• চ্যাম্পিয়নস লিগ
  • " />

     

    সিনেমায় যেমন হয়!

    সিনেমায় যেমন হয়!    

    মেসি ছুটলেন। গোলপোস্ট পেরিয়ে যাবার সময় পেছনে ফেললেন প্যারিস সেইন্ট জার্মেই’এর খেলোয়াড়দের, যারা তখন লুটিয়ে আছে মাঠের ঘাসে। আর মেসি যখন দৌড়ছেন দর্শকদের দিকে, তার ক্লাব সতীর্থরা ছুটছেন সার্জিও রবার্তোর কাছে। সেই রবার্তো, কষ্ট কল্পনায়ও কেউ ভাবেনি এই অবিশ্বাস্য রাতের শেষ নায়ক হতে হবে যাকে।

    কিন্তু লিওনেল মেসি কোথায়? তিনি ততক্ষণে চলে গেছেন মাঠের কোণায়, পা তুলে উঠে দাঁড়িয়েছেন বিজ্ঞাপনের বোর্ডে, দুপাশে হাত ছড়িয়ে দিয়েছেন ফুটবল ঈশ্বরের দিকে। কয়েক সেকেন্ডের বিরতি, নাটকীয় ভাবে মেসি তারপর নিজেকে ছেড়ে দিলেন মানুষের মাঝে। সেইসব ফুটবল পূজারী মানুষ, সারা জীবনে গল্প করার মতো একটা ম্যাচের দেখা পেয়ে যারা এতোক্ষণে এমন বিহবল; যে হুঁশ তো হুঁশ, গায়ের জামা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে অনেকে। আর একটু পেছন দিকে তাকালে দেখা যাবে বার্সেলোনার ডাগআউটে- কোচ বলো আর মেডিকেল স্টাফ বলো- কেউ নেই। শান্তিনগর মোড়ে জমে ওঠা জলের মতো গতিতে তারা ততক্ষণে পৌঁছে গেছে মাঠে। তাদের চিৎকার আর উল্লাস তীব্র গতিতে মিশে মিশে যাচ্ছে পায়ের নিচের ঘাস থেকে কাতালোনিয়ার আকাশে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে তো বটেই, ফুটবল ইতিহাসেও সম্ভবত, এর চেয়ে ভালো সিনেমার চিত্রনাট্য পাওয়া যাবে না।      

    কিন্তু চিত্রনাট্য তখনো জমাট  বাঁধেনি, ম্যাচ শেষেও ন্যু ক্যাম্প গলে গলে পড়েছে তার ছিয়ানব্বই হাজার দর্শক নিয়ে। এই উন্মাদেরা স্বাধীন কাতালোনিয়ার পতাকা ওড়াচ্ছে,  বার্সেলোনার অফিসিয়াল থিম সং গাইছে। মানুষের এই মনুমেন্টের কাঁপুনি থামলো খেলা শেষ হবার অন্ততঃ বিশ মিনিট পর। বার্সেলোনা কি বিশ্বকাপ জিতলো, না টুর্নামেন্ট? নাহ, তারা একটা ম্যাচই জিতেছে কেবল, ব্যবধান যদিও ৬-১। কিন্তু এই এক জয়েই ঐ মানুষ মনুমেন্ট তো বটেই, ইউরোপ শুদ্ধ কেঁপে গেছে। 

    তিন সপ্তাহ আগে ফিরে যাই। মিডনাইট ইন প্যারিসে বার্সেলোনা পিএসজি’র কাছে বিধ্বস্ত হয়েছে ৪-০ তে। প্রথম লেগে এতো বড় ব্যবধানে হেরে পরের রাউন্ডে যাওয়ার ইতিহাস নেই কারো। তার চেয়ে বড় কথা, পিএসজি একেবারে হাতে ধরে দেখিয়ে দিয়েছে লুইস এনরিকের বার্সেলোনার দুর্বলতা। এই উন্মোচনে এনরিকের হতাশা বাড়ে, এবং অল্প কদিন পরেই আমরা দেখতে পাই এনরিকে জানাচ্ছেন- মৌসুম শেষে ক্লাব ছাড়ছেন তিনি, কারণ এই চাকরি বড় ক্লান্তিকর, খুব বেশি দাবি করে চাকুরের।

