক্রমণভাগের। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের মূল কাজটা কিছুটা অদ্ভুতই বটে। তাতে কোনো জৌলুস নেই। সহজেই দর্শকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার এক অদ্ভুত গুণ আছে এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের! আদতে প্রতিপক্ষের আক্রমণ সামলাতে ডিফেন্ডারদের সাহায্য করা, আবার সামনের খেলোয়াড়দের বল জোগান দেওয়া- সব ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চটাই দিতে হয় এই ‘কলুর বলদ’দের। প্রাপ্য বাহবাটা বলতে গেলে কখনোই পাননা তারা। তবে পর্দার আড়ালে থাকা এই কুশলীবদেরই একজন ফুটবলে এমন প্রভাব ফেলেছিলেন, যার বদান্যতায় ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডাররাও এখন আসেন স্পটলাইটে, প্রচ্ছদে। নাম তার ম্যাকালেলে, ক্লদ ম্যাকালেলে। ফুটবল ইতিহাসে মাত্র দুজন এমন কিছু করতে পেরেছিলেন। তাঁদের একজন ইয়োহান ক্রুইফ, আরেকজন এই ম্যাকালেলে! মাঠে ক্রুইফের নেয়া টার্নের নামই হয়ে গিয়েছিল 'ক্রুইফ টার্ন'। ম্যাকালেলে অবশ্য কোনো কৌশল নিজের নামে স্বত্বায়িত করাতে পারেননি। তবে যে পজেশনে তিনি খেলতেন 'শুধু' সে জায়গাটার নামই বদলে ফেলেছিলেন। ‘দ্য ম্যাকালেলে রোল’ -নামে চেনে যাকে সবাই!


     

    ম্যাকালেলের ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল বেশ চমকপ্রদ। ১৯৮৯ সালের কথা। ফ্রান্সের ব্রিট্যানি অঞ্চলের ব্রেস্ট-আর্মোনিকের হয়ে খেলছিলেন ম্যাকালেলে। ফ্রান্সের নঁত ক্লাবের তৎকালীন স্পোর্টিং ডিরেক্টর রবার্ট বুদজিন্সকি খেলা দেখতে মাঠে গেলেন একদিন। ম্যাকালেলের খেলায় এতটাই মজলেন যে, ক্লদকে দলে ভেড়াতে একেবারে উঠেপড়ে লাগলেন তিনি। প্রথমবার ব্যর্থ হলেও ’৯১-এ ঠিকই জয়ী হন বুদজিন্সকি। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬- এই পাঁচ বছরে ফ্রেঞ্চ লিগ জেতার পাশাপাশি ম্যাকালেলের শেষ মৌসুমে (’৯৫-’৯৬) চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিতেও গিয়েছিল নঁতে। জুভেন্টাসের কাছে স্বপ্নভঙ্গের পর সেল্টা ভিগোতে পাড়ি জমান ম্যাকালেলে। স্পেনে ধারাবাহিকতার পুরষ্কারস্বরূপ মৌসুম দুয়েক পর তাকে কিনে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ। ইউরোপের অন্যতম বড় ক্লাবের হয়ে বিশ্বদরবারে জাত চেনানোর সুযোগটা হেলায় ফেলেননি ‘ম্যাকা’।


     

    ম্যাকালেলের দলবদল নিয়েও কম জলঘোলা হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই দলের সেরা তারকাকে ছাড়তে নারাজ সেল্টা, কিন্তু ম্যাকালেলের প্রত্যাশিত বেতন দেওয়ার সামর্থ্যও ছিল না ক্লাবটির। ম্যাকালেলেও সাফ জানিয়ে দিলেন, বেতন না বাড়ালে থাকছেন না। ফলশ্রুতিতে হার মানতে হল নিরূপায় সেল্টাকে।

    মাত্র তিন বছর থাকলেও রিয়ালের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ম্যাকালেলে। জিদান, ফিগোদের তারকাখচিত দলটির মূল চালিকাশক্তি ছিলেন ম্যাকালেলে। ম্যাকালেলের সময় টানা দু'বার লা লিগা জিতেছিল রিয়াল। ’০১-’০২ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগটাও জেতেন ‘লস ব্লাঙ্কোস’দের হয়ে। রিয়ালের হয়ে ক্যারিয়ারটা যতটা মধুর ছিল, বিদায়টা ছিল ঠিক ততটাই অপমানের।

    ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করার পরও ম্যাকালেলের বেতনটা ছিল অন্যদের থেকে ঢের কম। মাঝমাঠের মূল চালিকা শক্তি হলে কী হবে? আলো কাড়বার সেই ক্ষমতা তো আর একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের নেই! জিদান, ফিগোরা প্রতি সপ্তাহের বেতনই ছিল ম্যাকালেলের মাসিক বেতনের প্রায় সমান। ‘০২-’০৩ মৌসুম শেষে দেল বস্কের অপ্রত্যাশিত বিদায়ের পর সতীর্থদের কথায় প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের কাছে বেতন বাড়ানোর দাবি তোলেন ‘ম্যাকা’। পেরেজ ব্যবসাটা ভালো বুঝলেও তাঁর ফুটবল জ্ঞানটা যে সে আমলেও গড়পড়তা মানেরই ছিল- তার প্রমাণ মেলে পরের ঘটনায়।  ম্যাকালেলের সেই আবেদন সাফ নাকচ করে দেন রিয়ালের প্রেসিডেন্ট।

    রাগে-দুঃখে ক্লাবই ছেড়ে দেন ম্যাকালেলে। পেরেজের এমন সিদ্ধান্তে সমর্থকদের পাশাপাশি ক্ষুদ্ধ হন খেলোয়াড়রাও। হিয়েরো থেকে মরিয়েন্তেস- সবার কথা ছিল একটাই, রিয়ালের একমাত্র অপরিহার্য সদস্য হলেন ম্যাকালেলে। চেলসিতে পাড়ি জমানোর পর পেরেজ ম্যাকালেলের সম্পর্কে বলেছিলেন, “ম্যাকালেলেকে আমরা মিস করবো না। ওর টেকনিক একেবারেই সাধারণ; গতি ও ড্রিবলিং ক্ষমতার কোনোটিই নেই তার। তার অধিকাংশ পাস তিন মিটারের বেশি যায় না। ওর জায়গায় অন্য কোনো মিডফিল্ডার ঢের ভাল করতে পারবে”। ম্যাকালেলের বিদায়ের পর জিদান দুঃখ করে বলেছিলেন, “আপনার বেন্টলি গাড়িতে আরেক পরত সোনালী রং লাগিয়ে লাভটা কি যদি আপনি পুরো ইঞ্জিনটাই হারান?”

    ম্যাকালেলে ক্লাব ছাড়ার পরের তিন বছর কোনো শিরোপা জিততে পারেনি রিয়াল। টানা ৬ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ষোলই পার করতে পারেনি ‘লস ব্লাঙ্কোস’রা। ওদিকে চেলসিতে প্রথম মৌসুমে তেমন সুবিধা করতে না পারলেও মরিনহো আসার পর থেকেই ইংল্যান্ডও দেখতে থাকে ম্যাকালেলে জাদু। বালাক, ল্যাম্পার্ডদের নিয়ে গড়ে তোলেন সেসময়ের অন্যতম সেরা মিডফিল্ড। এসব দেখে পেরেজ পরে কতোটুকু আফসোসে পুড়েছিলেন তা অবশ্য জানা যায় না!



     

    ম্যাকালেলের আগে ৪-৩-৩ ফরমেশন বা ফুটবলে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের অবদান- কোনোটিই সম্পর্কে তেমন ওয়াকিবহাল ছিল না ইংলিশ ফুটবল। ৪-৪-২ এ বুঁদ হয়ে থাকা বিশ্বসেরা লিগটিকে যেন নতুন করে ফুটবল শেখালেন মরিনহো ও ম্যাকালেলে। ফুটবলীয় ‘মাস্টারমাইন্ড’ এই জুটির হাত ধরে অর্ধশতক পর লিগ শিরোপা ঘরে তোলে চেলসি। ম্যাকালেলেতে মুগ্ধ ইংলিশ মিডিয়া ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড রোলটিকে নাম দেয় ‘দ্যা ম্যাকালেলে রোল’। দুর্দান্ত স্ট্যামিনার কারণে ‘ত্রিপদী’ এবং ‘ব্যাটারি’ উপাধিতে অধিষ্ট হন সমর্থকদের কাছে। চেলসিতে সাফল্যের পাঁচ মৌসুম শেষে পিএসজিতে চলে যান এই মিডফিল্ডার। ভিনদেশী খেলোয়াড়কে অশ্রুসজল বিদায় দেওয়ার এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে ছিল চেলসিতে ম্যাকালেলের শেষ ম্যাচ।

