• চ্যাম্পিয়নস ট্রফি
  • " />

     

    চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির 'অনিশ্চিত যাত্রা'

    চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির 'অনিশ্চিত যাত্রা'    

    শচীন টেন্ডুলকারের কতো প্রতীক্ষার বিশ্বকাপটা মিলেছিল ২০১১ সালের এপ্রিলে, তার ঘরের মাঠ ওয়াংখেড়েতে। চার বছর আগে ঘরের মাঠে সুযোগটা পেয়েছিলেন ব্রায়ান লারা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টপকাতে পারেনি সুপার এইট। লারা কখনও বিশ্বকাপ জেতেননি। ওয়ানডেতে তার একটা বৈশ্বিক ট্রফির আক্ষেপ হয়তো কিছুটা হলেও ঘুচেছিল সেই বিশ্বকাপেরও বছর তিনেক আগে। ব্রাউন-ব্র্যাডশর নবম উইকেট জুটি ওভালের আঁধারে তার মুখে একটা সোনালী হাসি এনে দিয়েছিল, ব্রায়ান লারার হাতে যে সেদিন উঠেছিল একটা ট্রফি!

     

    কিংবা হ্যান্সি ক্রনিয়ের সেই ওয়ানডে দলটা! সেই অদ্ভুতূড়ে টাইয়ের ঐতিহাসিক আক্ষেপে পড়া দলটা কয়েক মাস আগেই তো জিতেছিল তখনকার মিনি বিশ্বকাপ বা এই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। নকআউট-বৃষ্টি-চোকিং এর অদ্ভুত চক্রে পড়ে এর আগে পরে কখনও বৈশ্বিক শিরোপা জেতেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। কিংবা নিউজিল্যান্ড। এইতো গত বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল বাধা পেরিয়ে গেল প্রথমবার, মাইকেল ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়ার কাছে অবশ্য বিলীন হয়ে গেছে তাদের সেরা সময়ের বিশ্বকাপ স্বপ্ন। সেই নিউজিল্যান্ডও কেনিয়াতে উঁচিয়ে ধরেছিল একটা ট্রফি। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি।

     

    ****

     

    চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি আসলে কী? লারা-ক্রনিয়ে-ফ্লেমিংদের আক্ষেপ ঘোচানোর একটা উপলক্ষ্য? নাকি একদিনের রোমাঞ্চের ধারক-বাহক ওয়ানডে ক্রিকেটের বেঁচে থাকার একটা উপায়?

     

    শুরুতে অবশ্য এটা ছিল আইসিসির ক্রিকেট বিস্তারের একটা অংশ। যেখানে সম্ভাবনাময় একটা বাজার আছে, যেখানে একটা ধাক্কা দিলেই অনেকদূর এগিয়ে যাবে ক্রিকেট। সেই ১৯৯৮ সালে, বাংলাদেশ ছিল এমনই একটা বাজার। একটা ক্ষেত। একটা বিশ্ব টুর্নামেন্ট যে ক্ষেতে ফলিয়েছিল অনেক ফুল-ফল! ২৪ অক্টোবর, ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে পাখা মেলেছিল আজকের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, তখনকার উইলস ইন্টারন্যাশনাল কাপ বা মিনি বিশ্বকাপ।

     

    তখন টেস্ট দল নয়টা। নক-আউট টুর্নামেন্ট করতে তাই একটা কোয়ালিফাইং ম্যাচ খেলতে হলো নিউজিল্যান্ড ও জিম্বাবুয়েকে। শেষ বলে জিতলো নিউজিল্যান্ড, হারলো অবশ্য পরের ম্যাচেই। ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে শিরোপা দক্ষিণ আফ্রিকার, পরিসংখ্যানে অনেক এগিয়ে থাকা এক ক্রিকেটার হলেন ফাইনাল সেরা, টুর্নামেন্টসেরাও। নামটা আপনিই অনুমান করে নিন না!

     

    ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার একমাত্র বৈশ্বিক অর্জন!

