বিদায় কিংবদন্তি

১৯৯০ সালের কথা। ১৩ বছর বয়সী এক ফুটবলারের খেলা দেখার জন্য স্কাউট পাঠায় ফরাসি ক্লাব মোনাকো। ওই ম্যাচে ৬ গোল করে দলকে ৬-০ গোলের জয় এনে দেন ওই খুদে খেলোয়াড়। কোন ট্রায়াল ছাড়াই মোনাকোর ইয়ুথ একাডেমীতে সুযোগ পেয়ে যান তিনি। এরপরে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক গোল করে ডিফেন্ডার-গোলরক্ষকদের ঘুম কেড়ে নেয়া ঐ খুদে খেলোয়াড়টিই আজকের থিয়েরি অঁরি। ফুটবলের জন্য আজকের দিনটি বড়ই বিষাদময়। কারণ? আজ সবধরনের প্রফেশনাল ফুটবল থেকে অবসর নেবার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
১৯৯৪ সালের ৩১ অগাস্ট মোনাকোর হয়ে প্রথম প্রফেশনাল ম্যাচ খেলেন তিনি। স্ট্রাইকার হিসেবে নাম কামালেও সূচনাটা হয়েছিল লেফট উইঙ্গার হিসেবে। ১৯৯৬ সালে তিনি ‘ফ্রেঞ্চ ইয়াং প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার’ হিসেবে মনোনীত হন। ১৯৯৬-’৯৭ মৌসুমে মোনাকোকে লীগ শিরোপা জেতাতে আর এর পরের মৌসুমে দলকে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেমি ফাইনালে পৌঁছানোতে তার ভুমিকা ছিল অনস্বীকার্য। মোনাকোর হয়ে লীগে ১০৫ ম্যাচে মোট ২০ গোল করেন তিনি।
১৯৯৯ সালের জানুয়ারীতে ইতালিয়ান ক্লাব জুভেন্টাস তাকে কিনে নেয়। কিন্তু ইতালিয়ান ডিফেন্সিভ ফুটবলের সাথে মানিয়ে নিতে পারেননি তিনি। লেফট উইঙ্গে খেলে ১৬ ম্যাচে ৩ গোল করেন তিনি।
ওই বছরেই ১১ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে তাকে কিনে নেয় আর্সেনাল। মোনাকোতে থাকাকালীন অঁরির ম্যানেজার আর্সেন ওয়েঙ্গারের সাথে পুনর্মিলনী ঘটে তার। কিন্তু আর্সেনালের হয়ে প্রথম ৮ ম্যাচে গোল করতে না পারায় ইংলিশ ফুটবলের সাথে মানিয়ে নিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে অনেক সমলোচনা হয়। সমালোচকদের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেন তিনি তার গোল দিয়ে। প্রথম মৌসুমে তিনি মোট ২৬টি গোল করেন, আর তাকে নিয়ে সব শঙ্কা উড়িয়ে দেন। ২০০১-’০২ মৌসুমে অঁরি আর্সেনালের হয়ে প্রথম শিরোপা অর্জন করেন। লীগে সর্বোচ্চ গোল করে আর্সেনালকে লীগ শিরোপা এনে দেন তিনি। ওই মৌসুমে তিনি সব মিলিয়ে করেন ৩২টি গোল। ২০০২-’০৩ মৌসুমে আবার ৩২ গোল করেন তিনি। কিন্তু এবার শুধু গোল করেই নয়, গোল করিয়েও অবদান রাখেন তিনি। ঐ মৌসুমে তিনি ২৩ টি গোল অ্যাসিস্ট করেন। লীগে এক মৌসুমে ২০টি অ্যাসিস্ট করে সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট এর রেকর্ড গড়েন, যা আজ পর্যন্ত ভাঙতে পারেনি কেউ। ওই মৌসুমে আর্সেনাল লীগ শিরোপা ধরে রাখতে ব্যর্থ হলেও ফাইনালে ‘ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ’ হয়ে আর্সেনালকে এনে দেন এফ এ কাপ।
২০০৩-’০৪ মৌসুমে ডেনিস বার্গক্যাম্প, প্যাট্রিক ভিয়েরা, রবার্ট পিরেসদের সাথে নিয়ে অঁরি আর্সেনালকে নিয়ে যান অন্য এক উচ্চতায়। ১০০ বছরের ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে আর্সেনাল পুরো মৌসুম লীগে না হেরে চ্যাম্পিয়ন হবার রেকর্ড গড়ে। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে অঁরি ঐ মৌসুমে ৩৯ গোল করেন। লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হবার পাশাপাশি তিনি ২য় বারের মত ‘পিএফএ প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার’ নির্বচিত হন। জয় করে ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট।
