• " />

     

    কোন পথে দুঙ্গার ব্রাজিল ?

    কোন পথে দুঙ্গার ব্রাজিল ?    

    মিনেইরাজোর সেই স্মৃতি অনেকদিনই পোড়াবে ব্রাজিলকে। নিজেদের মাঠে জার্মানির কাছে সাত গোলে হেরে যাওয়ার ক্ষত তো সহজে মিলিয়ে যাওয়ার নয়। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের সেই পরাজয় প্রবল একটা ধাক্কা দিয়েছে ব্রাজিলের ফুটবলে। পদ ছেড়ে চলে গেছেন লুইস ফেলিপে স্কলারি। একসময় যাঁকে বিশ্বকাপ ব্যর্থতার দায় মাথায় নিতে চলে যেতে হয়েছিল, সেই দুঙ্গাকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এখনও চূড়ান্ত কিছু বলার সময় আসেনি, তবে দুঙ্গার ব্রাজিল দুঃস্বপ্নটা অনেকটা পেছনে ফেলে এসেছে বলেই মনে হচ্ছে। বিশ্বকাপের পর টানা আটটি প্রীতি ম্যাচে জিতেছে ব্রাজিল, মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, এর মধ্যে চিরপ্রতিন্দ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের সঙ্গে জয়ও আছে। কিন্তু দুঙ্গার ব্রাজিলের উৎরে যাওয়ার আসল পরীক্ষা সামনে, দুই মাস পরেই যে কোপা আমেরিকা। দুঙ্গা কতখানি বদলে দিতে পেরেছেন তার আসল প্রমাণ পাওয়া যাবে সেখানেই। তবে এই মৌসুমে আর কোনো প্রীতি ম্যাচ খেলছে না ব্রাজিল, কোপা শুরুর কয়েকদিন আগে বলিভিয়ার সঙ্গে প্রীতি ম্যাচটাই হবে ব্রাজিলের অন্তিম প্রস্তুতি।

     

     

    দুঙ্গার ব্রাজিলের পারফরম্যান্স

    ৬ সেপ্টেম্বর -কলম্বিয়া ১-০

    ১০ সেপ্টেম্বর - ইকুয়েডর ১-০

    ১১ অক্টোবর আর্জেন্টিনা ২-০

    ১৪ অক্টোবর জাপান ৪-০

    ১২ নভেম্বর তুরস্ক ৪-০

    ১৮ নভেম্বর অস্ট্রিয়া ২-১

    ২৬ মার্চ - ফ্রান্স ৩-১

    ২৯ মার্চ , চিলি ১-০

    (সবগুলো জয় )

     

    কিন্তু আসলেই কি দুঙ্গা ব্রাজিলের খোলনলচে বদলে দিতে পেরেছেন ? আর প্রীতি ম্যাচ দিয়ে দলের মূল্যায়ন করা কতটুকু যৌক্তিক ? মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, স্কলারির দলও টানা নয় ম্যাচে এসেছিল বিশ্বকাপে। সেই ব্রাজিল ছিল আরও দুর্ধর্ষ, নয় ম্যাচে করেছিল ৩০ গোল। কিন্তু আসল জায়গায় গিয়েই ঘটল ভরাডুবি। কোপা আমেরিকায় ব্রাজিলের কাছে শিরোপা ছাড়া অন্য যে কোনো কিছুই হবে ব্যর্থতা। দুঙ্গা সেই মিশনকে সামনে রেখে কতটুকু কী করেছেন? একটু খতিয়ে দেখা যাক

     

     

