'বাংলার' শমিতের আকাশ ছোঁয়ার হাতছানি
কেমন আছ?
১২ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে ভেসে আসা কন্ঠটা এক মুহূর্তের জন্য ধন্দে ফেলে দিল। শমিত সোম নামটা বাঙ্গালিরই, কিন্তু উইকিপিডিয়া তো বলছে সে পুরোদস্তুর কানাডিয়ান। বাবা মা বাংলাদেশী বটে, কিন্তু তাঁর জন্ম-বেড়ে ওঠা সবই কানাডায়। সেখানে তাঁর মুখে নির্ভেজাল বাংলা কথাটা তো একটু তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতোই।
ভুলটা শমিতই ভাঙিয়ে দিলেন একটু পর। বাংলা বুঝলেও পুরোপুরি সড়গড় নন। পরে তাই কথা ইংরেজিতেই হলো। তবে বাংলায় শমিতের যেটুকু অস্বস্তি আছে, সবুজ মাঠে তার একদমই নেই। ১৯ বছর বয়সেই মেজর লিগ সকারে মন্ট্রিয়ল ইমপ্যাক্টের মতো দলে সুযোগ পেয়ে যাওয়া, কানাডা অনূর্ধ্ব ২০ দলের হয়ে এর মধ্যেই খেলে ফেলা... ফুটবলের ভাষাটা শমিত ভালোই বোঝেন।
শমিত যা করেছেন, বাংলাদেশী কোনো ফুটবলারের জন্য সেটা কল্পনা করাও কঠিন। এমএলএস যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার ফুটবলের সবচেয়ে ওপরের স্তর, শমিতের ক্লাব মন্ট্রিয়লেই তো কিছুদিন আগেও খেলে গেছেন দিদিয়ের দ্রগবা। তাঁর সাথে অবশ্য দ্রগবার দেখা হয়নি, শমিত মন্ট্রিয়লে আসার আগেই ক্লাবটির সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়ে গেছে দ্রগবার। কথা বলতে বলতে সেটা নিয়ে শমিতের যে একটু আফসোস আছে, সেটাও টের পাওয়া গেল।
ইংল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচে শমিত (ডানে)
তবে শমিত কিন্তু একটা জায়গায় আরও অনেক বড় মুখকে হারিয়ে দিয়েছেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মার্কাস রাশফোর্ড, টটেনহামের হ্যারি উইংকসকে তো ইংল্যান্ডের সবচেয়ে সম্ভাবনাময়দের শুরুর দিকেই ধরা হচ্ছে। অথচ গত বছর এই রাশফোর্ড-উইংকসদের ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই ২-১ গোলে জয় পেয়েছিল শমিতের কানাডা। কোনো প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে নয় অবশ্য, অনূর্ধ্ব ২০ জাতীয় দলের একটা প্রীতি ম্যাচে। হোক প্রীতি ম্যাচ, ইংল্যান্ডকে হারানো বলে কথা। ওপাশ থেকে শমিতের উচ্ছ্বাসটা টের পাওয়া যাচ্ছিল, 'কী যে অবিশ্বাস্য লেগেছিল তখন। সবাই খুব বলাবলি করছিল আমাদের নিয়ে। এমনিতে তো কানাডায় ফুটবল নিয়ে অত বেশি মাতামাতি নেই। কিন্তু ওই ম্যাচের পর বেশ কথা হচ্ছিল। রাশফোর্ড, উইংকসদের সাথে জিতেছিলাম তো!'
এরপর অবশ্য চোটের জন্য কনকাকাফ অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপে আর খেলা হয়নি শমিতের। ফুটবলারদের যা আততায়ী, এই চোট শমিতকে ভুগিয়েছে বেশ। মাত্রই তো দুই মাসের চোট থেকে সেরে মন্ট্রিয়লে যোগ দিয়েছেন শমিত, আবার ক্লাবের সঙ্গে অনুশীলন করেছেন। মূল দলের হয়ে এখনো খেলার সুযোগ হয়নি, মৌসুমের তো মাত্র সাতটি ম্যাচ হয়েছে। তবে শমিত আশাবাদী, পুরোপুরি ফিট হয়ে এমএলএসের অভিষেকটাও খুব শিগগির হয়ে যাবে।
শমিত অবশ্য জানেন, সেজন্য অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে। পজিশনটাই অবশ্য বেশ খাটনির, আদতে তিনি বক্স টু বক্স মিডফিল্ডার। সেই ২০১৫ সালে যখন এফসি এডমন্টনে নাম লিখিয়েছিলেন, তখন থেকেই খেলছেন মধ্যমাঠে। আক্রমণ ও রক্ষণের সেতুবন্ধ রচনাই তাঁর আসল কাজ। ফ্যাব্রিগাস, মদ্রিচ, ক্রুসরা তাঁর পছন্দের খেলোয়াড়। এঁদের মতো শমিতও হতে চান মধ্যমাঠের প্রাণভোমরা। নিজের নামের অর্থ 'দমিত' থাকা, কিন্তু শমিত নিশ্চয় মাঠে তা হতে চাইবেন না!
সেই পথে অবশ্য এখনো যেতে হবে অনেকদূর। বয়স তো মাত্র ১৯, সামনে আকাশ ছোঁয়ার হাতছানি। এখনই অবশ্য ইউরোপের কোনো বড় লিগে খেলা নিয়ে ভাবছেন না শমিত। প্রিয় ক্লাব আর্সেনাল, স্বপ্ন দেখেন একদিন গানারদের জার্সি গায়ে চড়াবেন। তবে সেটি নিয়ে কোনো তাড়াহুড়ো নেই। জানেন, সময় এখনো পড়ে আছে, আপাতত মন্ট্রিয়লেই থিতু হতে চান, নিজেকে প্রমাণ করতে চান। বয়স তো সবে ১৯!
বাংলাদেশের হয়ে খেলার কথাও চলে এলো সেই সূত্র ধরেই। বাবা-মা বাংলাদেশী, শমিত চাইলে গায়ে চড়াতে পারেন লাল-সবুজ জার্সি। সেই প্রশ্নটা করতেই এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেলেন। জানালেন, এখনই বাংলাদেশের হয়ে খেলার ব্যাপারে কিছু ভাবেননি। আপাতত কানাডার অনূর্ধ্ব-২৩ দলে সুযোগ পেতে চান, এরপর জাতীয় দলের হয়ে খেলার কথা ভাববেন। তবে 'ইটস ডেফিনেটলি আ পসিবিলিটি' বলে জানিয়ে দিলেন, সুযোগ পেলে একদিন হয়তো 'আমার সোনার বাংলা' গাইতে ফিরেও আসতে পারেন।
বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে কিছু না জানলেও বাংলাদেশটা শমিতের ভালোই চেনা। জন্মের পর তিন চার বার এসেছেন, সর্বশেষ পাঁচ বছর আগেও ঘুরে গেছেন এখান থেকে। 'অনেক ভালো লাগল কথা বলে' শুনে বোঝা গেল ভাষাটাও হৃদয়ে গেঁথে আছে ভালোমতোই। তবে ইউনিভার্সিটি অব অ্যালবার্টার ছাত্র শমিত নিশ্চয় দেশে আসার আগে দু'বার ভেবে আসবেন। রিয়াসাত, জামাল ভুইঁয়াদের অভিজ্ঞতা শুনলে বাংলাদেশের হয়ে খেলার ইচ্ছাটাও যে মরে যেতে পারে!