     

    বাংলাদেশের পর কেনিয়া। নাইরোবির জিমখানা মাঠ। প্রি-কোয়ালিফাইংয়ে ভারত খেললো কেনিয়ার সঙ্গে, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বাংলাদেশের সঙ্গে ইংল্যান্ড। আগেরবারের ফাইনাল খেলা ওয়েস্ট ইন্ডিজ বাদ পড়লো প্রথমেই। ভারতের কাছ থেকে একপ্রকার ট্রফি ছিনিয়েই নিয়ে গেল নিউজিল্যান্ড, সে সময়ের তাদের সেরা অলরাউন্ডার ক্রিস কেয়ার্নসের ওপর ভর করে। কেয়ার্নসের নাম আসবে সহজেই, আসবে অধিনায়ক স্টিভেন ফ্লেমিংয়ের নাম। কিন্তু কোচ ডেভিড ফ্রিস্ট? মাত্র দুই বছর কিউইদের কোচ ছিলেন, এখন পর্যন্ত কিউইদের সবচেয়ে বড় অর্জনের পেছনের কারিগরও তো তিনিই! নিউজিল্যান্ডের দায়িত্ব ছেড়ে ভারতে একটা একাডেমি চালিয়েছেন, ইংল্যান্ডের একটা স্কুলে কোচিং করিয়েছেন। এরপর কোচিং নয় শুধু, ক্রিকেটের সাথেই সম্পৃক্ততা শেষ হয়ে গেছে একরকম। ক্রাইস্টচার্চের বাইরে ক্ষেত-খামার নিয়ে থাকেন, সময় দেন অসুস্থ স্ত্রীকে। এবার আরেকটা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হচ্ছে, সেটার খবরও জানতেন না তিনি! চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রভাব কি এমনই বিস্মৃত? সে প্রশ্ন নাহয় তোলা থাক।

     

    প্রচার প্রসারণার পালা শেষ করে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফিরলো পুরোনোদের কাছে। তবে সেই আসরের প্রয়োজনীয়তাটা এখনও বিস্ময় জোগায়। মাস চারেক পরই বিশ্বকাপ, তারপর শ্রীলঙ্কার সেই সময়ের আবহাওয়া আরও বৃষ্টিনির্ভর। ভেসে গেল ফাইনাল, একবার নয়, দুইবার! রিজার্ভ ডে-তেও এলো না ফল। ভারত আর শ্রীলঙ্কা তাই যৌথ চ্যাম্পিয়ন।

     

    চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি এবার ফিরলো ক্রিকেটের জন্মভূমিতে। কার্ডিফের জায়গায় ছিল সাউদাম্পটন। ইংল্যান্ডের প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ভেন্যুগুলোও ছিল এবারের মতোই। সেই যে লারার হাতে একটা ট্রফি, ফাইনালের নবম উইকেটের রোমাঞ্চ। আর চিরবঞ্চিত ইংলিশ। আরেকটা ফাইনাল, আরেকটা দূর থেকে চেয়ে থাকার গল্প। সে আসরের গল্পের অনেকটা জুড়েই শুধু ওই ফাইনালটাই! বাংলাদেশ, কেনিয়ার সঙ্গে সেবার ছিল যুক্তরাষ্ট্র। দুই বছর পর যুক্তরাষ্ট্র আর থাকলো না, থাকলো না কেনিয়াও।

     

    ক্রিকেট ধর্মের দেশ ভারতে যাত্রা এবার। সঙ্গে বাছাইপর্ব। মূল টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই যা হয়ে গেল র‍্যাঙ্কিংয়ের নিচের চারটি দল নিয়ে। অনুমিতভাবেই বাদ বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ে। লারা, টেন্ডুলকারের বৈশ্বিক ট্রফির মতো তখন অজেয় অস্ট্রেলিয়ার রিকি পন্টিংয়েরও একটা আক্ষেপ ছিল। শুধু এই ট্রফিটাই যে নেই তার ঝুলিতে! সেই আক্ষেপ ঘুচে গেল তার, টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আক্ষেপটা শুধু থেকে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজের! এই ট্রফিটা জিততে এতোই মরিয়া ছিল অস্ট্রেলিয়া, ফাইনালে বৃষ্টি বাধার পর জমে থাকা জল মুছতে নেমে পড়েছিলেন খেলোয়াড়-কর্মকর্তারাও! ফাইনালের পুরষ্কার বিতরণী মঞ্চ থেকে শারদ পাওয়ারকে ঠেলে নামিয়ে দেওয়া নিয়েও হয়ে গেল এক চোট আলোচনা সমালোচনা।

     

    সেই ওভালে এবার কে হাসবেন? 