২০০৪-’০৫ মৌসুমে আর্সেনাল লীগ শিরোপা ধরে রাখতে ব্যর্থ হলেও অঁরি করেন ৩১ গোল। তিনি ঐ মৌসুমেও পান ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট। তিনি এখনো পর্যন্ত একমাত্র খেলোয়াড় যিনি টানা দুই বছর এটি জয় করার কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছেন।
২০০৫ সালের ১৭ অক্টোবর, থিঁয়েরি অঁরি আর্সেনালের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে নিজের নাম লেখান। ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, লীগে ১৫১ তম গোল করে আর্সেনালের হয়ে সর্বোচ্চ লীগ গোলের রেকর্ডও নিজের নামের পাশে বসান তিনি। ২০০৫-’০৬ মৌসুমে তিনি লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন, ৩য় বারের মত ‘প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার’ হন তিনি। সেই সাথে তিনি ‘ফিফা ওয়ার্ল্ড ১১’ এ জায়গা করে নেন।
২০০৬-’০৭ মৌসুমটি ছিলো তার জন্য ইনজুরি জর্জরিত এক মৌসুম। ওই মৌসুমে তিনি লীগে ১৬ ম্যাচে ১০ গোল করেন। অবশেষে ২০০৭ সালে আর্সেনালের সাথে তার এক রেকর্ডময় অধ্যায়ের সমপ্তি ঘটে। তিনি পাড়ি জমান বার্সেলোনায়।
বার্সেলোনায় তিনি ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত খেলেন। বার্সেলোনার হয়ে মোট ১২১ ম্যাচে করেন ৪৯টি গোল। ২০১০ সালে তিনি পাড়ি জমান নিউ ইয়র্ক রেড বুলসে। সেখানে ১৩৫ ম্যাচে করেন ৫২টি গোল।
২০১২ সালের ৬ জানুয়ারি ২ মাসের লোনে তিনি আবার খেলতে আসেন আর্সেনালে। এফ এ কাপে লিডস ইউনাইটেডের সাথে ম্যাচের একমাত্র গোল দিয়ে তিনি সূচনা করেন আর্সেনালে ২য় অধ্যায়ের। আর্সেনালের মাঠ এমিরেটস স্টেডিয়ামে তার শেষ ম্যাচে তিনি ৯০মিনিটের সাথে যোগ করা অতিরিক্ত সময়ে গোল করে সান্ডারল্যান্ডের বিপক্ষে জয় এনে দেন।
ফ্রান্স জাতীয় দলের হয়ে তিনি মোট খেলেছেন ১২৩ বার। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ জয়ী দলের একজন সদস্য ছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, তিনি ঐ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ গোলদাতাও ছিলেন। ২০০০ সালের ইউরো জয়ী ফ্রান্স দলের সর্বোচ্চ গোলদাতাও ছিলেন তিনি। দুই প্রতিযোগিতাতেই তিনি করেন তিনটি করে গোল। ২০০৭ সালের ১৭ অক্টোবর লিথুয়ানিয়ার সাথে ২ গোল করে ফ্রান্সের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন তিনি।
প্রতিপক্ষকে গোলবন্যায় ভাসিয়ে দেয়া এই কিংবদন্তীর বিদায় তাই পুরো ফুটবল জগতের জন্যই এক বিষাদের খবর। কিন্তু তার খেলা প্রতিটি দলের সমর্থকেরা তার প্রতি চির কৃতজ্ঞ। আর্সেনাল.কম এর এক জরিপে আর্সেনাল সমর্থকেরা থিঁয়েরি অঁরিকেই তাদের ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে মনোনীত করেন। এ তার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন নয় তো আর কি।