    হঠাৎ তাই মনে হচ্ছিলো, বার্সেলোনার দিন ফুরোলো। সেই বার্সেলোনা, এখনো পর্যন্ত যারা একবিংশ শতাব্দীর সেরা ফুটবল ক্লাব, গত এক যুগে যারা চ্যাম্পিয়ন লিগ জিতেছে চারবার, এবং গত নয় বছর ধরে এই প্রতিযোগিতার কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত তাদের ‘প্রেজেন্ট প্লিস!’ অবধারিত।

    তবে সময় তো থেমে থাকে না। সর্বজয়ী দলটার স্বর্ণযুগের দুই সারথী কার্লোস পুয়োল আর জাভি হার্নান্দেজ ইতোমধ্যেই ক্লাব ছেড়েছেন। মেসি-সুয়ারেজ আর বুস্কেটস চলে গেছেন ত্রিশের দিকে, ইনিয়েস্তা আর পিকে তো সেটা ছাড়িয়েই গেছেন। লর্ড ভোল্ডেমর্টের মতো বার্সেলোনার যাদুর কাঠিতেও ফাটল ধরেছে গার্দিওলা যুগের সমাপ্তির পর। তার উত্তরসূরি লুইস এনরিকে চেষ্টা করেছেন আরেকটু সরাসরি খেলার,  হলি ট্রিনিট্রি মেসি-সুয়ারেজ-নেইমারে সেই চেষ্টা সফলও হয়েছে। কিন্তু এটাও সত্যি, বার্সেলোনার ইঞ্জিন তার সেরা সময় পেছনে ফেলে এসেছে। এ গাড়ি আর চলে না।

    প্যারিস সেইন্ট জার্মেই’এর কাছে প্রথম লেগে হজম করা এক হালি গোল তাই একরকম স্পষ্ট করে দিয়েছে, বার্সেলোনার পরিবর্তন দরকার। দরকার নতুন কোচ, নতুন খেলোয়াড়। তিন সপ্তাহ আগের ভ্যালেন্টাইন দিবসে প্যারিসের ওই কালো রাত বার্সেলোনার শুধু আরো একটা ইউরোপ অভিযানই শেষ করে দেয়নি, তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোকিত অধ্যায়টাও থেমে গেছে ওখানে।

    গত রাতের শেষ আধঘন্টায়, এই কথাটাই আবার প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাচ্ছিলো প্রায়।

    অথচ ম্যাচের প্রথম ষাট মিনিটে সব চলছিলো বার্সেলোনার ইচ্ছে মাফিক। পরের রাউন্ডে যাবার আশাটাও বেঁচে ছিলো ভালোমতোই। খেলার শুরুতেই সুয়ারেজের গোল, ইনিয়েস্তার কারিকুরিতে কুরোযাওয়া’ও একবার বল জড়ালেন নিজের জালে, পেনাল্টিতে মেসি এনে দিলেন তিন নাম্বার। এরপর বার্সেলোনার দরকার ছিলো একটা, আর মাত্র একটা গোল। উন্মাতাল ন্যু ক্যাম্প তখন স্প্যানিশে ফিরিয়ে এনেছে বারাক ওবামার মুখের কথা,‘ইয়েস উই ক্যান, ইয়েস উই ক্যান!’

    আর তারপরেই সব উল্টেপাল্টে গেলো।

    সেকেন্ড লেগের শুরু থেকেই বার্সেলোনার- আসলে সকলেরই- জানা ছিলো, একটা ভুল পাস, একবার মাত্র পা পিছলানো, মনোযোগে একটা ফাটলই তাদের বিদায়ের জন্য যথেষ্ট। অ্যাওয়ে গোলের এই বিপজ্জনক হিসাবটা পিএসজি’র হয়ে মিলিয়ে দিলেন এডিসন কাভানি, আর ন্যু ক্যাম্পে হানা দিলো জে কে রোলিং-এর ডিমেন্টরেরা। মুহুর্তে লাখ খানেক মানুষের সমস্ত বিশ্বাস আর শব্দ, গুঁড়ো হয়ে গেলো একসাথে। জিততে হলে বার্সার এবার দরকার তিন গোল, আধঘন্টায়।

