• " />

     

    সেদিনের এই দিনে: তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানোর দিন

    সেদিনের এই দিনে: তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানোর দিন    

    ১৪ মার্চকে ইতিহাস কীভাবে মনে রাখবে? আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্মদিনের কথা চট করে মাথায় চলে আসতে পারে। তবে ২২ গজে এই দিন মানে হাল ছেড়ে না দেওয়ার, দাঁতে দাঁত কামড়ে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাওয়ার। কলকাতা, কিংস্টন বা মোহালিতে যে গল্প লেখা হয়েছিল, সেটা তো জীবনের ২২ গজের জন্যই হয়ে থাকবে নিরন্তর প্রেরণা।

    কলকাতার গল্পটা নিয়েই মহাকাব্য লিখে ফেলা যাবে। ২০০১ সালে প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ৪৪৫ রানের পর ভারত অলআউট হয়ে গিয়েছিল ১৭১ রানে। ফলো অনে পড়ে আবার ব্যাট করতে নেমে ১১৫ রানে হারিয়ে ফেলেছে ৩ উইকেট। সৌরভ গাঙ্গুলী ও রাহুল দ্রাবিড় একটু প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিলেন, তবে তৃতীয় দিনের শেষ বিকেলে গাঙ্গুলীর আউটের পর পরাজয়টা মনে হচ্ছিল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু লক্ষ্মণ আর দ্রাবিড় ঠিক করে রেখেছিলেন, হারার আগে তারা হাল ছেড়ে দেবেন না।

    এরপর যা হলো, সেই হিস্টিরিয়ায় পরের দিন কলকাতা ছিল আচ্ছন্ন। উইলো কাঠের সব সৌন্দর্য নেমে এলো লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়ের ব্যাটে, ইডেনের প্রহেলিকাময় পিচ হঠাৎই তাদের কাছে ফেলুদার রহস্যের জট ছাড়ানোর মতো জলবৎ তরলং। পঞ্চম উইকেটে ঠিক ৩৭৬ রান করে থামলেন দুজন। লক্ষ্মণ ততক্ষণে খেলে ফেলেছেন ২৮১ রানের অবিশ্বাস্য এক ইনিংস। ভারতের রান পেরিয়ে গেছে ৬০৮। স্টিভ ওয়াহ পরে বলেছিলেন, লক্ষ্মণের মতো ব্যাট করতে আর কাউকে দেখেননি। ১৬ বছর আজকের এই দিনে যখন লক্ষ্মণ-দাবিড় মাঠ ছাড়ছিলেন, ইডেন গার্ডেন বুঁদ ভীষণ অসম্ভবের স্বপ্নে।

    সেই স্বপ্ন সত্যি করার কাজটা নিজের ঘাড়ে নিয়েছিলেন হরভজন সিং। প্রথম ইনিংসেই হ্যাটট্রিক পেয়েছিলেন, তবে ঘূর্ণির ব্রহ্মাস্ত্র জমিয়ে রেখেছিলেন শেষ দিনের জন্য। ৩৮৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করে অস্ট্রেলিয়া একের পর এক বিষে নীল, ম্যাচে হরভজন নিলেন ১৩ উইকেট। ক্রিকেট ইতিহাসে মাত্র তৃতীয়বারের মতো কোনো দল ফলো অনে পড়েও জয় পেল। কী অবিশ্বাস্য, তিনবারই সেই ফিরে আসার শিকারের নাম অস্ট্রেলিয়া! তারপরও ম্যাচটা হরভজনের নয়, ১৮০ রান করে ‘দ্য ওয়াল’ হয়ে যাওয়া দ্রাবিড়েরও নয়, ম্যাচটা ভেঙ্গিপুরাপ্পু ভেঙ্কট শ্রী লক্ষ্মণের।

    তবে লক্ষ্মণ কি প্রেরণা নিয়েছিলেন আজকের দিনে ব্রায়ান লারার ওই ইনিংস থেকে? ১৯৯৯ সালে স্যাবাইনা পার্কে লারার ২১৩ রানের ওই ইনিংসটি অবশ্য ম্যাচের প্রেক্ষাপটে লক্ষ্মণের মতো অতোটা মহিমান্বিত নয়। কিন্তু লারার জন্য তো সেটা দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর ঘুরে দাঁড়ানোর মতোই।