     

    আলোচনা সমালোচনা পেরিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিও এগিয়ে গেল। ততোদিনে টুর্নামেন্টটির বয়স হয়ে গেছে প্রায় এগার বছর। এবার এলো মূল ফরম্যাট। আট দল, ১৫ ম্যাচ। কাছাকাছি তিনটা শহরে খেলা। দক্ষিণ আফ্রিকা এরই মাঝে প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজন করে ফেলেছে। আর ক্যারিবিয়ানে হয়েছে এক দীর্ঘ বিশ্বকাপ! ইংল্যান্ডে হয়ে গেছে আরেকটা টি-টোয়েন্টির বিশ্ব আসর। ভুলতে বসা ওয়ানডে ক্রিকেটের স্বাদ-রোমাঞ্চ ফিরিয়ে আনলো যেন এ আসর। শিরোপা ধরে রাখলো অস্ট্রেলিয়া। ফাইনালে মেডেলের বদলে চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটাররা পেলেন একটি করে ব্লেজার। আর ক্রিকেট বোধহয় প্রথমবার প্রেমে পড়লো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির।

     

    সেই প্রেম টিকলো না। চার বছর পর ইংল্যান্ডে হওয়া টুর্নামেন্টের ১ বছর আগেই আইসিসি ঘোষণা দিল, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির এই শেষ! ২০১৭ সালে হবে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। এর মাঝে ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি ইংলিশদের একটা বড় শিরোপা দিয়েছে, আরেকবার কাছে চলে এলো ওভালে। যে ওভালের আঁধারে তা হারিয়ে গিয়েছিল উইন্ডিজের কাছে, নয় বছর আগে! ইংলিশ গ্রীষ্মের শুরুর দিকের টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার আগেই আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নিয়ে আরেকবার ভাবলো। সেই হারিয়ে যাওয়া প্রেম যেন ফিরে এলো আরেকবার। তবে ফাইনালটা ধাক্কা দিল একটা। রিজার্ভ ডে ছিল না বলে বৃষ্টিবাধায় খেলা শুরু হলো ছয় ঘন্টা পর। যে টি-টোয়েন্টি নিয়ে এতো কথা, ওয়ানডে টুর্নামেন্টের ফাইনালই বনে গেল টি-টোয়েন্টি! অনেক সফল একটা টুর্নামেন্টের শেষটা হলো যেন অপ্রত্যাশিত খচখচানিতে। আর ইংল্যান্ড আরেকবার বঞ্চিত হলো প্রত্যাশিত শিরোপা থেকে, এবার হন্তারক ভারত!

     

    ****

     

    ক্রিকেট রোমাঞ্চের অনেক বড় একটা নাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ নেই এবার। নামের ভারে টিকে থাকার দিন ফুরিয়ে গেছে যেন তাদের। ক্রিকেটবিশ্ব বরং এখন আরেকটা নামে রোমাঞ্চ খোঁজেঃ বাংলাদেশ। সেই কবে থেকে উড়ি উড়ি করেও পেখম মেলছিল না যেন অনেক উন্মাদনার এই বাংলাদেশ। র‍্যাঙ্কিংয়ের ধাপগুলো পেরিয়ে, ওয়ানডেতে নিজেদের মাটিতে অনেক কঠিন দল হয়ে ওঠা বাংলাদেশ আছে এবারের আসরে। ক্রিকেট প্রসারের জন্য নয়, শুধু টেস্ট দল হিসেবেই নয়। মূল মাপকাঠি ওই পারফরম্যান্স।

     

    পরের বিশ্বকাপেও আছে র‍্যাঙ্কিংয়ের প্রভাব। দ্বিপাক্ষিক ওয়ানডে সিরিজগুলোতে বাড়ছে তাই উত্তেজনা। শুধু একটা ম্যাচ বা সিরিজ নয়, এর সাথে জড়িয়ে থাকছে যে ভবিষ্যতের একটা বড় ছবিও। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ভবিষ্যত ছবিটা তাহলে হবে কেমন?

     

    পরের আসর হওয়ার কথা ভারতে, তবে তা নিশ্চিত নয়। সেটা না হলে ভারতকে ২০২৩ বিশ্বকাপের আগে একটা ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি আয়োজনের অধিকার দেয়ার কথা। তবে আগামী ১৮ দিনে বদলে যেতে পারে অনেক কিছু। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হয়ে উঠতে পারে ক্রিকেটের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পেতে পারে নিশ্চয়তা, ক্রিকেটের সূচিতে টিকে থাকার।

     

    সামনের ১৮ দিন তাই গুরুত্বপূর্ণ। হাঁটি হাঁটি করে, কয়েকবার শেষ দেখে ফেলেও ১৯ বছর পেরুনো একটা টুর্নামেন্ট যাত্রা শুরু করছে আরেকবার।

     

    চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি কি পাবে একটা নিশ্চিত ভবিষ্যত? আসলেই কি হয়ে উঠবে আইসিসির প্রচারবাণীর মতো একটা উপলক্ষ্যঃ ‘যেখানে নায়করা চ্যাম্পিয়ন বনে যান!’