    পথ দেখাচ্ছেন নেইমার

    গোলের জন্য নেইমারই প্রধান ভরসা। শুধু গোল নয়, হ্লুদ জার্সির নেইমার দলের জন্য দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ীও বটে। জার্মানির সঙ্গে ওই ম্যাচে মাঠের বাইরে থেকে অসহায় দেখতে হয়েছে দলের বিপর্যয়। বিশ্বকাপের পর দুঙ্গা অধিনায়কের বাহুবন্ধনী তুলে দিয়েছেন তাঁর হাতেই। অনেকেই মনে করেছিলেন, ২৩ বছর বয়সে দলের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে এই দায়িত্ব। নেইমার আশঙ্কাটা অমূলকই প্রমাণ করেছেন। দুঙ্গার অধীনে আট ম্যাচে আট গোল পেয়েছেন। দুইটি ম্যাচে শেষ মুহূর্তে বদলি হয়ে নেমে গিয়েছিলেন, এ ছাড়া খেলেছেন প্রতিটি মিনিটই। ব্রাজিলের হয়ে খেলাটাকে কতটা মহার্ঘ্য মনে করেন, সেটা বলে না দিলেও চলে।

     

     

    নয় নম্বরের সন্ধানে

     

    নেইমার গোল পাচ্ছেন বটে, কিন্তু ক্লাসিক একজন স্ট্রাইকারের হাপিত্যেশ এখনও কাটেনি ব্রাজিলের। বিশ্বকাপে ফ্রেড দলের জন্য রীতিমতো বোঝাই হয়ে উঠেছিলেন। আক্রমণের জোয়াল একাই বইতে হয়েছে নেইমারকে। মজার ব্যাপার, এরপর থেকে কিন্তু ফ্রেড দুর্দান্ত ফর্মেই আছেন। ঘরোয়া লিগে এই মৌসুমে এখনও সবচেয়ে বেশি গোল ৩৩ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকারেরই। তবে দল থেকে অবসর নিয়ে নিয়েছেন আগেই, দুঙ্গাও অভিজ্ঞতার চেয়ে এখানে তারুণ্যকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। ডিয়েগো টারডেই, লুইজ আদ্রিয়ানোসহ কয়েকজনকেই পরখ করে দেখা হচ্ছে। তবে কোপায় সম্ভবত শিকে ছিড়তে পারে রবার্তো ফিরমিনোর কপালে। ২৩ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড খেলেন হফেনহেইমে, গত মৌসুমে ১৬ গোল করেছিলেন। ঠিক "বক্স টু বক্স" স্ট্রাইকার নন, বরং একটু নিচে থেকেই খেলতেই পছন্দ করেন। তবে নেইমারের সঙ্গে বোঝাপড়া এখন পর্যন্ত ভালোই। দুঙ্গা অবশ্য তাঁকে ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে সবার সামনেই খেলিয়েছেন। নিজের জাত চিনিয়েছেন গত দুই ম্যাচেই, ফ্রান্সের সঙ্গে একটি গোল করার পর চিলির ম্যাচে জায়গা হয় বেঞ্চে। শেষ পর্যন্ত বদলি নেমে গোল করেই দলকে এনে দিয়েছেন জয়। তারপরও দলে জায়গা পাকাপাকি করতে আরও অনেক কিছুই প্রমাণ করতে হবে ফিরমিনোকে।

     

     

    রক্ষণে বদলের গান

    দানি আলভেস না মাইকন, অনেকদিন ধরে রক্ষণের ডান দিকে জোর লড়াই চলেছে ব্রাজিলে। তবে দুই ডিফেন্ডারের বিদায়ঘন্টা বেজে গেছে বলেই মনে হচ্ছে। দুঙ্গা এখন আস্থা রাখছেন ২৩ বছর বয়সী দানিলোর ওপরেই। পোর্তোর এই রাইটব্যাক মাত্রই কদিন আগে নাম লিখিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদে। কেন মাদ্রিদ তাঁকে কিনেছে, সেটার সামান্য আভাস দিয়েছেন চিলির সঙ্গে ম্যাচে। তাঁর দারুণ এক থ্রু থেকেই গোল পেয়েছিলেন ফিরমিনো। আক্রমণে যেমন দুর্দান্ত, রক্ষণটাও সামলাতে জানেন ভালো। ফ্রান্সের সঙ্গে ম্যাচেই সেটির প্রমাণ দেখা গেছে। বিশ্বকাপে দলে ব্রাত্য অ্যাটলেটিকো ডিফেন্ডার মিরান্ডাও এখন নিয়মিত। গত দুই ম্যাচেই থিয়াগো সিলভার সঙ্গী ছিলেন রক্ষণে। কোপায় অনেকদিনের নিয়মিত মুখে ডেভিড লুইজের জায়গায় সুযোগ পেয়ে গেলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

