বাংলাদেশের অপেক্ষায় সেই এজবাস্টন
গেরাইন্ট জোনস। ল্যান্স ক্লুজনার। ব্রায়ান লারা। এজবাস্টনকে চাইলেই ভুলতে পারবেন না কেউই।
‘সত্যি বলতে কী, এই একটা মুহুর্তের জন্যই আমাকে মনে রাখা হবে।’
গেরাইন্ট জোনস হাসেন কথাটা বলে। ‘আমি সবাইকে এটাই বলি। লোকে আমাকে মনে রাখবে একটি ক্যাচের জন্যই। রিপ্লের মতো ধীরলয়ে এটা আমার মনে খেলে যায়। বলটা আমার গ্লাভসে এসে বন্দী হলো, আমি গড়িয়ে পড়লাম। বিলি বাউডেন তার ‘ক্রুকেড ফিঙ্গার’টা তুললেন। কী যেন হয়ে গেল তারপর। ছুটলাম দিগ্বীদিক।’
জোনস ছুটেছিলেন মাইকেল ক্যাসপ্রোভিচের ক্যাচটা নিয়ে। স্টিভ হার্মিসনের লেগস্টাম্প দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়া বল ছুঁয়ে গিয়েছিল ক্যাসপ্রোভিচের গ্লাভস। বাঁদিকে ঝুকে ক্যাচটা নিয়েছিলেন জোনস; ইংল্যান্ডের হয়ে যিনি খেলেছিলেন ৩৪টি টেস্ট। পাপুয়া নিউ গিনিতে জন্ম যাঁর, কেন্টের দীর্ঘদিনের নিয়মিত উইকেটকিপার হয়ে গিয়েছিলেন ইতিহাসের অংশ। ওই একটা ক্যাচই যে বদলে দিয়েছিল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক অ্যাশেজের গতিপথ, যে পথে হেঁটে ১৮ বছরের না জেতা অ্যাশেজের যাতনা ভুলেছিল ইংল্যান্ড! অস্ট্রেলিয়া কি ভুলতে পেরেছে সেই যাতনা? ক্যাসপ্রোভিচকে কি এখনও খোঁচা দেয় সেই শটটা?
দক্ষিণ আফ্রিকা অবশ্য তাদের যাতনাটা ভুলতে পারবে না। একটা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপাও বোধহয় যথেষ্ট নয়, ল্যান্স ক্লুজনারের দক্ষিণ আফ্রিকাকে সেই ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালটা ভোলাতে। উইকেটের পেছনে ছাড়া যে কোনো দিকে বল গেলেই রান ‘কল’ করার দায়িত্ব স্ট্রাইকারের, ক্রিকেটের প্রায় অলিখিত নিয়ম। সেই ‘কল’টা যে সেবার বুমেরাং হয়ে গেল, অ্যালান ডোনাল্ড যে শুনতে পেলেন না ক্লুজনারের সেই ডাক। জন্ম নিল ওয়ানডে ক্রিকেটের এক ট্র্যাজেডি-কমেডির উপাখ্যান, ক্রিকেট দেখলো বোধহয় ইতিহাসের সেরা ওয়ানডেটাই।
জোনসদের সেই টেস্টটা টাই হওয়া থেকে ২ রান দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, ক্লুজনারদের ওয়ানডেটা হয়েছিল টাই। এজবাস্টনে ১৯৯৪ সালে আরেকটা প্রথম শ্রেণির ম্যাচ অবশ্য হয়েছিল স্রেফ ড্র। চারদিন ধরে দুইদল ব্যাট করেছিল শুধু একটি করে ইনিংস, ওয়ারউইকশায়ার আর ডারহাম। সেই ম্যাচেই ওয়ারউইকশায়ারের এক ব্যাটসম্যান যা করেছিলেন, সেটা শুধু তিনি কেন, ভুলতে পারবে না এজবাস্টনও। ৬২ চার, ১০ ছয়; ৪৭২ বলে ব্রায়ান চার্লস লারা সেদিন করেছিলেন অপরাজিত ৫০১ রান। প্রথম শ্রেণির ইতিহাসের একমাত্র কুইন্টাপল সেঞ্চুরি। একটা বিখ্যাত টেস্ট, একটা যুগান্তকারী টাই ওয়ানডে, একটা কিংবদন্তি ইনিংস। বার্মিংহামের এজবাস্টনকে মনে রাখার জন্য কি যথেষ্ট নয়?