    সময়টা একদমই ভালো যাচ্ছিল না লারার। না নিজের, না দলের। রানের দেখা নেই অনেক দিন ধরেই, ওই ম্যাচের আগে সর্বশেষ ১৫ টেস্টে একবারও ছুঁতে পারেননি তিন অঙ্ক। শেষ সেঞ্চুরির পর কেটে গেছে দুই বছরেরও বেশি, বিশ্বাস করা যায়? অধিনায়ক হওয়ার পর দলের অবস্থাও যেন ডুবন্ত নৌকার মতো। তার আগে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের ভরাডুবির পর লারার দল নিজেদের মাঠে আতিথ্য দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে। পোর্ট অব স্পেনে ৫১ রানে অলআউট হওয়ার পর অনেকেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের এপিটাফও লিখে ফেলেছিলেন। স্যাবাইনা পার্কের টেস্ট শুধু দলের নয়, লারার নিজের জন্যও অনেক জবাব দেওয়ার।

    প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়া অলআউট হয়ে গিয়েছিল ২৫৬ রানে। স্টিভ ওয়াহ করেছিলেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। ওয়েস্ট ইন্ডিজও ৩৪ রানেই হারিয়ে ফেলেছিল ৪ উইকেট। ৫৬ রানে পেড্রো কলিন্সও যখন আহত হয়ে অবসরে গেলেন, অস্ট্রেলিয়ার লিড নেওয়াটা তখন সময়ের ব্যাপার।

    তবে জিমি অ্যাডামসকে নিয়ে লারা এরপর শুরু করলেন ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। একপ্রান্তে অ্যাডামস ছিলেন ধৈর্যের প্রতিমূর্তি, অন্য প্রান্তে লারা সুযোগ পেলেই শাসন করছেন ওয়ার্নদের। এর মধ্যে ক্যাচ দিয়েও বেঁচে গেছেন, আম্পায়ার একবার ম্যাকগিলের জোরালো আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন। তবে তুমুল নাটক হলো ৯৯ রানে এসে, রান আউট প্রায় হয়েই গিয়েছিলেন লারা। টিভি আম্পায়ার বার বার দেখেও নিশ্চিত হতে পারেননি, ‘বেনিফিট অব ডাউট’ পেয়েই লারা ছুঁলেন তিন অঙ্ক। স্যাবাইনা পার্কের উদ্বেল ক্যারিবিয়ানরা ততক্ষণে লারাকে জড়িয়ে ধরার জন্য নেমে এসেছে মাঠে।

    তবে লারার ছিল সেটা কেবল শুরু। এরপর ওয়ার্ন, ম্যাকগিলকে মাঠের ওপাড়ে আছড়ে ফেলেছেন, ম্যাকগ্রা-গিলেস্পিদের বলে খেলেছেন ট্রেডমার্ক সব শট। ২১৩ রানের ইনিংসটা তখনও পর্যন্ত সবাই লারার সেরা বলেই রায় দিয়েছিলেন। কে জানত, পরের ম্যাচেই ১৫৩ রানের ওই মহাকাব্যিক ইনিংস খেলবেন! তবে আজকের দিনটা লারা মনে রাখবেন নিজেকে ফিরে পাওয়ার, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঘুরে দাঁড়ানোর উপলক্ষ হিসেবে।

    অথচ তিন বছর আগেও এই দিনটা লারা পারলে পাকাপাকিভাবে মুছে ফেলতে চাইতেন। ১৯৯৬ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়টা যখন সময়ের ব্যাপার, সেখান থেকেই অবিশ্বাস্যভাবে ম্যাচটা হেরে বসে তারা। ২০৭ রানের লক্ষ্যে একটা সময় যখন ২ উইকেটে করে ফেলেছিল ১৬৫, আরেকটি ফাইনালের হাতছানি ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে স্পষ্ট। লারা অবশ্য তার আগেই ৪৫ রান করে আউট হয়ে গেছেন। কিন্তু সেখান থেকেই দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়াল অস্ট্রেলিয়া। এরপর ২৭ রান তুলতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারিয়ে ফেলল আরও ৮ উইকেট। শেষ ৭ ব্যাটসম্যানই আউট হয়ে গেলেন এক অঙ্কে। অস্ট্রেলিয়া লিখল আরেকটি ফিরে আসার গল্প।