     

     

    আগের মতোই আঁটোসাঁটো

    এমন নয়, দায়িত্ব নিয়েই দুঙ্গার ব্রাজিল সেই সাম্বার চিরায়ত ধ্রুপদী ফুটবলে ফিরে গেছে। দুঙ্গা "আগে ঘর সামলাও" নীতিতেই অটল আছেন, এই ব্রাজিলে সেটির প্রতিফলন। আক্রমণের চেয়ে প্রতিআক্রমণই বেশি হচ্ছে, ফাউল করে প্রতিপক্ষের ছন্দ করে দেওয়ার কৌশল তো আছেই। চিলির সঙ্গে ম্যাচে ব্রাজিল ৩২টি ফাউল করেছিল, যেখানে প্রতিপক্ষ করেছিল মাত্র ১৫টি। টোস্টাও তো এমনি এমনি আক্ষেপ করে বলেননি, "যখন থেকে ব্রাজিল পাসিং ফুটবলটা ত্যাগ করেছে, তখনই তার ধ্বংস শুরু হয়ে গেছে।" দুঙ্গার ব্রাজিল সাফল্য এনে দিতে পারে, তবে কতটুকু মন ভরাতে পারবে সেটা নিয়ে সংশয় থাকছেই।

     

     

     

    তাহলে কেমন হচ্ছে নতুন ব্রাজিল

     

    সবশুদ্ধ আসলে কেমন চেহারা নিতে পারে দুঙ্গার ব্রাজিল ?

     

    এই ছবি দেখে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যাবে। থিয়াগো সিলভার সঙ্গী হিসেবে লুইজের জায়গায় মিরান্ডা আসতে পারেন। মধ্যমাঠে গুস্তাভো-ফার্নান্দিনহোর "ডাবল পিভোট" খেলবে বলেই মনে হচ্ছে। একটু সামনে অস্কারের জায়গা মোটামুটি পাকা, বিকল্প হিসেবে লিভারপুলের কুটিনহো তো আছেনই। ডানে হাল্ক অনেক আগে থেকে উপেক্ষিত, উইলিয়ানই এখানে প্রথম পছন্দ। নেইমার তো আছেনই, আর সামনে ফিরমিনো হতে পারেন প্রথম পছন্দ।

     

     

     

    কোপায় সম্ভাবনা কতটা উজ্জ্বল ?

     

    কোপা আমেরিকার সূচিটা একটু গোলমেলে, ১২টি দল থেকে আটটি যায় নকআউট পর্বে। সেখানে নির্ধারিত সময় গোলশুন্য হলে কোনো অতিরিক্ত সময় নেই, খেলা গড়ায় সরাসরি টাইব্রেকারে। ২০১১ সালে প্যারাগুয়ে এই সুবিধা নিয়ে একটা ম্যাচও না জিতে চলে গিয়েছিল ফাইনালে। এবার কাগজে কলমে অনেকগুলো দলেরই সম্ভাবনা আছে। ক্যারিয়ারে দেশের হয়ে কোনো বড় শিরোপা না জেতার অতৃপ্তি ঘোচাতে চাইবেন লিওনেল মেসি। স্বাগতিক হিসেবে চিলিও ছেড়ে কথা বলবে না, বিশ্বকাপেও হোর্হে সাম্পাওলির দল চমক দেখিয়েছিল। আর বিশ্বকাপের সবাইকে চমকে দেওয়া কলম্বিয়া তো আছেই। উরুগুয়েও সোনালী প্রজন্মের ছায়া ঝেড়ে ফেলে ধীরে ধিরে নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছে। সব মিলে দুঙ্গার ব্রাজিলের শিরোপা জেতার পথে অনেক কাটাই ছড়ানো।