১৯০২ সালে অভিষেক হয়েছিল এজবাস্টনের। তবুও ইংল্যান্ডের নিয়মিত ছয় টেস্ট ভেন্যুর মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিল তা। প্রায় ১০০ বছর পর ২০০৩ সালে চেস্টার-লি-স্ট্রিট এসে সেই স্থানটা নিয়েছে।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এসে ওয়ারউইকশায়ারের তৃতীয় ঘরের মাঠ হয়েছিল এজবাস্টন। বেশ কয়েকবারই সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে তা। কখনও নতুন স্কোরবোর্ড, কখনও নতুন প্যাভিলিয়ন। লারা বা ক্লুজনার যে এজবাস্টনে খেলেছিলেন, জোনসের খেলা এজবাস্টন তাই ভিন্ন ছিল কিছুটা।
তবে সংস্কারে বা ভোল বদলানোতে কি আর চাপা পড়ে ইতিহাস! ২০০৫ সালে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার ওই দ্বিতীয় টেস্টের চেয়েও কম ব্যবধানে জিতেছে কোনো দল, ১৯৯৯ সালের সেই সেমিফাইনালের আগেও টাই হয়েছে ওয়ানডে। লারার ইনিংসটা অবশ্য ‘প্রথম’ কুইন্টাপল সেঞ্চুরি।
এই প্রথমের অভিজ্ঞতাগুলো কেমন অদ্ভূতই হয়। ভাল-মন্দ-অসাধারণ, যেই অভিজ্ঞতাই হোক, প্রথমকে ভুলতে পারেন কজন! বাংলাদেশও তাই পারবে না। ১৫ জুন এজবাস্টনে বাংলাদেশ নিজেদের ইতিহাসের প্রথম সেমিফাইনাল খেলতে নামবে।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অবশ্য এজবাস্টন এক নিয়মিত নাম। এবার ইংল্যান্ডে এ টুর্নামেন্টের তৃতীয় আসর, এর আগের দুইবারই ওভালের সঙ্গে ছিল এজবাস্টনও। একবার হয়েছে সেমিফাইনাল, একবার ফাইনাল। ভারত গতবার ফাইনাল খেলেছে এজবাস্টনে, এবারও তাদের সেমিফাইনাল সেখানেই। সেই সেমিফাইনালেই ভারতের প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ।
১৫ তারিখকে তাই ভুলতে পারবে না বাংলাদেশ। যে ১৫ তারিখ এখনও আসেনি, যে ১৫ তারিখের ম্যাচটা এখনও বেশ কয়েকঘন্টা দূরে, সেই ১৫ তারিখকেই ভোলা যাবে না। ১৫ তারিখের এজবাস্টন তাই বিশেষ কিছু।
বাংলাদেশের প্রথমের মতো ইংল্যান্ডেরও এক প্রথমের অভিজ্ঞতা হবে এই এজবাস্টনেই। আগামী আগস্টের ১৭ তারিখ সেখানেই প্রথমবারের মতো দিবা-রাত্রির টেস্ট খেলবে ইংল্যান্ড।
‘তবে আমি আসলে খুশিই হই। অনেক বড় এক মুহুর্ত ছিল তা। শুধু ওই সিরিজে না, অ্যাশেজের জন্যই এক অনন্য মুহুর্ত। সেই মুহুর্তে গ্লাভস হাতে দাঁড়ানো, ক্যাচ নেয়াটা, আমার কাছে খুবই বিশেষ এক স্মৃতি’।
গেরাইন্ট জোনসের মতো ল্যান্স ক্লুজনার বা ব্রায়ান লারাও তাই ভুলতে পারবেন না এজবাস্টনকে। ১৫ তারিখের ম্যাচের ফল যাই হোক, এজবাস্টনকে ভুলতে পারবে না এই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির বাংলাদেশ দলটাও।
আপনি পারবেন?
চাইলে চেষ্টা করে দেখতে পারেন ম্যাচের পর। আপনার জন্য শুভকামনা।