    স্প্যানিশ দৈনিকেরা কী লিখেছিল খেলার আগে? লিখেছিল, মেসি আছে- তাই আশাও আছে। বলা হচ্ছিল, দুনিয়ার কোনো দল যদি চার গোলে পিছিয়ে থেকেও পরের লেগে জিততে পারে, তবে সেই দলটি বার্সেলোনাই। তা কাগজে কলমে অমন কথা বলাই যায়। পিএসজি’কে বার্সেলোনা গুণে গুণে চার গোল দেবে, পাঁচটাও দিতে পারে, আর নিজেরা কোনো গোল না খেয়ে ড্যাংড্যাং করে চলে যাবে পরের রাউন্ডে- এই আশা তাও করা যায়। কিন্তু পিএসজির মতো প্রতিপক্ষকে শেষ ত্রিশ মিনিটে তিন গোল দিয়ে জিতবে বার্সা, এই ইচ্ছাপূরণ তো শুধু অসম্ভব নয়, অসম্ভবের বাপ!

    কিন্তু ন্যু ক্যাম্প কাল হয়ে গেলো সেই অসম্ভবের হগওয়ার্টস, নেইমার যার হ্যারি পটার। ৮৮ মিনিটে যাদুকরী এক ফ্রি-কিকে গোল করলেন, অল্প পরেই ঠান্ডা মাথায় পেনাল্টিতে করলেন দলের পঞ্চম গোল। মঞ্চ প্রস্তুত হলো শেষ পাঁচ মিনিটের জন্য।

    পাঁচ মিনিটের ইনজুরি টাইম, পাঁচ মিনিটে দরকার আরো একটা গোল। সেই পাঁচ মিনিট, এনরিকে যেটাকে ম্যাচ শেষে বললেন, ‘সিনেমা দেখছিলাম মনে হচ্ছে। কিন্তু থ্রিলার না, একেবারে হরর সিনেমা!’

    পোস্ট ছেড়ে বেরিয়ে এলেন বার্সেলোনার গোলকি টার স্টেগেন পর্যন্ত, আশায় ভর করে। একের পর এক ক্রস উড়ে যেতে লাগলো পিএসজি’র বক্সের দিকে, আশায় ভর করে। সার্জিও রামোসের নির্ঘুম রাতজাগা চোখ আর ফুটবল বোদ্ধাদের যাবতীয় বিশ্লেষণ হাওয়ায় উড়ে গিয়ে ন্যু ক্যাম্পে তখন শুধু আশাই থাকলো। চাহিদা নয়- সেই পর্যায় এই ম্যাচ পেরিয়ে এসেছে বহু আগেই- শুধু আশা।

    এরপর একটা ক্রস, একটা ফ্লিক, সার্জিও রবার্তোর বাড়িয়ে দেয়া বুট, বলের জালে জড়ানো, পিএসজি’র খেলোয়াড়দের হাঁটু ভেঙে মাঠে শুয়ে পড়া, বার্সেলোনা ডাগআউটের মাঠে ছুটে যাওয়া, লিওনেল মেসির বিজ্ঞাপনী বোর্ডে উঠে দাঁড়ানো এবং ঈশ্বরের দিকে তাকিয়ে মানুষের স্রোতে ঢলে পড়া। এই স্বপ্নের গল্প তো শুরুতেই বলা হয়েছে। 

    কিন্তু স্বপ্নেও এমনটা হয় নাকি? স্বপ্ন এতো স্পষ্ট হলো কখন, স্বপ্ন এতো নাটকীয় হলো কবে থেকে? স্বপ্নে কখন মিলে যায় এরকম অলৌকিক গণিত?

    এমনতো হয় সিনেমায়!

    [নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত রোরি স্মিথের ‘Like a Film’: Barcelona Stuns Paris St.-GermainWith Champions League Rallyঅবলম্বনে]