    ম্যাকালেলে রোলটা সবচেয়ে ফলপ্রসূ হয় ৪-৩-৩ ফরমেশনে। এক্ষেত্রে ৩ জন মিডফিল্ডারের একজন থাকেন ডিফেন্সের ঠিক সামনে, যার কাজ হল ডিফেন্স পাহারার পাশাপাশি আক্রমণভাগে পাস বাড়ানো। প্রতিপক্ষ আক্রমণে থাকলে ম্যাকালেলের কাজ ছিল ট্যাকেল করে বল কেড়ে নেওয়া, প্রতিপক্ষের আক্রমণ রুখে দেওয়া। বল পেয়ে নিজ দলের প্রতি আক্রমণ শুরু করা বা আক্রমণভাগে জিদান, ফিগো এবং পরবর্তীতে ল্যাম্পার্ড, দ্রগবাদের পাস বাড়ানো। ম্যাকালেলে যে কাজটা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে করেছিলেন, তিনি থাকাকালীন রিয়াল এবং চেলসির দলীয় সাফল্যই তা প্রমাণ করে। 'দ্যা ম্যাকালেলে রোল'টা ফুটবলবিশ্বকে হাতে কলমে বুঝিয়েছিলেন হোসে মরিনহো। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, "দেখুন, ৪-৩-৩ ফরমেশনে আমাদের মিডফিল্ড ত্রয়ী থাকে। ম্যাকালেলে, ল্যাম্পার্ড, বালাক। ৪-৪-২ এ খেলা প্রতিপক্ষের বিপক্ষে আমার সর্বদা মধ্যমাঠে একজন খেলোয়াড় বেশি থাকবে। ম্যাকালেলেকে সাধারণত চার্জ করা হয় না, সেক্ষেত্রে তিনি পুরো মাঠটা ব্যাপী খেলতে পারেন। তাঁকে চার্জ করা হলে ল্যাম্পার্ড, বালাকদের একজন আক্রমণে ফাঁকা জায়গা পাবেন। মধ্যমাঠের তিনজনকেই চেপে ধরলে উইঙ্গার ও ফুলব্যাকরা জায়গা পাবে। এই কৌশলগুলোই অনন্য করে তুলেছিল ম্যাকালেলের ওই রোলটা।

    ক্লাব ক্যারিয়ারের পাশাপাশি জাতীয় দলেও কিংবদন্তীতুল্য ছিলেন ‘ম্যাকা’। ’৯৫-এ আন্তর্জাতিক অভিষেক হলেও ’৯৮ বিশ্বকাপ ও ’০০ ইউরো দলে জায়গা করে নিতে পারেননি ম্যাকালেলে। ২০০১ থেকে ২০০৮-এ অবসরের আগ পর্যন্ত দলের অন্যতম প্রধান নাম ছিল ম্যাকালেলে। ’০৪ সালে একবার অবসর নিলেও দেশের কাকুতি-মিনতিতে বছরখানেক পর জিদানের সাথে অবসর ভেঙ্গে জাতীয় দলে ফেরেন তিনি। '০৬ বিশ্বকাপে একে একে স্পেন, ব্রাজিল, পর্তুগালকে হারিয়ে ফ্রান্সকে ফাইনালে নিয়ে যাবার অন্যতম কারিগরও ছিলেন তিনি। ’০৮ ইউরোতে ফ্রান্সের গ্রুপপর্বে বিদায়ের পর ‘লা ব্লুজ’দের হয়ে ১৩ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টানেন ম্যাকালেলে।

    গতি, ড্রিবলিং জাদু, অসাধারণ হেডিং ক্ষমতা- কোনোটই ছিল না তাঁর। কিন্তু এরপরও রিয়াল মাদ্রিদের ‘এল গ্যালাকটিকোস’ এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ছিলেন তিনিই। অল্পদিনেই হয়ে উঠেছিলেন চেলসির ‘ইঞ্জিন রুম’। একজন দর্শক হিসেবে আপনি কখনোই ম্যাকালেলের অপরিহার্যতা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারবেন না। কিন্তু ক্যাসিয়াস থেকে শুরু করে ভিয়েরা, জিদান- সবাই জানতেন ঠিক কতটা অসাধারণ ছিলেন এই ‘মিডফিল্ড জেনারেল’। ম্যাকালেলের কারণেই হালের ক্যাসেমিরো, ভিদাল, কান্তে, বুস্কেটসরা এতটা লাইমলাইট পাচ্ছেন। এ যুগের প্রায় সব ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডাররাই এক কথায় 'গুরু' মানেন ম্যাকালেলেকে।

    গোল, অ্যাসিস্টের খেলায় ‘কিন্সহাসা ত্রিপদী’ আজীবন ছিলেন অবহেলিতদের খাতায়, কিন্তু ক্লাব ছাড়ার পর জিদানের মতো কিংবদন্তীর কান্নাই জানান দেয়, কত বড় মাপের খেলোয়াড় ছিলেন ক্লদ ম্যাকালেলে!